ফুটবলের আবেগপ্রবণ সমর্থকদের সঙ্গে ক্লাবের করপোরেট সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব যেমন
ম্যানচেস্টার সিটি যখন ২০২৪-২৫ মৌসুমের জন্য সিজন-টিকিট বিক্রি নিয়ে ঘোষণা দেয়, তখন তারা নিজেদের সমর্থকদের নিয়ে এটা আবেগাপ্লুত করার মতো ভিডিও তৈরি করে, যেখানে ক্লাবটিকে ভক্তদের নিয়ে ব্যাপক গুণাগুণ গাইতে দেখা যায়। ‘আমাদের সিটি, আমাদের মানুষ’ স্লোগানে ভিডিওটি বানায় সিটি। এই ভিডিওতে সমর্থকদের ক্লাবের ‘হৃৎস্পন্দন’ বলেও মন্তব্য করা হয়।
কোলাজ করা ছবির শেষ ফ্রেমের অর্ধেকে খেলোয়াড় এবং বাকি অর্ধেকে দেখা যায় সমর্থকদের। মূলত খেলোয়াড় ও দর্শকদের মধ্যে সমতা দেখাতেই কাজটি করে তারা। এ ভিডিওতে ইতিহাদে টানানো একটি ব্যানারও দেখা যায়, যেখানে ওয়াইসিসের একটি গানের লাইন লেখা ছিল—‘উইহেভ সিন থিংস দে উইল নেভার সি’, যার অর্থ—‘আমরা সেসব দেখি, যা তারা দেখে না’।
এই ভিডিওর বিপরীত চিত্রও আছে, যেটা বরং একটু বেশি প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি সিটি কর্তৃপক্ষ একটি ব্যানার সরিয়ে ফেলেছে, যেখানে লেখা ছিল, ‘রেকর্ড প্রফিটস বাট রেকর্ড প্রাইস। স্টপ এক্সপ্লোটিং আওয়ার লয়্যালিটি।’ কিন্তু ব্যানারটি পরে নামিয়ে ফেলা হয়।
এরপর ইতিহাদে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ১৮৯৪ নামের সমর্থক গোষ্ঠীর সঙ্গে তৈরি হয় সিটির বিরোধ। গ্রুপটি দাবি করে, তাদের নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও সিটি তা অস্বীকার করে। ক্লাবটি দাবি করে ১৮৯৪ গোষ্ঠী নিজেদের প্রদর্শনীর জন্য স্টেডিয়ামে আগে প্রবেশের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমতি গ্রহণ করেনি। তবে সমর্থক গোষ্ঠীটি বলেছে, তারা নিজেদের পরিকল্পনার বিষয়টি ক্লাবকে আগেই জানিয়ে রেখেছে। সত্য যা–ই হোক, এ ঘটনায় দুই পক্ষের সম্পর্ক যে আগের চেয়ে জটিল হয়ে পড়েছে, তা বলা যায়।
এসব ঘটনা বলছে, পরিস্থিতি মোটেই সম্মানজনক নয়। ভেতরের অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে ফুটবল ক্লাবগুলো নিজেদের প্রয়োজনমতোই সমর্থকদের গুণগান করছে। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের ঠেলে দিচ্ছে প্রান্তে। সিটির উদাহরণ দেওয়া হলেও এ কাজ শুধু ইতিহাদের ক্লাবটি করছে, এমন নয়। ক্রিস্টাল প্যালেস হোমসডেল ফ্যানাটিকস (এইচএফ) নামের সমর্থক গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত বিরোধে জড়াচ্ছে। অথচ ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গলা ফাটাতে দেখা যায় তাদেরই। গত নভেম্বরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ এভারটনের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথমার্ধের খেলা বয়কট করেছিল এইচএফ।
আর এখন বিরোধ শুরু হয়েছে ব্যানার সরানো নিয়ে। প্যালেসের মাঠ সেলহার্টস পার্কের এক জায়গায় একটি ব্যানারে লেখা ছিল—‘হোমসডেল ফ্যানাটিকস’। কিন্তু চলতি মৌসুমে ক্লাবটি বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য গ্রাফিকস দেখানোর জন্য একটি এলইডি বোর্ড বসিয়েছে। আর এ কারণেই মূলত ব্যানারটি সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্প্রতি এ ঘটনার প্রতিবাদে লুটনের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ম্যাচের আগে নিজেদের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানায় এইচএফ, যা ম্যাচের আবহ তৈরিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
গত মার্চে খেলাধুলাভিত্তিক পোর্টাল দ্য অ্যাথলেটিককে এই সমর্থক গোষ্ঠী জানায়, ক্লাব এখন সমর্থকদের চেয়ে জুয়ার সাইট ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ফার্মকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর জবাবে ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, এলইডি বোর্ড দর্শকদের জন্য উপকারী এবং এ কারণে ক্লাবের আয়ও বেড়েছে। এদিকে ব্যানার লাগানোর জন্য বিকল্প জায়গার কথা বলা হলেও সেটি মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি সমর্থকদের কাছে। কয়েক বছর আগে টটেনহাম কর্তৃপক্ষ ‘স্পার্স সাইপ্রাস’ নামের ব্যানার স্টেডিয়াম থেকে নিষিদ্ধ করে। এটিকে মূলত ‘রাজনৈতিক প্রতীক’ উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে পরে প্রতিবাদের মুখে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
এদিকে লিভারপুল সমর্থক গোষ্ঠী স্পিরিট অব শাঙ্কলি এবং স্পিওন কপ ১৯০৬ অ্যানফিল্ডে আতলান্তার বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ম্যাচে ব্যানার ও পতাকা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে। টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদেই কাজটি করেছে তারা। এক বিবৃতিতে স্পিওন কপ ১৯০৬ বলে, ‘২৪-২৫ মৌসুমে টিকিটের দাম নিয়ে ক্লাবের সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। এর প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার (আতলান্তার বিপক্ষে ম্যাচের দিন) কোনো পতাকা দেখানো হবে না।’
পাল্টাপাল্টি এসব কার্যক্রমে কে সঠিক আর কে ভুল, তা নির্ধারণ করা কঠিন হলেও এসব ঘটনা দেখায় যে ঐতিহ্যের ধারা বয়ে চলা আবেগপ্রবণ সমর্থকদের সঙ্গে করপোরেট সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এখন চরম রূপ ধারণ করেছে। আধুনিক ফুটবলে পরিবর্তিত বাস্তবতায় এই দ্বন্দ্ব অবশ্য অনিবার্যও।
এ পরিস্থিতিতে সমর্থকদের বাদ দিয়ে ফুটবল আসলেই সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নও উঠেছে। অনেক সমর্থক মনে করেন, ক্লাবগুলো তাদের শুধুই বিপণনের জন্য ব্যবহার করছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সমর্থকদের বাদ দিয়ে ফুটবলের পরিধি খুবই ছোট গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। করোনাকালীন পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে, যখন দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা নিয়ে মানুষ আগ্রহ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।
এমনকি দর্শকদের ছাড়া টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল সামান্য।
সমর্থকদের গুরুত্ব অবশ্য ক্লাবগুলোরও অজানা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও ও ছবিতে সমর্থকদের উন্মাদনাকে গর্বের সঙ্গে প্রচার করে তারা। এসবের মধ্য দিয়ে ক্লাবের প্রচারণার পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও থাকে তাদের। বিপরীতে সমর্থক গোষ্ঠীগুলো এর জন্য কোনো ধরনের আর্থিক প্রতিদান বা বিশেষ সুবিধা প্রত্যাশা করে, তা নয়। তবে এসব কারণে তারা বিরক্ত হয় এবং কেউ কেউ এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টাও করে।
ক্লাবগুলোতে অবশ্য সমর্থক গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য কাজের নির্দিষ্ট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া থাকে, যেখানে কাজের বড় একটি অংশ থাকে স্টেডিয়াম প্রদর্শনী ঘিরে। পাশাপাশি ক্লাবগুলোর হাতে প্রদর্শনীর ওপর সেন্সরশিপ আরোপের অধিকারও ন্যস্ত থাকে। এর অর্থ ক্লাবের প্রতি সমালোচনামূলক যেকোনো উদ্যোগকে দমন করার সুযোগ থাকে কর্তৃপক্ষের। আর এটি করার জন্য নানা ধরনের খোঁড়া যুক্তিও দিয়ে থাকে ক্লাবগুলো।
ফুটবল ক্লাবগুলো অবশ্য সাধারণ কোনো ক্লাব নয়। তাদের নানা ধরনের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে। এ কারণে ক্লাবগুলোকে সব সময় একধরনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রাখতে হয়। ফলে সমালোচনামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কঠোর হতে হয় তাদের, যা সমর্থকদের সঙ্গে অনেক সময় গুরুতর বিবাদও তৈরি করে।
মূল ব্যাপার হচ্ছে, ক্লাবগুলো নিজেদের স্বার্থে সমর্থকদের আবেগ ও সংস্কৃতিকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু যখন সেই আবেগ ও সংস্কৃতি ক্লাবের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী নেয়, তখন সেটাকে দমনেও সচেষ্ট হয়ে ওঠে ক্লাবগুলো, যা দুই পক্ষের সম্পর্কে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। কিন্তু যাঁদের ব্যবহার করে ক্লাবগুলোর এমন রমরমা অবস্থা, সেই সমর্থকদের অন্তত অসন্তুষ্টি প্রকাশের অধিকার তো দিতে হবে!