ফুটবল ম্যাচে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কোনটি?
একেকজনের পছন্দ একেক রকম। তবে ফিফা এই প্রশ্নের উত্তরে জানিয়ে দেবে, ২০১৬ সালেই তো রায় দেওয়া হয়েছে। ফিফার মতে, ‘ফুটবলে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য’ বাইসাইকেল কিক। অনেকে এই কিককে ‘ওভারহেড কিক’ কিংবা ‘সিজর্স কিক’ও বলে থাকেন।
শটটি নেওয়ার সময় দেখতে সাইকেলের প্যাডেল মারার মতো (উল্টোভাবে) লাগে, কাঁচি চালানোর সঙ্গেও এই শটের মিল আছে। ঠিক কে, কবে প্রথম এই শট নেন—তার সঠিক হদিস ইতিহাসে নেই। তবে কিংবদন্তি বলে, চিলি ও পেরুর শ্রমিকেরা ফুটবল খেলার সময় এই শট প্রথম আবিষ্কার করেন।
সেটি উনিশ শতকের শুরুতে। পরে ব্রাজিলের লিওনিদাস ও পেলে এই শট আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। এরপর তো কতজনই এই শটে গোল করলেন! আধুনিক ফুটবলে এনজো ফ্রান্সেসকোলি, রোনালদিনিও, ওয়েন রুনি, ইব্রাহিমোভিচ, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, গ্যারেথ বেল...এই শটে চোখধাঁধানো গোল করেছেন। আর বাইসাইকেল কিকে কেউ গোল করলে আলোচনার ঝড় ওঠেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিওনেল মেসিকে নিয়েও এখন ঠিক তা–ই হচ্ছে।
লিগ ‘আঁ’–র নতুন মৌসুমে কাল রাতে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিল পিএসজি। ম্যাচটা ছিল ক্লেরমোঁর মাঠে। শেষ বাঁশি বাজার সময়ও স্বাগতিক দলটির সমর্থকেরা ‘মেসি! মেসি!’ স্লোগানে গলা ফাটান। অথচ পিএসজির জয়ের ব্যবধান ৫–০। কারণটা এতক্ষণে সবারই জানা।
অসাধারণ পাসে নেইমারকে দিয়ে গোল করিয়েছেন মেসি। নিজে করেছেন জোড়া গোল। এর মধ্যে শেষ গোলটি বাইসাইকেল কিকে। আর সেই বাইসাইকেল কিকটাও একটু আলাদা। সতীর্থের পাস মেসির বুকে এসে পড়েনি, উল্টো আর্জেন্টাইন তারকাই সামনে দৌড়ে বলের নিচে গিয়ে বুক দিয়ে রিসিভ করে শটটি নেন। হইচই পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু মেসির ইনস্টাগ্রাম পোস্ট দেখে কারও কারও অস্বাভাবিক লাগতে পারে। বাইসাইকেল কিকসহ দুর্দান্ত খেলে জয়ের পর পিএসজি তারকা নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে দুটি ছবি পোস্ট করেন। না, বাইসাইকেল কিক ও অবিশ্বাস্য সেই পাসের ছবি নয়। নেইমার ও মারকিনিওসের সঙ্গে উদ্যাপন এবং ক্লেরমোঁর এক ডিফেন্ডারসহ বল নিয়ে দৌড়ানোর ছবি পোস্ট করেন মেসি। ক্যাপশন? সেটাও ছবি দুটোর চেয়েও সাধারণ, ‘লিগে প্রথম ম্যাচ, প্রথম জয়!’ যেন, এই তথ্য কেউ জানে না!
মেসির স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জো বরাবরের মতোই সেখানে আগুনের কয়েকটি ‘ইমো’ বসিয়ে মন্তব্য করেছেন। জাতীয় দলে তাঁর সাবেক সতীর্থ সের্হিও আগুয়েরো লিখেছেন ‘ভালো পা’—এই পা মোটেও মেসির পা নয়, বাবা কিংবা কাউকে সম্মান জানিয়ে বাইরে এভাবে ডাকা হয়। তবে অ্যাডিডাস ফুটবলের মন্তব্যটা মেসির সঙ্গে মিলে যায়, ‘নতুন মৌসুম, নতুন বুট, একই লিও।’
হ্যাঁ, অন্তত মানুষ লিও–র কোনো বদল হয়নি। খেলারও যে হয়নি সেটাও ম্যাচ শেষে বলেছেন পিএসজি কোচ ক্রিস্তোফ গালতিয়ের, ‘ এটাই লিও। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আমরা জানি সে কী করতে পারে।’
এমন পারফরম্যান্সের পর অন্য কোনো তারকা হলে অন্তত বাইসাইকেল কিকে করা গোলটার ভিডিও কিংবা ছবি পোস্ট করতেন। কিন্তু মেসি যেন ওই ঘরানার মানুষই নন, রোজারিওর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পারানা নদীর স্রোতের মতোই শান্ত, নিস্তরঙ্গ, নির্বিকার।
তাই বলে সংবাদমাধ্যম তো আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে না! পরিসংখ্যান ঘেঁটে বের করা হয়েছে, ক্যারিয়ারে এই প্রথম বাইসাইকেল কিকে গোল করলেন মেসি।
আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ জানিয়েছে একটু অন্যভাবে—মেসির ক্যারিয়ারে এটাই প্রথম ‘চিলিয়ান গোল।’ প্রশ্ন হলো এই ‘চিলিয়ান গোল’—জিনিসটা কী? স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, এটা বাইসাইকেল কিকের অপর নাম। সঠিক, তবে এই নামকরণের ইতিহাসটা জেনে রাখায় অন্তত ক্ষতি নেই।
উরুগুয়ের কিংবদন্তি লেখক এদুয়ার্দো গালেনা তাঁর ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বইয়ে একটি তথ্য জানিয়েছেন। তাঁর বই থেকেই উদ্ধৃতিটা দেওয়া যায়, ‘চিলির বন্দর তালকাহুনোতে এই মুভটা আবিষ্কার করেন রামন উনজাগা। শরীর (গোলপোস্টের উল্টোমুখ করে) বাতাসে ভাসিয়ে এমনভাবে শট নেন, পা দুটো যেন কেঁচির দুটি ব্লেড।’
উনজাগা কবে প্রথম এই শট নেন, তার সঠিক দিন–তারিখ জানাননি গালেনো। তবে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত এ চিলিয়ান ফুটবলার ১৯১৬ ও ১৯২০ কোপা আমেরিকায় এই শট নেওয়ার পর আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম বাইসাইকেল কিকের নাম দেয়, ‘লা চিলেনা’—অর্থাৎ চিলিয়ান গোল! তবে উনজাগার আগেও এই শট নেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন পেরুর ঐতিহাসিক হোর্হে বাজাদ্রে। পেরুর কাল্লাও বন্দরের এক আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ‘চালাচো’ (কাল্লাওয়ের স্থানীয়দের এই নামে ডাকা হয়) ১৮৯২ সালের আগেই এই শট নিয়েছিলেন। সে যা–ই হোক, মেসির কথায় ফেরা যাক।
‘ক্লারিন’ জানিয়েছে, মেসির ক্যারিয়ারে শুধু অলিম্পিক গোল করাই বাকি—কর্নার থেকে সরাসরি গোল করা আরকি। বাঁ পায়ে, ডান পায়ে, মাথা দিয়ে, বুক দিয়ে এমনকি হাত দিয়েও গোল করেছেন!
২০০৮ সালে লা লিগায় এস্পানিওলের বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল করে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’–এর স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিলেন মেসি। খেলার ধরন বিচারে মেসিকে এমনিতেও ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করা হয়। কাল রাতে ক্লেরমোঁর বিপক্ষেও কিন্তু ম্যারাডোনার স্মৃতি ফিরিয়েছেন মেসি।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪। কোপা ইতালিয়ায় পেসকারা–নাপোলি ম্যাচ। নাপোলির ৩–০ গোলের জয়ে শেষ গোলটি ছিল ম্যারাডোনার। হ্যাঁ, বাইসাইকেল কিক!