ইন্টার মায়ামির মেসি তাহলে আর আলাদা কোথায়
প্রথমেই ছোট্ট পরিসংখ্যান। লিওনেল মেসির অভিষেকের আগে নিজেদের সর্বশেষ ১৩ ম্যাচে ইন্টার মায়ামির পারফরম্যান্স— ২ জয়, ৩ ড্র ও ৮ হার। মেসির অভিষেকের পর টানা ৩ ম্যাচেই জয়। মেসির সমর্থকেরা বলতে পারেন—হ্যাঁ, এটাই সায়েন্স!
কথাটা আসলে মজা করে বলা। বিজ্ঞান না হোক, পার্থক্যটা যে মেসি, তা না বললেও চলে। আর সবার মোটামুটি জানাই, মেসির জন্য এমন পারফরম্যান্স ডাল–ভাত। এমনকি সেটা এই ৩৬ বছর বয়সেও। ক্লাব ফুটবলে মোটামুটি যা যা জেতা সম্ভব সব জিতেছেন, দেশের হয়ে জিতেছেন সবচেয়ে বড় দুটো শিরোপা—বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকা। গত ডিসেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসির মধ্যে কেমন যেন বৈরাগ্যও চলে এসেছে। জীবনটা এখন তাঁর জন্য শুধুই উপভোগের। নইলে গোলের প্রতি বৈরাগ্য আসবে কেন! কেন–ই–বা পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেবেন!
মানে বলা হচ্ছে আজকের ম্যাচের কথা। অরল্যান্ডোর সিটির বিপক্ষে মায়ামির ৩–১ জয়ে জোড়া গোল করেছেন, আরেকটি গোল করলেই হ্যাটট্রিক হয়ে যায়। পেনাল্টি পাওয়ায় সেই সুযোগও ছিল। কিন্তু মেসি সুযোগটা নেননি। যেন বোঝাতে চাইলেন, অনেক হয়েছে, অনেক পেয়েছি, আর কত! এখন সতীর্থরা করুক, আমি দেখি।
মোটামুটি সবারই জানা, বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা মেসি শুধুই উপভোগ করতে চান। আর্জেন্টাইন তারকা নিজেই বলেছেন সে কথা, চাপহীন ফুটবল খেলতে চান। সেজন্যই যোগ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে। কিন্তু মেসির মাঠের খেলায় কি দেখা যাচ্ছে? মেসিকে চেনেন না, এমন কেউ থেকে থাকলে পরিসংখ্যানে তাকিয়ে বলতে পারেন, আর্জেন্টাইন তারকা মিথ্যা বলেছেন!
কিসের নির্ভার থেকে উপভোগ, পারফরম্যান্স তো আগের মতোই—৩ ম্যাচে ৫ গোল। সতীর্থকে দিয়ে করিয়েছেন আরও এক গোল। এর মধ্যে ফ্রি কিক থেকে চোখ ধাঁধানো গোলও আছে। আর মাঠে বল পায়ে ভ্রমরের মতো এঁকে–বেঁকে ছুটে বেড়ানো, সতীর্থদের সাহায্য করা এমনকি মেজাজও হারাচ্ছেন মেসি। হ্যাঁ, মেসিই!
অরল্যান্ডোর বিপক্ষে আজ এমএলএসে প্রথম হলুদ কার্ড দেখেছেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে ফেলে দিয়ে। কাঁধে কাঁধে টক্করে মাঠেই ফেলে দিয়েছেন অরল্যান্ডোর আরও এক খেলোয়াড়কে। মাঠেও চোখ রাঙিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ম্যাচ শেষে টানেল দিয়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথেও তেড়ে গিয়েছিলেন একজনের প্রতি। তো, এসব দেখে কি মনে হয় মেসির খেলায় বয়সের ঢিলেমি ভর করেছে? মোটেই না।
আসলে ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। চাপহীন, নির্ভার ফুটবল মানে কিন্তু ‘পিকনিক ফুটবল’ নয়। আজ একটু অনুশীলন করবেন তো কাল ছুটে যাবেন মায়ামির সৈকতে, বিরতি দিয়ে ম্যাচ খেলবেন কিংবা অনুশীলনে আসবেন দেরি করে, কারণ রাতে নৈশ–ব্যস্ততা ছিল—এসব মেসির ফুরফুরে মেজাজের ফুটবল নয়। মেসি ইউরোপিয়ান ফুটবলের ‘প্রেশার কুকার’ থেকে বের হয়ে ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নটা একটু কম চাপ নিয়ে শেষ করতে চেয়েছেন। সেটাই হচ্ছে।
এমএলসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইউরোপের রণক্ষেত্রের মতো নয় যে, এক ম্যাচ হারলেই ‘গেল গেল’ রব উঠবে। মেসি সেই ‘গেল গেল’–এর দুনিয়ায় সব পরীক্ষায় পাশ করেই গোধুলিলগ্নের নমনীয়তাটুকু অর্জন করে নিয়েছেন। আর তাই শেষটাও লিখছেন নিজের মতো করে ফুরফুরে মেজাজে। কে না জানে, বয়স যাই হোক, জাত খেলোয়াড়েরা মাঠে নামলেই ভেতরের খেলাটা বেরিয়ে আসে। মেসির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। সমর্থকেরা তাই মজা করে বলতেই পারেন, মেসি মিথ্যা বলেছেন!
আসলে মেসির এই ‘মিথ্যা’ই তাঁর সমর্থকদের কাছে সবচেয়ে কাক্ষিত সত্যি।
সেটি কি তাঁর কোচের কাছেও নয়? জেরার্দো মার্তিনো ইন্টার মায়ামির কোচ হওয়ার আগে মেসিকে দেখেছেন। বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে মেসিকে খুব কাছ থেকে দেখা আছে তাঁর। মেসির সময়টা দেখেছেন বলেই অরল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর মার্তিনো এভাবে বলতে পারলেন, ‘তার জন্য ৩ ম্যাচে ৫ গোল করা ঠিকই আছে। অন্য কারও পক্ষে কি এটা করা সম্ভব? অবশ্যই না। সে–ই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’
ডিআরভি পিএনকে স্টেডিয়ামে আজ মেসিদের ম্যাচ শুরুর আগে ছোট্ট একটা টর্নেডো সৃষ্টি হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, টর্নেডোটি পাক খেয়ে লেজ বাগিয়ে নিচে নেমে আসছে। ছিল বজ্রপাতসহ বৃষ্টিও। মার্তিনোর ‘বিশ্বসেরা ফুটবলার’কে একটু দেখতে তাহলে প্রকৃতিও সামিল হয়েছিল। আর কে না জানে, অতিমানবীয় যেকোনো কিছুর সঙ্গেই প্রকৃতির একটা যোগসূত্র থাকেই।