মেসি–পিএসজির দুই বছরের সম্পর্কে পাওয়া না–পাওয়ার গল্প
‘বেলা হোক, ছিন্ন করে যেও/ সকল সম্পর্ক!’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনের মতো লিওনেল মেসি-পিএসজির সম্পর্ক শেষের বেলাটা এসেছিল গত পরশু রাতে। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটল প্রায় ৫ মাস ধরে চলতে থাকা এক নাটকেরও। অবশ্য সব ভালো কিছুই নাকি কখনো না কখনো শেষ হতে হয়। তবে মেসির পিএসজি যাত্রা কি আসলেই ভালো কিছু ছিল কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। অঙ্ক কষে হিসাব মেলানোটা কঠিনই। কিন্তু মেসিকে যখন বিদায় বেলায়ও দুয়ো শুনতে হলো, তখন এ অধ্যায়টাকে ‘ভালো’ বলে রায় দেওয়ার সুযোগ কই! তবু দুই বছরের যাত্রার পুরোটা তো আর ভুল হতে পারে না। দুই পক্ষেরই কিছু প্রাপ্তি ও আক্ষেপ নিয়েই সময়টা কেটেছে। বলা বাহুল্য, প্রাপ্তির চেয়ে আক্ষেপের পাল্লাটা ছিল বেশি ভারী।
২০২১ সালের আগস্টে মেসি যখন পিএসজিতে যোগ দিতে লা বুর্জে বিমানবন্দরে নামেন, তখন তাঁর টি-শার্টে ফরাসি ভাষায় যা লেখা ছিল তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘এটাই প্যারিস’। কিন্তু তখন পর্যন্ত প্যারিস তো মেসির কাছে একটা শহর মাত্র। যেখানে হয়তো তিনি মাঝেমধ্যে ঘুরতে যেতেন। ওহ, ব্যালন ডি’অরের ট্রফির জন্যও তাঁকে একাধিকবার প্যারিস যেতে হয়েছিল। তাই প্যারিস নিয়ে একধরনের সুখকর অনুভূতি হয়তো তাঁর মনে ছিল।
কিন্তু পরশু সেই ভালো লাগার রেশটুকু নিয়ে মেসি যে প্যারিস ছাড়তে পেরেছেন, তা বলার সুযোগ নেই। বরং প্যারিসে দুই বছর ধরে যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, তাতে পরশু রাতের পর মেসির বরং হাঁপ ছেড়ে বাঁচার কথা। বার্সেলোনায় সমর্থকেরা যেখানে মেসিকে চোখের মণি করে রাখতেন, পিএসজিতে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। প্রায় পুরোটা সময় পিএসজি সমর্থকদের চক্ষুশূল ছিলেন মেসি। প্রায় নিয়মিতই শুনতে হয়েছে দুয়ো। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে পিএসজির বিদায়ের পর দুয়োর ঘটনা আরও বেড়েছে। যা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে মেসির ‘অনুমতি’ ছাড়া সৌদি আরব ভ্রমণের পর। সমর্থকদের কাছ থেকে এমন আচরণ কি মেসির আসলেই প্রাপ্য ছিল?
পিএসজিতে প্রথম মৌসুমে ব্যর্থতার পর নতুন মৌসুমের শুরুটা দারুণভাবে করেছিলেন মেসি। মনে হচ্ছিল, পিএসজিতে মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে ত্রয়ীর হাত ধরে দারুণ কোনো সাফল্য ধরা দেবে। সে সময় পিএসজিতে মেসির নতুন চুক্তি সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপের পর বদলে যায় পুরো চিত্র। বেতন ও চুক্তির মেয়াদ নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় নতুন করে চুক্তি বাড়ানোর পথ থেকে সরে আসেন মেসি। এরপর নানা ধরনের গুঞ্জন শোনা গেলেও ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতা আর জোড়া লাগেনি। উল্টো মেসির সৌদি ভ্রমণের পর তাঁকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে প্যারিসের ক্লাবটি। সে সময় পিএসজি সমর্থকেরা মেসিকে ‘ভাড়াটে’ কটূক্তি করেন। শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়ে মেসিকে এই বিতর্কের ইতি টানতে হয়। আর যার শেষ পরিণতি হলো বিদায়ে।
প্যারিসে মেসির শুরুটা অবশ্য ছিল ভিন্ন আমেজে। অর্থনৈতিক বোঝা কমাতে আঁতুড়ঘর বার্সেলোনা যখন মেসির জন্য দরজা বন্ধ করে দেয়, তখন প্যারিসের ক্লাবটিই কাছে টেনে নিয়েছিল মেসিকে। যেখানে আগে থেকেই ছিলেন নেইমার ও এমবাপ্পে। কিন্তু তিন এই মহাতারকা মিলেও ঘটাতে পারেননি বড় কোনো বিস্ফোরণ। বিশেষ করে ট্রফিকে যদি সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে চুক্তিটাকে ব্যর্থ বলেই মনে হবে। পিএসজির হয়ে দুটি লিগ শিরোপা এবং একটি ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছেন মেসি। তবে সাদা চোখে যেমনটা মনে হয়, সব সময় তা সত্য হয় না। মেসি ও পিএসজির চুক্তির সমীকরণের অঙ্কটাও তেমনই।
নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের আগমুহূর্তে অনেকটা আকস্মিকভাবে মেসিকে না করে দিয়েছিল বার্সেলোনা। ম্যানচেস্টার সিটির মতো ক্লাবও সে সময় মেসিকে কেনার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তখন ইউরোপে মেসির জন্য পিএসজি ছাড়া আর কোনো ক্লাবের দরজা আক্ষরিক অর্থে খোলা ছিল না। সে সময় মেসি যদি পিএসজিতে যেতে না পারতেন, তবে তাঁর ইউরোপে টিকে থাকা বেশ কঠিন হতো। কারণ, মেসিকে একই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত বেতন ও চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার মতো ক্লাব ছিল না।
পিএসজির এভাবে এগিয়ে আসা বিশ্বকাপের আগের বছরে মেসিকে দারুণ স্বস্তিও এনে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য দারুণ একটি প্ল্যাটফর্মও পান মেসি, যা ইউরোপের বাইরে গেলে মেসি আদৌ পারতেন কি না, সে শঙ্কা থেকেই যায়। পাশাপাশি মেসিকে এনে পিএসজি যে খুব ভুল করেছে, তা-ও কিন্তু নয়। হ্যাঁ, চ্যাম্পিয়নস লিগে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মেলেনি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু বিবেচনায় মেসি পিএসজিকে যা দিয়েছেন, তার গুরুত্বও এতটুকু কম নয়। এ ছাড়া পিএসজির মালিকানা প্রতিষ্ঠান কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্টসও মেসির বিশ্বকাপ সাফল্যকে দারুণভাবে ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে মেসি আসার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিএসজির জনপ্রিয়তা রকেট গতিতে বেড়েছে। মেসির চুক্তির এক মাসের মধ্যে ক্লাবটির টুইটার অ্যাকাউন্টে অনুসারীর সংখ্যা বেড়েছে ৮ লাখ, যা পরবর্তী সময়েও একই গতি ধরে রাখে। ২০২১ সালের জুলাই মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে টুইটারে পিএসজির অনুসারীর সংখ্যা বেড়েছে ৫০ লাখের মতো।
একইভাবে পিএসজির টিকটক অ্যাকাউন্টের ৪ কোটি অনুসারীর পেছনেও ব্যাপকভাবে অবদান আছে মেসির। ইনস্টাগ্রামেও পিএসজির অনুসারী সংখ্যা ৪৬ কোটি পেরোনোর পেছনে বিশেষ অবদান আছে মেসির নিজস্ব ব্র্যান্ড ভ্যালুর। এ বছরের শুরুতে ক্লাবের অবস্থা নিয়ে এক বক্তৃতায় স্টাফদের পিএসজি সভাপতি নাসের আল খেলাইফি বলেছিলেন, ‘মাঠের বাইরে আমরা সব দিক থেকেই উন্নতি করছি।’ মাঠের বাইরের এই উন্নতির অনেকটাই যে মেসির কারণে, তা নিশ্চয়ই স্পষ্ট করে না বললেও চলে।
এটা সত্যি যে মেসি যখন পিএসজিতে আসেন, তখন তিনি নিজের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। বার্সার সোনালি সময়ের প্রতাপশালী মেসির দাপট তখন অনেকটাই কমে এসেছে। শুরুতে মানিয়ে নিতেও তাঁর বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ক্যাম্প ন্যুর বাইরে যিনি নিজেকে কখনো ভাবতে পারেননি তাঁর জন্য বিষয়টা স্বাভাবিকই ছিল। তারকা ঠাসা পিএসজিতে মেসি তাই বহিরাগত হয়েই ছিলেন। প্রথম মৌসুমে ৩৪ ম্যাচে ১১ গোলের পাশাপাশি ১৫টি অ্যাসিস্ট করেন মেসি। তাঁর নামের সঙ্গে এই পরিসংখ্যান খানিকটা বেমানানই বটে। শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও মানিয়ে নিতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে মেসিকে। বিশেষ করে প্যারিসের পরিবেশে তাঁর পরিবারকেও মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
দ্বিতীয় মৌসুমে শুরুটা ভালো করেও পরে তা আর ধরে রাখতে পারেননি মেসি। এ মৌসুমে ৪১ ম্যাচে ২১ গোল এবং ২০টি অ্যাসিস্ট করেছেন মেসি। এই মৌসুমটা আসলে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বিশ্বকাপের আগে ও পরে। বিশ্বকাপের পর ১৮ ম্যাচ খেলে মেসি ৯ গোল এবং ৬টি অ্যাসিস্ট করেন, যা বিশ্বকাপের আগে ছিল ১৩ ম্যাচে ৭ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট।
ব্যক্তিগত এই পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় ব্যর্থতা ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকে পিএসজির বিদায়। বায়ার্নের কাছে হেরে পিএসজির সেই বিদায় মেসির জন্য প্যারিসে থাকাকে আরও কঠিন করে তোলে। দলীয় ব্যর্থতার দায় অনেকটা এককভাবে চাপানো হয় মেসির ঘাড়ে। সমর্থকেরাও ম্যাচের পর ম্যাচে দুয়ো দিয়ে মেসির জন্য পরিস্থিতিকে অনেক কঠিন করে তোলেন।
এসবের বাইরে বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনা দলকে জাগিয়ে তোলা নেতা মেসিকেও পিএসজির জার্সিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সদ্য শেষ মৌসুমে নেইমার-এমবাপ্পের বিরোধ যখন পিএসজিকে রীতিমতো কোণঠাসা করে রেখেছিল, তখন মেসি অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। অনেকের ধারণা সে সময় মেসি যদি এগিয়ে এসে বিরোধ মেটানোর দায়িত্ব নিতেন, তবে নেইমার-এমবাপ্পের দ্বন্দ্ব এতটা তীব্র রূপ ধারণ করত না, যা দল হিসেবেও পিএসজিকে মাঠের খেলায় মনোযোগ দিতে সাহায্য করতে পারত।
শেষ পর্যস্ত বাস্তবতা হচ্ছে মেসি ও পিএসজির সম্পর্ক পরশু রাতে অতীত হয়েছে। গল্পের শেষটা হয়তো আরও সুন্দরভাবে হতে পারত। সুন্দর না হওয়ার এই দায় এককভাবে যেমন মেসির নয়, তেমনি পিএসজিও এ জন্য পুরোপুরি দায়ী নয়। সময়, সুযোগ এবং পরিস্থিতিও এর পেছনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু পেছনের ঘটনা যা-ই হোক, দিন শেষে মেসি-পিএসজি অধ্যায়টা সাধারণ সমর্থকদের কাছে একটি ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান হয়েই থাকবে।