মেসি–রোনালদোর ‘নৌকা’ ইউরোপের ঘাট ছেড়ে ‘ডাঙা’র পথে
লিওনেল মেসির ঘোষণা শুনেই অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। ধাক্কা সামলে নিতে কেউ কেউ হয়তো একটু সময়ও নিয়েছেন। এ তো দু-এক দিনের কথা না!
ক্লাব ফুটবলে পৃথিবীর সেরা প্রান্তরে দুজনের দ্বৈরথ দেখে বড় হয়েছে একাধিক প্রজন্ম। মেসির ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হলো সে ‘খেলাঘর’। দীর্ঘশ্বাসটা তাই গভীর—শ্বাসটা পড়ে আসার সঙ্গে কারও কারও চোখ হয়তো পেছন ফিরে তাকিয়েছে সেই শুরুর দিনগুলোতে।
কী দিন ছিল! আশি-নব্বইয়ের দশকের প্রজন্ম বড় হয়েছে জিনেদিন জিদান, রোনালদো, রোনালদিনিও, পাওলো মালদিনি, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাদের দেখে। ধীরে ধীরে তাঁদের প্রস্থানের সময়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির আবির্ভাব। এরপর তো ফুটবল দেখার সংস্কৃতিই পাল্টে গেল!
বাংলাদেশের কথাই ধরুন। ডিশ অ্যানটেনা আসার আগপর্যন্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের খবরাখবর জানতে সংবাদপত্রই ছিল সবচেয়ে বড় ভরসা। ডিশের কল্যাণে জিদান-রোনালদোদের টিভিতে দেখা গেল আরও নিয়মিত, একসময় তাঁদেরও সময় ফুরিয়ে এল, এর মধ্যে আবার ইন্টারনেট হয়ে উঠল সহজলভ্য এবং আবির্ভাব ঘটল ফেসবুক-টুইটারের। মেসি-রোনালদোর খবর জানতে চান? ফেসবুক কিংবা টুইটারে গেলেই সব খবর হাতের মুঠোয়! দুই কিংবদন্তির প্রতি সবার এই যে অমোঘ আকর্ষণ, সেটা কি শুধুই তাঁদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের ফসল? সম্ভবত না।
রোনালদো কিংবা মেসি তাঁদের ক্যারিয়ারের শুরু থেকে যদি সৌদি প্রো লিগ কিংবা মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) কাঁড়ি কাঁড়ি গোল করতেন, তাহলে কি এতটা নজর কাড়তে পারতেন? ইউরোপের ক্লাব ফুটবল দুনিয়ার সেরা, সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ—সেখানে দুজন ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলেছেন, এই মৌসুমে রোনালদো সেরা তো পরের মৌসুমে মেসি। ফুটবল–বিশ্ব তাঁদের এভাবে দেখে এসেছে মৌসুমের পর মৌসুম। দুজনের ঝুলিতে মোট ১২টি ব্যালন ডি’অর সে কথাই বলে। ২০০৭ সালে কাকার পর ২০১৮ সালে লুকা মদরিচ ব্যালন ডি’অর জয়ের মাঝে ১১ বছরে ট্রফিটা মেসি-রোনালদোর বাইরে আর কেউ জিততে পারেননি।
ক্লাব ফুটবলের সেরা মহাদেশে মেসি-রোনালদোর এই যে মহাকাব্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তার যবনিকা লেখা হয়ে গেল পরশু মেসির ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর্জেন্টাইন তারকার ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার তাৎপর্যটুকু পরিষ্কার—গত জানুয়ারিতে রোনালদো সৌদি প্রো লিগের দল আল নাসরে যোগ দেওয়ার পরও সম্ভাবনাটা দেখেছিলেন অনেকেই। মেসি হয়তো সৌদিতে গেলে দুজনের দ্বৈরথ আবার দেখা যাবে! কিন্তু তা আর হলো না। খেলার মাঠ ভুলে কখনো কখনো যে নিজের জীবনেও তাকাতে হয়।
ইউরোপে খেললে বার্সা ছাড়া আর কোথাও খেলতেন না মেসি। প্রাণপ্রিয় ক্লাবের ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় সৌদি লিগের দল আল হিলালের বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব এক পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। মেসির পরিবারও সৌদি আরবের জীবনে মানিয়ে নিতে চায়নি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে একটু ফুরফুরে জীবন বেছে নিতে মেসি সাড়া দিয়েছেন ইন্টার মায়ামির ডাকে। এই যে ২০২৩—এই সালটাকে তাই সবাই মনে রাখতে বাধ্য। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়াল মাদ্রিদ ২০০৯ সালে রোনালদোকে লা লিগায় উড়িয়ে আনার পর যে ধ্রুপদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম হয়েছিল, ১৫ বছর পর তার যবনিকা ঘটল মেসির ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
রোনালদো গত জানুয়ারিতে ঠিকানা পাল্টানোর পর ইউরোপে দুই কিংবদন্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধ্যায়টা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সৌদি প্রো লিগে তার নতুন পর্ব শুরুর সম্ভাবনাও জেগেছিল। মেসির যুক্তরাষ্ট্রযাত্রার মধ্য দিয়ে সেটুকু সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেল। রোনালদো এখন আটত্রিশে, মেসি ছত্রিশে—ক্যারিয়ারের শেষ অঙ্কে এসে দুজনে প্রতিযোগিতামূলক ক্লাব ফুটবলে আবার মুখোমুখি হবেন, চরম আশাবাদী মানুষও সম্ভবত এই আশা করবেন না।
সৌদি আরব পৃথিবীর এক প্রান্তে, যুক্তরাষ্ট্র অন্য প্রান্তে—অবসর নামের ডাঙার কাছাকাছি চলে আসার পথে দুজনের ক্যারিয়ারের নৌকা তো বিপরীতমুখী!
২০২৩ সাল শুধু মেসি-রোনালদোর জন্য নয়, করিম বেনজেমা, লুইস সুয়ারেজ, সের্হিও রামোস, সের্হিও বুসকেটস, মার্সেলো, গ্যারেথ বেলদেরও প্রস্থানের বছর। কেউ ইউরোপ ছেড়েছেন, কেউ আবার খেলা। জিদান-রোনালদিনিওদের দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম কিংবা তাঁদের উত্তর প্রজন্ম এসব তারকাক দেখেই শিখেছে দীর্ঘ ক্যারিয়ার ও ধারাবাহিক সাফল্য কাকে বলে। মেসি-রোনালদো অবশ্যই তার রেফারেন্স পয়েন্ট। কিন্তু এখন ইউরোপের ময়দানে সিংহাসনগুলো কেমন যেন খালি খালি লাগছে! চ্যাম্পিয়নস লিগে শীর্ষ চার গোলদাতার মধ্যে তিনজনই তো ইউরোপে নেই—রোনালদো, মেসি ও বেনজেমা।
বার্সার মূল দলে লিওনেল মেসির অভিষেক ২০০৪ সালে। অর্থাৎ ১৯ বছর পর ইউরোপের ক্রীড়াঙ্গন ছাড়বেন মেসি। রোনালদোর স্পোর্টিং লিসবনে অভিষেক ২০০২ সালে। পর্তুগিজ তারকা ২১ বছর পর ছেড়েছেন ইউরোপ। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে দুজনের পরিসংখ্যানটা একবার জেনে নেওয়া যাক—মেসি সেখানে ১ গোল ব্যবধানে এগিয়ে!
ইউরোপে বার্সা ও পিএসজিতে খেলেছেন মেসি—এ দুটি ক্লাব ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা দলগুলোর অন্তর্ভুক্ত। রোনালদো খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসে। শীর্ষ পাঁচ লিগের আওতাভুক্ত এসব ক্লাবের পরিসংখ্যান বিচারে ৫১,০৬৯ মিনিট মাঠে ছিলেন রোনালদো। ৬২৬ ম্যাচে করেছেন ৪৯৫ গোল। মেসি মাঠে ছিলেন ৪৭,০৩৯ মিনিট। ৫৭৫ ম্যাচে করেছেন ৪৯৬ গোল।
গোল করানোয়ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলেছেন মেসি। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি করিয়েছেন ২৪৭ গোল। ১৫১ গোল করিয়েছেন রোনালদো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টা কি কাকতাল? মেসি ইউরোপ ছাড়ছেন সেখানে রোনালদোর চেয়ে ১ গোল বেশি করে, গত ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেও তো তাঁকে রাখা হচ্ছে রোনালদোর এক ধাপ উঁচুতে।
কিন্তু একসময় বিষয়টি এমন ছিল না। ২০০৯ থেকে ২০১৮—স্মরণ করে দেখুন, বার্সেলোনার হয়ে মেসি আর রিয়ালের হয়ে রোনালদো ছিলেন অনেকটা ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। অন্য তারকারা থাকলেও লিগ কিংবা ‘এল ক্ল্যাসিকো’ নিজ নিজ দলকে মূলত এ দুজনই টেনেছেন। সেই ৯ বছরে মেসির বার্সেলোনা ৬ বার জিতেছে লা লিগা।
রোনালদোর রিয়াল চারবার জিতেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। অর্থাৎ মেসির দাপট ছিল ঘরে, রোনালদোর ইউরোপে। কখনো কখনো মঞ্চটা ঘুরেও গেছে। রোনালদো ২০১৮ সালে রিয়াল ছাড়ার পর সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যতি পড়েছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগ ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে আর দুজনের দেখা হয়নি। এবার তো দুজনেরই ইউরোপ ছাড়া সম্পন্ন হওয়ার পথে। পড়ে রইলেন শুধু লুকা মদরিচ। ব্যালন ডি’অর জিতে এখনো খেলছেন—এমন ফুটবলারদের মধ্যে মদরিচই খেলছেন ইউরোপে।
সেই ইউরোপ, যেখানে মেসি-রোনালদোর মোট গোলসংখ্যা ১৪০৫। সেই ইউরোপ—যেখানে দুজনে মিলে লম্বা সময় পালা বদল করে শাসন করেছেন, তা এখন অতীত হয়ে গেছে। রোনালদো তো আগেই ছেড়ে গিয়েছেন, এবার গেলেন মেসিও। তাতে ইউরোপিয়ান ফুটবলের গৌরবের আভাও যেন পুরোপুরি ম্লান হয়ে গেল। হ্যাঁ, কেউ কেউ এসে হয়তো শূন্যস্থান পূরণ করবেন। কিন্তু তাঁরা তো আর মেসি-রোনালদো হবেন না। মেসি-রোনালদো আর কেউ হতেও পারবেন না।