২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘ওয়েলকাম টু দ্য জঙ্গল’—ফুটবলে তিফো সংস্কৃতির প্রভাব যেমন

লেগিয়া ওয়ারশর এই তিফো নিয়ে চলছে বেশ আলোচনাছবি: টুইটার

‘কখনো কোনো শূন্য মাঠে গিয়ে দেখেছ? একবার গিয়ে দেখো, শূন্য মাঠের চেয়ে বড় শূন্যতা আর কিছুই হয় না। দর্শকদের বিরহে খাঁ খাঁ করা স্টেডিয়ামের চেয়ে বিষণ্ন আর কিছুই যে নেই। ওয়েম্বলিতে যাও, এখনো শুনতে পাবে ’৬৬–এর বিশ্বজয়ী ইংলিশদের উৎসবের প্রতিধ্বনি। যদি আরও মনোযোগ দিয়ে শোনো, ’৫৩–তে হাঙ্গেরির কাছে তাদের হারের দীর্ঘশ্বাসটুকুও বাদ যাবে না। মন্টিভিডিওর সেন্তেনারিও এখনো উরুগুয়ের সোনালি দিনের সন্তানদের জন্য নস্টালজিয়ায় ভোগে। কান পেতে শোনো, ’৫০–এর ব্রাজিলের পরাজয়ের কান্না এখনো মারাকানার পরিবেশকে ভারী করে রেখেছে’— উরুগুয়ের বিখ্যাত লেখক এদোয়ার্দো গালিয়ানো ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’র স্টেডিয়াম অংশে গ্যালারির উন্মাদনা বোঝাতে বলেছিলেন ওপরের কথাগুলো।

ফুটবল ম্যাচ মানেই তো উন্মাতাল গ্যালারি, আর তার সঙ্গে মিশে থাকা হাসি-কান্নার নানা গল্প। সেই গল্পগুলো প্রকাশের সামষ্টিক ধরনকেই মূলত বলা হয় তিফো। বিশালাকারের ব্যানার, মোজাইক বা সমর্থকদের একসঙ্গে করা কোরিওগ্রাফগুলোকেই বলা হয় তিফো। এর মধ্য দিয়ে একটা দলের সমর্থকেরা নিজেদের দলকে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেন। ‘তিফো’ শব্দটা মূলত ইতালিয়ান ভাষা থেকে এসেছে, যা মূলত টাইফাস জ্বরকে বোঝায়। ১৯৩৫ সালে এ জ্বর ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় ঘোরের মধ্যে প্রলাপ বকতে থাকেন কিংবা আবেগে ফেটে পড়েন। ফুটবলে গ্যালারির আবহও তেমন ঘোর তৈরি করে বলেই এ নামের এভাবে জড়িয়ে যাওয়া।

আরও পড়ুন

এই তিফোগুলো একেবারে শিকড়হীন কোনো উন্মাদনা নয়। একটা অঞ্চল ও ক্লাবের সংস্কৃতি, তাদের অভ্যাস, প্রথা, রাজনীতি ও জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। আরেকটু বিশেষায়িত করলে ব্যাপারটা এমন, কোনো দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী যখন নিজেদের একটি সামষ্টিক পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তখন তারা তিফোর আশ্রয় নেন। ১৯৬০ সালের পর এ সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী গ্যালারিগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে এটি হয়ে উঠে সমর্থকদের আত্মপরিচয়ের প্রতীকও। আর বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।

মাঠে গতিময়তার কারণে ফুটবল তুমুল জনপ্রিয় হলেও বর্ণিল গ্যালারি সেই রোমাঞ্চকে নিয়ে যায় অন্য এক উচ্চতায়। ২০০৮ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গোল করার সময় নয়, উপস্থিত দর্শকদের হার্ট রেট বেশি পাওয়া গেছে যখন তারা মাঠে এসে নিজেদের আসনে বসে তখন। এ সময়ই মূলত সমর্থকেরা ক্লাবের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা ও নিবেদনকে নানাভাবে সামনে নিয়ে আসেন। আর এর প্রকাশের ভঙ্গি হিসেবে তারা তিফো ব্যবহার করেন। তিফোর অনুপ্রেরণা নানা জায়গা থেকে আসতে পারে। খেলোয়াড়, ক্লাবের ঐতিহ্য, ডার্বির উত্তাপগুলোও এখানে বড় ভূমিকা রাখে।

সম্প্রতি মিলান ডার্বিতে দেখা গেছে এই তিফোটির
ছবি: এএফপি

আর এটা একমুহূর্তের সিদ্ধান্তে হয়, এমন কিন্তু নয়। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করে এবং প্রস্তুতি নিয়ে এসব করা হয়। তবে ঘরোয়া লিগের খেলার চেয়ে ইউরোপিয়ান মঞ্চে এ উন্মাদনা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মর্যাদাও। নিজেদের প্রকাশভঙ্গি প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো করতে মরিয়া হয়ে থাকেন সমর্থকেরা। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চান, মাঠে যাঁরা খেলছেন, তাঁরাই শুধু নন, আমরাও আছি এ লড়াইয়ে। ফুটবলে এ আবেগ বরাবরই অমূল্য। এটা যে সব সময় সমর্থকেরা নিজেদের উদ্যোগে করেন, এমনও নয়। অনেক সময় বড় ম্যাচের আগে কোচ ও খেলোয়াড়েরা সমর্থকদের কাছ থেকে এমন কিছু আহ্বান করেন। এ কারণে সমর্থকদের বলাও হয় দ্বাদশ খেলোয়াড়।

তিফো নিয়ে ওপরের কথাগুলো বলার কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এই তিফো দেখা গেছে উয়েফা কনফারেন্স লিগে লেগিয়া ওয়ারশ ও অ্যাস্টন ভিলার ম্যাচে। সেই ম্যাচে ওয়ারশর পোলিশ আর্মি স্টেডিয়ামে লেগিয়ার ‘আল্ট্রাস’ সমর্থকেরা যে তিফোটি নিয়ে এসেছেন, সেখানে ছিল একটি গরিলার ছবি এবং তার নিচে আলাদাভাবে লেখা ছিল—‘জঙ্গলে স্বাগতম’। এমন ছবি ও লেখা নিজ দলকে যতটা আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তেমনি প্রতিপক্ষের শিড়দাঁড়ায় বয়ে দিতে পারে আতঙ্কও। গত পরশুও হয়েছে তা–ই। অখ্যাত লেগিয়ার বিপক্ষে হেরেই গেছে প্রিমিয়ার লিগের পরিচিত দল অ্যাস্টন ভিলা, যে ক্লাবে খেলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজের মতো বিশ্বকাপজয়ী তারকাও।

তবে তিফো দিয়েই ‘শত্রুবধ’ হয়েছে, এটা সরাসরি বলা না গেলেও এর প্রভাব যে ব্যাপক ছিল, তা বলাই যায়। আগেই বলা হয়েছে, এটা শুধু নিজের দলকে সমর্থনের প্রতীকই নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে সমর্থকেরা বুঝিয়ে দেন যে আমরা দলের পেছনেই আছি। অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। বাজারদর থেকে বাজির দর—সব বিবেচনাতেই এ ম্যাচে ফেবারিট ছিল ভিলা পার্কের ক্লাবটিই। এমনকি ম্যাচের আগে লেগিয়ার এক কর্মকর্তা স্বীকার করে নেয় যে শুধু খেলা দিয়ে অ্যাস্টন ভিলাকে হারানো সম্ভব নয়।

এ ম্যাচের আগে লেগিয়ার কোচ কোস্টা রানজিক এ লড়াইকে তুলনা করেছিলেন ডেভিড ও গোলিয়াথের পৌরাণিক লড়াইয়ের সঙ্গে, যেখানে ডেভিড ছিল একজন ১৭ বছর বয়সী এক রাখাল এবং গোলিয়াথ ছিল বিশালাকার এক দানব। কিন্তু সেই দানব গোলিয়াথকে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে দেয় ডেভিড। এখানেও হয়েছে তা–ই। তবে ডেভিড এ যাত্রায় সঙ্গে পেয়েছে ২৭ হাজার সমর্থককে, যাঁরা মাঠের বাইরে বসে ডেভিডের পক্ষ নিয়ে লড়েছে গোলিয়াথের সঙ্গে। এ ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন মূলত ২৭ হাজার সমর্থকই। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, হয়তো সেই গরিলার ছবি ও ‘ওয়েলকাম টু দ্য জঙ্গল’ লেখাটির কথা বলতে হয়। ইংল্যান্ড থেকে পোল্যান্ডে খেলা দেখতে যাওয়া এক ভিলা সমর্থক বলেছেন, ‘ঘরের দর্শকেরা (লেগিয়া সমর্থকেরা) যে আবহ তৈরি করেছে, তা আমার দেখা সেরা।’

আরও পড়ুন

এর আগে তিফো নিয়ে বেশ কিছু সমর্থক গোষ্ঠী আলোচনায় এসেছেন। এসি মিলানের সমর্থকদের দেখা গেছে ইতালিয়ান ভাষায় ‘দ্য ডেভিল’ লেখা তিফো প্রদর্শন করতে, যা মূলত ক্লাবটির মাসকট। আবার বার্সেলোনার সমর্থকেরা অনেক সময় ক্যাম্প ন্যুকে পরিণত করে ক্যানভাসে। বিশেষ করে এল ক্ল্যাসিকোর মতো বড় ম্যাচগুলোর সময়। অনেক সময় সেগুলো রাজনৈতিক স্লোগানের আকারেও সামনে আসে। বিশেষ করে স্বাধীন কাতালুনিয়া নিয়ে আন্দোলন যখন তীব্র হচ্ছিল, তখন ক্যাম্প ন্যুতে প্রচুর রাজনৈতিক ব্যানারের দেখাও মিলেছিল।

বার্সার ম্যাচে করা তিফো
ছবি: টুইটার

একইভাবে রাজনৈতিক স্লোগানসংবলিত তিফো নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় সেল্টিককেও। তিফো দিয়ে গ্যালারি রাঙিয়ে তোলায় বিখ্যাত বরুসিয়া ডর্টমুন্ডও। ডর্টমুন্ডের ম্যাচে সিগন্যাল ইদুনা পার্ককে প্রায়ই হলদে পাখির রং ধারণ করতে দেখা যায়। সমর্থকদের উন্মাদনার কথা বললে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই লিভারপুলের সমর্থকদেরও। অ্যানফিল্ডের পরিবেশের কাছে হার মেনে অনেক শক্তিশালী দলকে এখানে আত্মসমর্পণ করতে দেখা গেছে। অবশ্য শুধু এই ক্লাবগুলোর সমর্থকেরাই নন, কমবেশি প্রায় সব ক্লাবের সমর্থকেরাই ধারক-বাহক হয়ে তিফো সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এই সংস্কৃতিকে কখনো ফুটবল থেকে আলাদাও হয়তো করা যাবে না বা দূরে রাখা যাবে না। কারণ, তিফো ফুটবলের বাহ্যিক কোনো অলংকার নয়, বরং এটি মিশে আছে খেলাটির অস্তিত্বের সঙ্গেই।