গার্দিওলাকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলা অ্যাস্টন ভিলার বদলে যাওয়ার গল্প

দারুণ গতিতে ছুটছে অ্যাস্টন ভিলাএক্স

গত বছরের অক্টোবরে বিষণ্নতায় ছেয়ে গিয়েছিল ভিলা পার্কের চারপাশ। ১২ ম্যাচে ১২ পয়েন্ট নিয়ে অবনমন অঞ্চলের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল অ্যাস্টন ভিলা। স্টিভেন জেরার্ডের অধীনে ধুঁকতে থাকা দলটি তখন পরিত্রাণের পথ খুঁজছিল। শেষ পর্যন্ত দলের খারাপ খেলার দায় যার ওপর সবার আগে বর্তায়, সেই কোচকেই হতে হলো বলির পাঁঠা। ছাঁটাই হলেন জেরার্ড। লিভারপুল কিংবদন্তির বদলে এলেন স্প্যানিশ কোচ উনাই এমেরি।

এমেরির ভিলা পার্কে আসা নিয়ে কানাঘুষা কম ছিল না। আগেরবার প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের দায়িত্ব নিয়ে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। এবারও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কি না, সে আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু সকালের সূর্যটা এবার ইতিবাচক বার্তাই নিয়ে এল। নিজের প্রথম ম্যাচেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দেয় অ্যাস্টন ভিলা। সেই ম্যাচ থেকে পরের এক বছর স্বপ্নের মতোই কেটেছে ক্লাবটির।

আরও পড়ুন

ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর এমেরির অধীনে খেলা ৪০ ম্যাচে অ্যাস্টন ভিলা অর্জন করেছে ৮১ পয়েন্ট। গত প্রায় ১৩ মাসে ভিলার চেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়েছে কেবল তিনটি দল—ম্যানচেস্টার সিটি (৯০), আর্সেনাল (৮৯) ও লিভারপুল (৮৫)। আর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য তারা রেখেছে গত সপ্তাহে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ম্যাচে। সেদিন ভিলার কাছে সিটি শুধু হারেইনি; বরং লজ্জাকর কিছু পরিসংখ্যানের মুখে পড়তে হয়েছিল পেপ গার্দিওলার দলকে।

সেদিন একাধিক পরিসংখ্যানে সিটিকে নতুন অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছিল এমেরির দল। সেই ম্যাচেই সিটির অ্যাটাকিং থার্ডে ১৩ বার বলের দখল জিতেছে ভিলা। গার্দিওলার অধীনে এর আগে এমন ঘটনা দেখতে হয়নি সিটিকে। অ্যাস্টন ভিলা সেদিন সিটির চেয়ে ২০টি শট বেশি নিয়েছে (ভিলা ২২, সিটি ২), যা কিনা গার্দিওলার বিপক্ষেই কখনো ঘটেনি।

হলান্ডকে যেভাবে আটকে রাখে অ্যাস্টন ভিলা
টুইটার

এটি গত মৌসুমে ট্রেবল জেতা গার্দিওলাকে এতটাই অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে যে তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘আমাকে আবার প্রমাণ করতে হবে যে আমি ভালো কোচ।’ বেশ অদ্ভুতই বটে! কদিন আগেও যে দলটিকে মনে হচ্ছিল অজেয়। যাদের বিপক্ষে ম্যাচ জেতা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি, সেই সিটিকেই রীতিমতো নতুন করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল অ্যাস্টন ভিলা। এমনকি আজ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শীর্ষে থাকা আর্সেনালকেও চমকে দিতে পারে তারা।

প্রশ্ন হচ্ছে গত এক বছরে কী এমন হলো যে অবনমনের শঙ্কায় থাকা দলটি আমূল বদলে গেল?

অ্যাস্টন ভিলার এমন বদলে যাওয়ার জন্য মাঠের খেলা, পরিকল্পনা ও খেলোয়াড়দের নিবেদনসহ নানা কারণের কথা বলা যায়। কিন্তু এসবকে সরিয়ে রাখলে দলটিকে বদলে দিয়েছে মূলত একটি মানুষের দেখা স্বপ্ন। গত অক্টোবরেই এমেরি বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন, সব সময়।’ হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখা ছাড়া এভাবে তলানি থেকে একটি দল ওপরে উঠে আসতে পারে না। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে অবশ্য কেউ চাইলে করতে পারে, করেছেও। কিন্তু অ্যাস্টন ভিলার এই উত্থানের পেছনে ছিল না অর্থের কোনো ঝনঝনানি।

আরও পড়ুন

মূলত স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার ফলেই দলটি আজ এই অবস্থানে উঠে এসেছে। যেখানে ঘরের মাঠে টানা ১৪ ম্যাচে জিতেছে তারা। সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগে ১৫ ম্যাচের মধ্যে ভিলার জয় ১০ ম্যাচে, যা কিনা ১৯৮০-৮১ মৌসুমের পর সর্বোচ্চ। সেবার অবশ্য ভিলা লিগ শিরোপাও ঘরে তুলেছিল। এবার হয়তো এখনই তাদের শিরোপা জেতার কথা কেউ বলছে না; বরং সেরা চারে থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সম্ভাবনা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এমন ছন্দে এগিয়ে গেলে তারা শিরোপাও জিততে পারে। ১৫ ম্যাচ শেষে শীর্ষে থাকা দলটির চেয়ে মাত্র ৪ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে তারা। আর্সেনালের ৩৬ পয়েন্টের বিপরীতে তিনে থাকা অ্যাস্টন ভিলার পয়েন্ট ৩২।

এটা সত্যি যে প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জেতার লড়াই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে। যেখানে ম্যান সিটি, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালরা জানে সেটি কীভাবে জিততে হয়। কীভাবে ব্যর্থতা ভুলে ফিরে আসতে হয় তা–ও জানা আছে তাদের। তাই শেষ পর্যন্ত দৌড়ে টিকে থাকা ভিলার জন্য চ্যালেঞ্জিংই বটে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা যা অর্জন করেছে, তা–ও কম নয়। ১৫ ম্যাচ শেষে ইউনাইটেড, চেলসি, নিউক্যাসল, ব্রাইটন, টটেনহাম এবং সর্বোপরি ম্যান সিটির চেয়েও এগিয়ে থাকা নিশ্চিতভাবে অনেক বড় অর্জন। বিশেষ করে যেভাবে দলটিকে এমেরি খেলাচ্ছেন, তা দারুণ রোমাঞ্চকর।

এই তো মাত্র চার বছর আগে অ্যাস্টন ভিলা ছিল চ্যাম্পিয়নশিপের দল। এমনকি মাত্র পাঁচ বছর আগে হুমকির মুখে ছিল ক্লাবটির অস্তিত্ব। ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন পাউন্ড ট্যাক্স দিতে না পারার সঙ্গে আরও বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত ছিল ক্লাবটি। তবে ২০১৯ সালে আবার প্রিমিয়ার লিগে জায়গা করে নিয়ে কোনোভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখে তাদের। তবে পরের দুই মৌসুমেও করতে হয়েছে টিকে থাকার সংগ্রাম। ২০১৯-২০ মৌসুমে শেষ দিনের নাটকীয়তায় অল্পের জন্য ঠেকে যায় অবনমন। পরের মৌসুমে অবস্থান ছিল ১১ নম্বরে। এরপর সংগ্রাম করতে হয়েছে ২০২১-২২ মৌসুমে। আর গত মৌসুমেও একপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল অবনমনের দুয়ারে। সেখান থেকে কিংবদন্তি জেরার্ডের জায়গায় দায়িত্ব নিয়ে অ্যাস্টন ভিলাকে উদ্ধার করেন এমেরি। অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে অ্যাস্টন ভিলা মৌসুম শেষ করে ৭ নম্বরে। খেলার সুযোগ পায় ইউরোপা কনফারেন্স লিগেও।

দায়িত্ব নিয়ে এমেরিকে প্রথমে যা করতে হয়েছিল, তা হলো জেরার্ডের করে যাওয়া বেশ কিছু ভুল শোধরাতে হয়েছিল। জেরার্ডের বেশ কিছু সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিলেন সমর্থকেরা। যার একটি ছিল চোটে পড়া টাইরন মিংগসের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া, যা কিনা অনেকের কাছেই কঠোর সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল। দলে এসে এমেরিকে সেসব ভুল সিদ্ধান্ত শোধরানোর পাশাপাশি নিজের পথরেখাও ঠিক করতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন

ইউরোপা লিগের পোস্টার ম্যান এমেরিও (ইউরোপিয়ান এই প্রতিযোগিতায় চারবার ফাইনাল খেলে তাঁর দল শিরোপা জিতেছে তিনবার) নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের অতীত অভিজ্ঞতাকে ধুয়েমুছে ফেলতে। তবে ট্রফি ক্যাবিনেটের দিকে না তাকালে আর্সেনালকে যেভাবে এমেরি খেলিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি ব্যর্থ বলারও সুযোগ নেই। তাঁর অধীনে ২২ ম্যাচ অপরাজিত ছিল আর্সেনাল। যদিও শেষ পর্যন্ত ৭ ম্যাচ জয়হীন থেকে চাকরি হারাতে হয়েছিল তাঁকে। পাশাপাশি আরেকটি কৃতিত্ব তাঁকে দিতে হবে। বুকায়ো সাকা, গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি, এবং এদিয়ে এনকেতিয়াহর মতো তারকারা কিন্তু এমেরির অধীনেই এমিরেটসের ক্লাবটিতে এসেছিলেন। যদিও এসব নিয়ে কথা হয় সামান্যই।

অবশ্য সামগ্রিকভাবে অনেকের ধারণা, কোচিং ক্যারিয়ারে প্রায় ২০ বছর কাটানোর পরও এমেরিকে নিয়ে যতটা কথা হওয়ার কথা, ততটা হয় না। এর কারণ মূলত তাঁর কৌশলকে অনুবাধন করা কিছুটা জটিল। শীর্ষ কোচদের কৌশলকে যেভাবে ফর্মুলার মধ্যে ফেলে ব্যাখ্যা করা যায়, এমেরিকে সেভাবে বোঝা যায় না। এমেরি যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন। তাঁর দলকে খেলানোর ধরনেও এই মানসিকতা স্পষ্ট। গত এক বছরে অ্যাস্টন ভিলার পারফরম্যান্সের দিকে তাকালেও কিছুটা হয়তো বিষয়টা বোঝা যাবে। ম্যাচ অনুযায়ী নিজের কৌশল ঠিক করে দলকে মাঠে নামান এই কোচ। গত আগস্টে তাঁর কৌশল নিয়ে দলের রাইট ব্যাক ম্যাটি ক্যাশ বলেছেন, ‘কোচ ম্যাচের আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন। কারণ, কোচ যা বলেন, ম্যাচে সেসবই ঘটে। তিনি এটা সব সময় করেন—তিনি অবিশ্বাস্য।’

অ্যাস্টন ভিলার বদলে যাওয়ার নায়ক এমেরি
রয়টার্স

এমেরির ম্যাচ পরিকল্পনা ও কৌশল এতটাই অনিশ্চয়তায় ঘেরা যে বিশ্লেষকদেরও অনেক সময় খাবি খেতে দেখা যায়। প্রিমিয়ার লিগে অ্যাস্টন ভিলার খেলার ধরন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে নিজেদের গ্রাফে মাঝামাঝিতে জায়গা দিয়েছিল ফুটবলভিত্তিক পরিসংখ্যানভিত্তিক পোর্টাল অপটা। এরা যেন রহস্যময়, লুকানো ও অনির্ণেয় একটি দল। আর এমন দল যখন নিজেদের সেরা ছন্দে থাকে, তখন অন্যদের কী দশা হয়, তা তো দেখায় যাচ্ছে। সিটির মতো ইতিহাস সেরা দলকেও এখন ভিলার বিপক্ষে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন এই রহস্য মৌসুমের বাকি সময়েও ধরে রাখতে পারলে নতুন একটি রূপকথার গল্প লেখা অ্যাস্টন ভিলার জন্য একেবারেই অসম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ফল যা–ই হোক, ভিলার হাতেই এখন ফুটবলে বড়-ছোটর সংজ্ঞা মুছে দেওয়া দলগুলোর পতাকা। এ মৌসুমে যে তালিকায় আছে জিরোনা, নিস এবং বায়ার লেভারকুসেনও। এই দলগুলোও স্বপ্ন দেখছে বড় কিছুর। তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়া ফুটবলের জন্যই অনেক বড় অর্জনের ব্যাপার হবে। ফুটবলের যে এলিট ঘরানা এবং অর্থের ঝনঝনানি আগে থেকে জাঁকিয়ে বসে আছে, সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে এর চেয়ে ভালো জবাব আর কীই–বা হতে পারে!