বাস ড্রাইভার থেকে এসপানিওলের ডাগআউটে, হার না মানা এক কোচের গল্প
২০১৬ সালে আরসিডি এসপানিওলের মালিকানা কিনে নেন চীনা ব্যবসায়ী চেন ইয়ানশেং। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আরসিডির স্টেডিয়ামের ডাগআউট থেকে বিদায় নিয়েছেন ১১ জন কোচ। ক্লাবের চাহিদা মেটাতে ও মালিকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেননি কোনো কোচই। দলের কোচের মতো মাঠেও এসপানিওলের অবস্থা ছিল উত্থান-পতনে ঠাসা। এক মৌসুমে ৭ নম্বরে থেকে শেষ করছে আবার পরের মৌসুমে অবনমিত হয়ে চলে যাচ্ছে নিচের স্তরে। গত মৌসুমে যেমন স্পেনের দ্বিতীয় স্তরের লিগ সেগুন্দা ডিভিশনে অবনমিত হওয়ার পর এখন আবার লা লিগায় ফেরার লড়াইয়ে আছে ক্লাবটি।
ক্লাবটির কোচ নিয়ে অস্থিরতার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে এ মৌসুমেও। চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে দুজন ক্লাবটির দায়িত্ব ছেড়ে গেছেন। লুইস গার্সিয়া ও লুইস মিগুয়েল রামিসের পর এখন দায়িত্বে এসেছেন মানোলো গনসালেস। এই লেখা মূলত এসপানিওলের নতুন কোচ মানোলোকে নিয়েই।
মানোলোকে নিয়ে সাবেক এসপানিওল খেলোয়াড় মইসেস হারতাডু বলেছেন, ‘সবাই একমত যে তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি আমাদের রক্ষা করবেন। এ মুহূর্তে এটাই অনেক।’ এই দায়িত্ব পালনে মানোলো যে সক্ষম, সে প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছেন তিনি। এসপানিওলের হয়ে পাঁচ ম্যাচে কোচিং করে এখনো হারের মুখ দেখেননি এই কোচ। দুই জয়ের বিপরীতে ড্র করেছেন তিন ম্যাচে। এ পারফরম্যান্সে দলকে শীর্ষ লিগে যাওয়ার লড়াইয়েও নিয়ে এসেছেন।
কোচ বদলের যে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা এসপানিওল খেলছে, তাতে মানোলো কত দিন স্থায়ী হবেন, তা বলা মুশকিল। কিন্তু এরই মধ্যে হার না মানা মানুষের অনবদ্য এক গল্প লিখে ফেলেছেন ৪৫ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ কোচ। একসময় পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যে মানুষটি বার্সেলোনার রাস্তায় বাস চালিয়েছেন, তিনিই এখন এসপানিওলের মতো ক্লাবের ডাগআউট সামলাচ্ছেন। এই তথ্যটুকুই স্পষ্ট করে দিচ্ছে, কোচিংয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসতে কতটা কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে মানোলোকে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মানোলোর খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে কিন্তু বলার মতো কিছু নেই। স্পেনের অন্য শীর্ষ কোচদের সঙ্গে তাঁর মিলও খুব সামান্য। ১৯৮৭ সালে বয়সভিত্তিক দলের হয়ে যাত্রা শুরু করেন মানোলো। কিন্তু সিনিয়র ফুটবলে কখনো খেলাই হয়নি তাঁর। ফুটবল মাঠের খ্যাতি কিংবা অর্জন—কোনো কিছুর স্বাদও পাওয়া হয়নি। সাফল্য কখনোই তাঁর জন্য দরজা খুলে দেয়নি। তবে কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি। নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থেকে কখনো সরে আসেননি।
তাঁকে নিয়ে এফসি মার্টিনেন্স ক্লাবের পরিচালক আলফ্রেড পোর্কার বলেছেন, ‘তাকে কেউ কখনো কিছু দেয়নি। এমনকি তার অভিষেকও হয়েছিল শিশুদের সঙ্গে অপেশাদার ক্যাটাগরিতে।’
ফুটবলার হিসেবে ডানা মেলার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন মানোলো। খেলোয়াড়দের অমোঘ ভাগ্য চোট কৈশোরেই ভেঙে দেয় তাঁর ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। এরপরও চেষ্টা করেছিলেন ফিরে আসার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। এভাবে স্বপ্নভঙ্গের পরও ফুটবলের হাত ছাড়েননি মানোলো। ২১ বছর বয়সে খেলোয়াড়ি জীবনের অবসর ঘোষণা করলেও ১৬ বছর বয়সেই শুরু করে দিয়েছিলেন কোচিং। ১৯৯৫ সালে মার্তিনেন্স ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলের কোচের দায়িত্ব নেন মানোলো। ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নেন সান গ্যাব্রিয়েলের যুব দলের। সে সময় পরিবার চালানোর জন্য পাশাপাশি বাসচালকের কাজও করেন মানোলো।
২০০৫ সালে দায়িত্ব নেন বাদালোনার যুব দলের। সাত বছর সেই দলের কোচিং করিয়ে ২০১২ সালে যোগ দেন মন্তানেসা ক্লাবে। সেবারই প্রথম কোনো সিনিয়র দলের কোচের দায়িত্ব পান মানোলো। মন্তানেসায় দুই বছর থাকার পর মানোলো আবার ফিরে আসেন বাদালোনায়। কোচিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা ক্লাবটিতে ঢেলে দেন তিনি। এই ক্লাবে ধারাবাহিকতা দেখিয়ে ২০১৮ সালে যোগ দেন আরেক স্প্যানিশ ক্লাব এব্রোতে।
মানোলোর হাত ধরেই কোপা দেল রের নকআউট পর্বে জায়গা করে নেয় এব্রো।
ভ্যালেন্সিয়ার মতো ক্লাবের সঙ্গে লড়াই করে দুই লেগ মিলিয়ে ৩-১ গোলে হারে এব্রো। এরপর পেনা দেপোর্তিভা ও এসপানিওল ‘বি’ দল ঘুরে এ বছরের মার্চে মানোলো দায়িত্ব নেন এসপানিওলের। দায়িত্ব নিয়েই জারাগোজার মাঠ থেকে ১-০ গোলের জয় নিয়ে ফেরেন মানোলো। তাঁর এই জয় যেন দীর্ঘ ২৯ বছরের অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের প্রতীকী ফসল। যা বলছে, কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠা কখনো বৃথা যায় না।
এসপানিওলে এসেও মৌলিক জায়গাগুলোতে কোনো ছাড় দিচ্ছেন না মানোলো। এখনো নাকি অনুশীলনের বাইরে তাঁর দিন কাটে খেলা দেখে এবং ম্যাচ বিশ্লেষণ করে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের প্রত্যেককে আলাদা করে বিশ্লেষণ করে নিজের রণকৌশল ঠিক করেন তিনি। প্রতিপক্ষ দলের সব সূক্ষ্ম বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে দলকে প্রস্তুত করেন এই স্প্যানিয়ার্ড। আর দলের খেরোয়াড়দের সঙ্গেও তিনি সব সময় অকপট। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সর্বোচ্চটা বের করতে নিজের সেরাটা উজাড় করে দেন এই কোচ।
পাশাপাশি পুরোনো ক্লাবগুলোর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক এখনো অটুট। এখনো সময় পেলে চলে যান ক্লাবগুলোতে। এমনকি পারস্পরিক সমঝোতায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া পেনা দেপোর্তিভা এখনো তাঁর অভাব বোধ করছে। মানোলোর জন্য সব সময় দুয়ার খোলা আছে বলেও জানিয়েছে ক্লাবটি। বিপরীতে এসপানিওল সমর্থকদের কাছেও দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে তাঁর।
এসবে অবশ্য মনোযোগ হারাচ্ছেন না মানোলো। তিনি জানেন, কোচিং ক্যারিয়ারে ২৯ বছর কাটানোর পর, সত্যিকারের পথচলাটা সবে শুরু হলো। এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। কিন্তু দীর্ঘ পথের যাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছানোর আনন্দটা যে আকাশছোঁয়া হয়, তা মানোলোর চেয়ে ভালো আর কে জানেন!