সাবেক ফ্যাসিস্ট শাসকের পুতির গোল, সমর্থকদের ফ্যাসিস্ট উদ্যাপন
তাঁর শাসনামলকে আধুনিক ফ্যাসিবাদের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল, সেখানে তাঁর নাম এবং তাঁর দল ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির কথাই উঠে আসে সবার আগে। এতক্ষণে বুঝে ফেলার কথা লোকটির নাম বেনিতো মুসোলিনি। ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির প্রধানমন্ত্রী। দুই বছর পর ২৮ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই মুসোলিনিরই এক বংশধর খেলছেন ইতালিয়ান ফুটবলে। নামটা রোমানো ফ্লোরিয়ানি মুসোলিনি হলেও দেশটির সংবাদমাধ্যমে ২১ বছর বয়সী মুসোলিনি জুনিয়র নামে পরিচিত।
মুসোলিনি জুনিয়রের পরিচয়টা আরও ভালোভাবে দেওয়া যাক। তাঁর মা আলেসান্দ্রা মুসোলিনি ইতালিয়ান পার্লামেন্ট ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, গায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল ও টিভি ব্যক্তিত্বও ৬১ বছর বয়সী আলেসান্দ্রা। আলেসান্দ্রার বাবা প্রয়াত রোমানো মুসোলিনি জ্যাজ পিয়ানিস্ট, চিত্রকর ও সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। আরেকটি পরিচয় হলো রোমানো ফ্যাসিস্ট শাসক বেনিতো মুসোলিনির চতুর্থ সন্তান এবং সর্বকনিষ্ঠ ছেলে।
মুসোলিনি জুনিয়র কিংবা রোমানো ফ্লোরিয়ানির প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বংশের ধারা অনুযায়ী মুসোলিনি জুনিয়র হলেন রোমানো মুসোলিনির নাতি এবং বেনিতো মুসোলিনির ‘গ্রেট-গ্র্যান্ডসন’ বা প্রপৌত্র, কথ্য ভাষায় কোথাও কোথাও ‘পুতি’ বলেও সম্বোধন করা হয়। ইতালির কিংবদন্তি অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন সম্পর্কে আবার দূর–সম্পর্কের দাদিও হন। প্রশ্ন হলো, হুট করে রোমানো ফ্লোরিয়ানি মুসোলিনি এবং তাঁর বংশপরিচয়টি আবারও মনে করিয়ে দেওয়া কেন?
কারণ, গতকাল রাতে ইতালিয়ান ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর সিরি ‘বি’তে গোল করে দলকে জিতিয়েছেন মুসোলিনি জুনিয়র। নেপলসে সেসেনার বিপক্ষে স্বাগতিক হয়ে জুভ স্তাবিয়ার ১-০ গোলের জয়ে ২১ মিনিটে করা গোলটি এই রাইটব্যাকের। লাৎসিও থেকে এ বছর জুলাইয়ে ধারে জুভ স্তাবিয়ায় যোগ দেওয়া মুসোলিনি জুনিয়রের পেশাদার ফুটবলে এটাই প্রথম গোল। তবে ‘মুসোলিনি’ নামে রোমান যে মোটেও স্বস্তিবোধ করেন না, সেটি বোঝা গেল গোলের পরই। গোলটি উদ্যাপনে স্টেডিয়ামের মাইকে ‘রোমানো’ নামটি যতবারই বলা হয়েছে, সমর্থকেরা এর প্রতিক্রিয়ায় ততবারই ‘মুসোলিনি’ বলেছেন।
শুধু তা–ই নয়, সমর্থকেরা দাঁড়িয়ে সামনে ডান হাত বাড়িয়ে ‘রোমান স্যালুট’ দিয়েছেন, যেটা সাধারণত ডানপন্থীদের ‘ফ্যাসিস্ট স্যালুট’ নামেও পরিচিত। যদিও জুভ স্তাবিয়ার সমর্থকেরা রাজনৈতিকভাবে বামপন্থী সমর্থক হিসেবে সাধারণভাবে পরিচিত। তবে রোমানো সমর্থকদের উদ্যাপনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। সমর্থকেরা যেন ‘মুসোলিনি’ শব্দটি উচ্চারণ না করেন, সে জন্য ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ থাকার ইঙ্গিত করেছেন।
ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যম গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত জানিয়েছে, বেনিতো মুসোলিনির নাতনি আলেসান্দ্রা ম্যাচটি রোমিও মেন্তি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দেখেছেন। গোল উদ্যাপনের সময় তাঁর উলে বোনা সবুজ হ্যাট হারিয়ে গেলেও সেটি পরে পাওয়া গেছে।
ম্যাচ শেষে রোমানো সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমার প্রপিতামহ বেনিতো মুসোলিনি ইতালিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু এটা ২০২৪ সাল এবং পৃথিবীও পাল্টে গেছে। তবে ধ্যানধারণা তো সব সময় থাকবেই। কিন্তু আমার কাজের (ফুটবল খেলা) সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটা দিয়ে আমাকে মূল্যায়নও করা যাবে না।’ রোমানো এরপর আরও বলেছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। যদি আমার ডাকনাম নিয়ে কারও পূর্বধারণাসূচক ধ্যানধারণা থাকে এবং তাদের যদি চুপ করাতে হয়, তবে সেটা আমি করব।’
রোমার বয়সভিত্তিক দলে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু রোমানোর। ২০১৬ সালে ১৩ বছর বয়সী রোমানোকে ছেড়ে দেয় রোমা। সে বছরই লাৎসিও তাঁকে বয়সভিত্তিক প্রকল্পে টেনে নেয়। দুই বছর পর ২০১৮ সালে অপেশাদার ক্লাব ভিগর পেরকেন্তিতে ধারেও পাঠানো হয়েছিল তাঁকে।
লাৎসিওতে ফেরার পর ক্লাবটির অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৮ ও অনূর্ধ্ব-১৯ বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন রোমানো। ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর লাৎসিওর মূল দলে ডাকও পান। রোমের ক্লাবটির উগ্রবাদী সমর্থক (আল্ট্রাস) ‘ইরিদুসিবিলি’র নব্য-ফ্যাসিজমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল—এ কারণে রোমানোও খুব দ্রুত সংবাদমাধ্যমের নজরে পড়েন। তবে সে সময় গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোমানো বলেছিলেন, রাজনীতি নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই এবং মা–বাবার দেওয়া পদবিই ধরে রাখতে চান।
লাৎসিও মূল দলের হয়ে রোমানো একটি ম্যাচও খেলার সুযোগ পাননি। গত বছর তাঁকে পেসকারাতেও ধারে পাঠানো হয়েছিল। এরপর এখন ধারে খেলছেন জুভ স্তাবিয়ায়। লাৎসিওতে থাকতে চার বছর আগে রোমানো একবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘লাৎসিওতে আমাকে শুধু খেলা দিয়েই বিচার করা হয়, পদবি দিয়ে নয়।’