আর্জেন্টিনা এগিয়েছে কি না, এমবাপ্পেকে দেখানোর সময় মেসিদের
কিলিয়ান এমবাপ্পে কথাটা বলেছিলেন গত মে মাসে, ব্রাজিলের টিএনটি স্পোর্টসকে। কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালির খেলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এল ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব—দক্ষিণ আমেরিকা না ইউরোপ?
এমবাপ্পে বলেছিলেন, দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ইউরোপের মতো অগ্রসর হতে পারেনি। এ কারণেই গত কয়েকটি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এরপরই এমবাপ্পে মন্তব্য করেছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ পাওয়ার মতো সেরা মানের খেলাটা খেলতে পারেনি।’
তখন এমবাপ্পের ওই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো। আর্জেন্টিনার বর্তমান ও সাবেক খেলোয়াড়েরা তো বটেই, দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশের খেলোয়াড়েরাও এমবাপ্পের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। আবার এমবাপ্পে একদমই যে সমর্থন পাননি তা নয়, কেননা গত চার বিশ্বকাপই নিয়ে গেছে ইউরোপের চার দেশ। এমবাপ্পের সেই অশ্রদ্ধার মন্তব্য এত দিন পরে আবার নতুন করে উঠে এসেছে। কারণ, আর্জেন্টিনা ঠিকই ফাইনালে উঠে গেছে। আর এমবাপ্পেকে খেলতে হবে এই আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধেই। সুতরাং দ্বৈরথ কেবল বিশ্বকাপ জয় এবং গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট নিয়ে এমবাপ্পে-মেসির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; যুদ্ধটা এবার দক্ষিণ আমেরিকা বনাম ইউরোপের মধ্যেও।
দক্ষিণ আমেরিকা বনাম ইউরোপ :
একটা সময় ছিল, বলা হতো ইউরোপের বাইরে বিশ্বকাপ হওয়া মানেই কাপ যাবে দক্ষিণ আমেরিকার ঘরে। সে ধারণাও ভেঙেছে। ২০১৪ সালে খোদ ব্রাজিল থেকেই বিশ্বকাপ নিয়ে গেছে জার্মানি। শেষ চার বিশ্বকাপই ইউরোপের। সব মিলিয়ে মোট ২১টি বিশ্বকাপের মধ্যে ৯ বার চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আমেরিকা, আর ১২ বার ইউরোপ। ২০০২ সালে শেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। এরপর আর্জেন্টিনা একবার ফাইনাল খেলেছে, আর উরুগুয়ে একবার সেমিফাইনাল খেলেছে। সাফল্য এতটুকুই। এবার আর্জেন্টিনার সামনে সুযোগ এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলকে আবার সামনে নিয়ে আসার।
দুই মহাদেশের খেলার ধরনও আলাদা। দক্ষিণ আমেরিকা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আর ইউরোপের কাছে ফুটবল দলীয় খেলা, সুতরাং তারা টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী। ফুটবলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার মতো অর্থের অভাবও ইউরোপের নেই। বড় বড় ক্লাব দক্ষিণ আমেরিকার খেলোয়াড়দের সহজেই চুক্তিবদ্ধ করতে পারছে। ফলে তাদের বড় অংশই আসলে আজীবন ইউরোপেই খেলছে। এতে তাদের খেলার ওপরও ইউরোপের প্রভাব পড়ছে। এতে লাতিন ফুটবলের সৌন্দর্যও কমে যাচ্ছে। ১৯৭৮ সালেও আর্জেন্টিনায় নিয়ম ছিল ২৫ বছরের নিচের কাউকে ইউরোপীয় ক্লাব কিনতে পারবে না। সেই নিয়মও এখন নেই। আবার দক্ষিণ আমেরিকার মাত্র ১০টি দেশ ফুটবল খেলে। খেলার পরিমাণ বাড়াতে তাদের যেতে হয় মেক্সিকো বা যুক্তরাষ্ট্রে।
কিন্তু ইউরোপের ৫৫টি দেশ আছে, যারা নিয়মিত ফুটবল খেলে। ফলে নিজেদের মধ্যেই তাদের প্রচুর ম্যাচ খেলতে হয়। এমবাপ্পের সেই কথার সূত্র ধরে আরও একটি বিষয় তখন চলে এসেছিল। দক্ষিণ আমেরিকাকে যে ধরনের বিরূপ বা প্রতিকূল পরিবেশে খেলতে হয়, ইউরোপকে সে তুলনায় তেমন কষ্টই করতে হয় না। সর্বত্রই প্রায় একই আবহাওয়া। অন্যদিকে বলিভিয়া, ইকুয়েডর বা কলম্বিয়ায় শ্বাস নিতেই তো সমস্যা হয়। লা পাজের মাঠে মাঝেমধ্যেই অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগে! তারপরও সেখানে খেলতে হয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে।
আগেই বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকা ইউরোপের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে ফরোয়ার্ড তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো তুলনা নেই। দক্ষিণ আমেরিকা ‘হিরো’ বা নায়ক পছন্দ করে। ব্রাজিলের পেলে বা আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসি একেকটি আইকনের নাম। তাদের রক্ষাকর্তা মানা হয়। ইউরোপে এমনটি খুব একটা দেখা যায় না। তবে নিঃসন্দেহে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মাঝমাঠ ও রক্ষণে। ইউরোপে ছোটবেলা থেকে টিমওয়ার্ক শেখানো হয়। তারই ফল হচ্ছে মাঝমাঠের গোছালো খেলা। ইউরোপের সাম্প্রতিক সাফল্যের কারণ এই মধ্যমাঠই। সঙ্গে জমাট রক্ষণ। গত দেড় দশকে স্পেন ও জার্মানি রাজত্ব করেছে তাদের মধ্যমাঠের জন্যই। আমরা সবাই জানি, আধুনিক ফুটবলে জয়ের জন্য মধ্যমাঠ দখলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
গত বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের চার দলই ছিল ইউরোপের। এবার মাত্র দুটি। জার্মানি বা স্পেনসহ ইউরোপের দেশগুলো এবার মধ্যমাঠ দখলে নিলেও ফরোয়ার্ডের অভাবে তেমন গোল দিতে পারেনি। জার্মানি পরপর দুবার প্রথম পর্ব পার হতে পারবে না—এটা কিছুদিন আগেও ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এবারই প্রথমবারের মতো আফ্রিকার একটি দল সেমিফাইনাল খেলল। তাহলে কি ইউরোপ আর আগের মতো নেই? এমবাপ্পের কথা কি ভুল? প্রমাণিত হবে আজ রাতেই।
ব্রাজিল কি আসলেই আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিচ্ছে:
দক্ষিণ আমেরিকা-ইউরোপের লড়াইয়ের মধ্যে কেমন একটা সুবাতাস বইছে ব্রাজিলেও। ব্রাজিলের অনেকেই বলছেন, তাঁরা মেসির হাতে কাপ দেখতে চান। নেইমার মেসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবার নেইমারই কেবল একা নন, মেসির হাতে কাপ দেখতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রচুর। মেসির হাতে কাপ মানেই তো বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার। আসলেই কি ব্রাজিল মেসির প্রতি ভালোবাসায় বা দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিচ্ছে?
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফুটবলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনো মধুর ছিল না। যেমন এবারের কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কাপ জয়ের আশা নিয়ে এলেও প্রথম খেলায়ই হেরে যায় সৌদি আরবের কাছে। সেই খেলা শেষ হওয়ার পরপরই টুইটারে ব্রাজিলের পয়লা নম্বর ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয় ছিল আর্জেন্টিনা। ওই দিনের আলোচিত টুইট নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। একটি টুইটে ব্রাজিলের একজন লিখেছেন, ‘তিনটি বিষয় ব্রাজিলকে আনন্দ দেয়—১. বারবিকিউ, ২. ছুটি, ৩. আর্জেন্টিনার কান্না।’ তারপর যতভাবে আর্জেন্টিনা নিয়ে উপহাস করা যায়, লজ্জা দেওয়া যায়, সেদিন সবই করা হয়েছে ব্রাজিল থেকে।
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের দ্বৈরথ আসলে কয়েক শ বছরের পুরোনো, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। পরে এটি ফুটবলযুদ্ধে রূপ নেয়। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুই দেশ কিন্তু একসময় দুই উপনিবেশ ছিল। ব্রাজিল ছিল পর্তুগিজদের দখলে, আর্জেন্টিনা স্প্যানিশদের। ১৫০০ সালে ব্রাজিল আবিষ্কার করেছিলেন পেদ্রু আলভারেজ কাবরাউ নামের একজন পর্তুগিজ অভিযাত্রী। তখন থেকে ১৮০৮ সালে স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত ব্রাজিল ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ। বলা হয়, পেদ্রু আলভারেজ আসলে ভারতের দিতে যাচ্ছিলেন। পথে পেয়ে যান ব্রাজিলকে। এখানে রেডউডগাছ দেখে মনে করেছিলেন, কাঠের ব্যবসাই হবে লাভজনক। পরে অবশ্য সেখানে সোনাও পাওয়া যায়।
এর ঠিক ৩৫ বছর পরে স্প্যানিশরা খুঁজে পায় আর্জেন্টিনা। পেরুতে ইনকা সাম্রাজ্যের সোনা নিয়ে তখন অনেক গল্প। সেই সোনার সন্ধানেই মূলত এসেছিলেন স্প্যানিশরা। এখানে রুপার নদী আছে—এমন কথাও প্রচলিত ছিল। আর্জেন্টিনা কথাটাই এসেছে আর্জেন্টাম থেকে, যার অর্থ রুপা। সেই রুপার নদী অবশ্য কখনোই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর্জেন্টিনা স্পেনের উপনিবেশ ছিল ১৮১৮ সাল পর্যন্ত। ১৮১০ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং সেই যুদ্ধ শেষ হয় ১৮১৮ সালে।
উপনিবেশ থাকতেই আধিপত্য নিয়ে স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। এমনকি স্বাধীন হওয়ার পরেও জায়গার দখল নিয়ে যুদ্ধ করেছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। যুদ্ধ তাদের সম্পর্ক তিক্ত করেছে, সেই তিক্ততা ছড়িয়েছে ফুটবলেও। দুই দল অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে। সেই খেলা নিয়েও ঝামেলা কম হয়নি।
১৯৫০ সালে বিশ্বকাপ হয়েছিল ব্রাজিলে। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সঙ্গে ঝামেলার কারণে আর্জেন্টিনা অংশই নেয়নি। সে ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত হয়েছিল। আবার ১৯৬৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চেয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ভোটাভুটিতে হেরে যায় চিলির কাছে। সেবারও ব্রাজিলের সমর্থন পায়নি আর্জেন্টিনা।
দুই দেশের মধ্যে ফুটবল প্রথম ঢুকেছিল আর্জেন্টিনায়, ১৮৬৭ সালে। ব্রিটিশ রেল কর্মচারীরা সেখানে এই খেলা শুরু করেছিল। ব্রাজিলে ফুটবল খেলা শুরু হয় এরও ২০ বছর পর। সেখানেও ফুটবল নিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরাই। তার পর থেকে দুই দেশেই ফুটবল হচ্ছে তাদের জাতীয় আবেগের নাম। আবার দুই দেশের দ্বৈরথও একই সঙ্গে ইতিহাসেরই অংশ। তবে ইদানীং দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক খানিকটা উষ্ণ, বিশেষ করে গত ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে বলসোনারো হেরে যাওয়ার পর দুলা আবার প্রেসিডেন্ট হলে সবার আগে ব্রাজিলে অভিনন্দন জানাতে হাজির হয়েছিলেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ।
সুতরাং সাম্প্রতিক সুসম্পর্কের প্রভাবে হয়তো তিক্ততা আজ কিছুটা কম প্রকাশ হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এই দ্বৈরথ শেষ হওয়ার নয়।