প্রেসিং, রূপান্তর, বিল্ড–আপ, প্রতি–আক্রমণ এবং ডেড বল—সব মিলিয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনাল হতে পারে কৌশলের রোমাঞ্চকর এক মঞ্চ। যেখানে আক্রমণ, প্রতি–আক্রমণের লড়াইয়ে প্রতি মুহূর্তে বদলে যেতে পারে ম্যাচের রং। একদিকে লিওনেল স্কালোনির অধীন সর্বজয়ী আর্জেন্টিনা যেমন অপ্রতিরোধ্য এক দল, তেমনি নেস্তর লরেনৎসোর কলম্বিয়াও আছে নিজেদের সেরা সময়ে।
ফলে ফাইনালের লড়াইটা যে সমান সমান হয়ে উঠবে, তা বলাই যায়। ম্যাচে মূলত ভাগ্য গড়ে দিতে পারে ছোট ছোট বিষয়গুলোই। ন্যূনতম ভুলের জন্যও দিতে হতে পারে বড় মাশুল। তাই দুই কোচের কৌশলের ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। ফাইনালে এমন পাঁচটি কৌশল ভাগ্য গড়ে দিতে পারে।
দি মারিয়ার অবস্থান
আর্জেন্টিনার ফাইনাল মানেই আনহেল দি মারিয়ার বীরত্ব। কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপ ফাইনালসহ আর্জেন্টিনার শেষ তিনটি ট্রফি জয়ে ফাইনালে বড় ভূমিকা ছিল দি মারিয়ার। তিনটি ফাইনালেই গোল করেছিলেন। বড় ম্যাচ কীভাবে বের করে আনতে হয়, সেটা তাঁর ভালোই জানা। তবে এবার ফাইনালের আগে দি মারিয়াকে নিয়ে কিছু প্রশ্নও আছে। কোপার ফাইনালে আর্জেন্টিনার জার্সিতে নিজের শেষ ম্যাচ খেলতে নামা মারিয়াকে স্কালোনি কীভাবে ব্যবহার করবেন, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আগের ম্যাচের মতো স্কালোনি কি তাঁকে আবারও ডান পাশে খেলাবেন, নাকি পজিশন বদলে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবেন? স্কালোনি সাধারণত প্রতিপক্ষ ও ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে দলের কৌশল ঠিক করেন। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ফাইনালেও একই পথে হাঁটতে পারেন তিনি।
আর্জেন্টিনার জন্য সুখবর হচ্ছে কলম্বিয়ার ডান পাশে দেখা যাবে না কোপা আমেরিকায় দলটির অন্যতম সেরা তারকা দানিয়েল মুনোজকে। তিনি ধারাবাহিকভাবে আক্রমণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দলের হয়ে দুটি গোলও করেছেন। উরুগুয়ের বিপক্ষে লাল কার্ড দেখায় তাঁকে ছাড়াই ফাইনালে খেলতে হবে কলম্বিয়াকে। কোচ নেস্তর লরেনৎসো হয়তো সান্তিয়াগো আরিয়াসকে দিয়েই তাঁর শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করবেন। তিনি আবার মুনোজের কিছুটা বিপরীত।
সাধারণত রক্ষণ আগলে খেলতে দেখা যায় তাঁকে, যা হয়তো আর্জেন্টিনাকে আক্রমণে ওঠার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেবে। আর এ কারণে ফাইনালে পজিশনও বদলে যেতে পারে দি মারিয়ার। অ্যাটাকিং থার্ডে দি মারিয়াকে দিয়ে আরিয়াসের ওপর চাপ প্রয়োগের পথে হাঁটতে পারেন স্কালোনি। যা ওয়ান অন ওয়ানেও বিশেষ সুবিধা দিতে পারে দি মারিয়াকে। এখন স্কালোনি শেষ পর্যন্ত দি মারিয়াকে কোনো কৌশলে খেলান সেটিই দেখার অপেক্ষা।
হামেস রদ্রিগেজকে আটকানো
এখন পর্যন্ত কোপা আমেরিকার সেরা খেলোয়াড় বললে সবার আগে আসবে হামেস রদ্রিগেজের নাম। ফাইনালেও কলম্বিয়ার আক্রমণভাগের মূল ভরসা হিসেবে মাঠে থাকবেন রদ্রিগেজ। আর্জেন্টাইন রক্ষণের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হতে পারেন এই কলম্বিয়ান। ম্যাচের আগে তাঁকে নিয়ে নিশ্চয় আলাদাভাবে ভাববেন স্কালোনি। এ জন্য তিনি চাইলে অবশ্য মার্সেলো বিয়েলসার পথেও হাঁটতে পারেন। সেমিফাইনালে রদ্রিগেজকে থামাতে রদ্রিগো বেনতাঙ্কুরকে ছায়ার মতো লাগিয়ে রেখেছিলেন বিয়েলসা।
চোটে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের কাজটা ঠিকঠাকই করেছিলেন বেনতাঙ্কুর। তবে চোটে পড়ে এই টটেনহাম তারকা মাঠ ছেড়ে যেতেই আবারও জায়গা নিয়ে খেলতে শুরু করেন রদ্রিগেজ। আর্জেন্টিনা অবশ্য সাধারণত ম্যান–মার্কিং কৌশলে খেলে না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠতে পারে এনজো ফার্নান্দেজের অবস্থান। মাঠে রদ্রিগেজের কাছাকাছি জায়গায় থাকবেন এই চেলসি তারকা। নিজের খেলার পাশাপাশি রদ্রিগেজকে তাঁর খেলা খেলতে না দেওয়াও হয়ে ফার্নান্দেজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি। পাশাপাশি রদ্রিগেজ যেন জায়গা বদল করে আক্রমণে যাওয়ার সুযোগ না পান, সেদিকেও চোখ রাখতে হবে আর্জেন্টিনাকে। নয়তো সামান্য সুযোগেও কীভাবে ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে হয়, তা ভালোই জানা আছে রদ্রিগেজের।
কলম্বিয়ার ডেড বল সামলানো
পরিসংখ্যান বলছে কোপা আমেরিকায় ডেডবল পরিস্থিতিতে কলম্বিয়া ভয়ঙ্কর এক দল। ডেডবল বলতে সাধারণত বল যখন খেলায় থাকে না, সে পরিস্থিতিকে বোঝানো হয়। যেমন কর্নার, ফ্রি–কিক, থ্রো–ইন কারণে যখন খেলা থেমে যায়, তখন তাকে ডেডবল পরিস্থিতি বলে। আর এমন পরিস্থিতিতেই মূলত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে কলম্বিয়া। এখন পর্যন্ত তাদের করা ১২ গোলের ৫টিই এসেছে ডেডবল থেকে। মূলত রদ্রিগেজের মতো দুর্দান্ত শুটার এবং ডেভিডসন সানচেজ, কার্লোস কুয়েস্তা ও জেফারসন লেরমার মতো হেডাররাই ডেডবল পরিস্থিতিতে কলম্বিয়ার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন।
এ কারণে ফাইনালের শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবে আর্জেন্টিনাকে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কলম্বিয়া বক্সের আশাপাশে বিনা কারণে ফ্রি–কিক না পায়। এ ছাড়া কর্নারও প্রতিপক্ষকে যত কম দেওয়া যায়, তত ভালো। নয়তো এই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে একটু্ও ছাড় দেবে না নেস্তর লরেনৎসোর দল। পাশাপাশি ফ্রি–কিক বা কর্নারের সময় যেসব খেলোয়াড় বিপজ্জনক হতে পারেন, তাঁদের নিয়েও আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করে রাখতে পারেন স্কালোনি।
মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ
মিডফিল্ড সামলানোর দক্ষতা ছিল আর্জেন্টিনার কাতার বিশ্বকাপে বাজিমাত করার অন্যতম কারণ। মিডফিল্ডাররা প্রতিপক্ষ রক্ষণে চাপ তৈরি মধ্য দিয়েই মূলত আক্রমণের সুরটা তৈরি করে দিতেন। সামগ্রিকভাবে তাঁরা প্রেসিংয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নিতেন এবং আক্রমণে উঠতেন। এবারের কোপা আমেরিকায় অবশ্য আর্জেন্টিনার এমন রূপ কমই দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই মাঝমাঠে দলটিকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। আর্জেন্টিনার সৌভাগ্য, ফাইনালের আগ পর্যন্ত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি তাদের। এরপরও কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডর বেশ চাপে রেখেছিল মেসি–মার্তিনেজদের। তবে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে সেই হারানো সুরটা খুঁজে পেতে হবে। বিশেষ করে বল যখন নিজেদের পায়ে থাকবে না, তখন আরও বেশি সতর্ক হয়ে খেলতে হবে তাদের। নয়তো সামান্য ভুলেও মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়তে হবে বড় বিপদে।
দিয়াজকে থামানোর কৌশল
ফাইনালে দেখা মিলতে পারে দুর্দান্ত একটি ওয়ান অন ওয়ান লড়াইয়ের। যে লড়াইয়ে একদিকে থাকবেন কলম্বিয়ান উইঙ্গার লুইস দিয়াজ এবং অন্য দিকে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন চোট কাটিয়ে ফেরার অপেক্ষায় থাকা গনসালো মন্তিয়েল। কোপা আমেরিকায় দারুণ ছন্দে আছেন দিয়াজ। বল পায়ে উইং ধরে বিশ্বসেরা যেকোনো রক্ষণকে একাই কাঁপিয়ে দিতে পারেন এই লিভারপুল তারকা। সামন্যতম ফাঁকা জায়গাকেও দারুণভাবে কাজে লাগানোর সামর্থ্য আছে তাঁর।
২০২১ সালের কোপা আমেরিকার কথাই ধরা যাক। সেমিফাইনালে আর্জেন্টাইন রক্ষণকে প্রতিনিয়ত হুমকিতে রেখেছিলেন এই উইঙ্গার। একপর্যায়ে আক্রমণ–ঝড় সামাল দিতে না পেরে বিরতির পর নাহুয়েল মলিনাকে তুলে নিতে হয় স্কালোনিকে। তবে মন্তিয়েলও যে খুব সুবিধা করতে পেরেছিলেন, তা নয়। ৬১ মিনিটে ঠিকই আর্জেন্টাইন রক্ষণ ভেঙে গোল আদায় করে নেন দিয়াজ। এবারের ফাইনালেও দিয়াজকে নিয়ে আলাদা করেই পরিকল্পনা সাজিয়ে মাঠে নামতে হবে আর্জেন্টিনাকে।