ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না–হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।
জার্মানির মাটিতে ৩২ বছর পর, অখণ্ড জার্মানিতে প্রথম। বলা হচ্ছে ২০০৬ বিশ্বকাপের কথা। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানরা উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতা টের পেয়ে তা নিয়ে সচেতন ছিল, তবুও জাতীয় দলের পতাকা নিয়ে দর্শকেরা বাড়াবাড়ি করবেন কি না, এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ ছিল সেই সময়কার দুনিয়ার আর সবকিছুর মতোই। আর জার্মানরা সেপ ব্ল্যাটারের লোকদের ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল—এর সপক্ষে পরিষ্কার প্রমাণ না পেলেও অনেকেরই এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ ছিল না।
এই যে প্রতিটি বিশ্বকাপের গল্প বলার আগে আমরা সেই সময়কার ইতিহাসটা বুঝতে চাইছি, কার্ল মার্ক্স যে বলেছিলেন, মানুষ কেবল তাঁর সময়ের একটি উপাদানমাত্র, সেগুলোর যথার্থতা দেয় সেই বিশ্বকাপ।
ষড়যন্ত্র, উসকানি, উত্তেজনা, চরম অসহনশীলতার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ হয়ে থাকে বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষ হওয়ার অল্প একটু আগের মুহূর্ত। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান উত্তেজিত হয়ে বুনো ষাঁড়ের মতো ঢুস মারেন ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জিকে। খেলা ছাপিয়ে সেই দৃশ্যটাই হয়ে ওঠে বহু বছরের জন্য আলোচনার খোরাক। জিদান দোষী, নাকি জিদানকে মা–বোন তুলে গালি দিয়ে উত্ত্যক্ত করেছিলেন মাতেরাজ্জি—এ নিয়ে গোটা দুনিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
সেই অস্থির বিশ্বকাপে সবাই যেন উত্তেজিত ছিল। মোট ৩৪৫টা হলুদ কার্ড আর ২৮টি লাল কার্ড দেখানো হয় গোটা বিশ্বকাপে। পর্তুগাল আর নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে রুশ রেফারি ভালেন্তিন ইভানভ দেখান ১৬টি হলুদ কার্ড আর ৪টি লাল কার্ড। অবশ্য বিখ্যাত সাংবাদিক ব্রায়ান গ্লেনভিলের মতে কার্ড কমই দেখানো হয়েছিল। কারণ, জিদানের মতো পর্তুগালের ফিগো ঢুস দিয়েও লাল কার্ড থেকে বেঁচে যান। লাল কার্ড থেকে বেঁচে যান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বাজেভাবে ফাউল করা ডাচ রাইট–ব্যাক খালিদ বুলারুজও। আরেক মারামারির আয়োজনে ইংল্যান্ডের রেফারি গ্রাহাম পোল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলায় ক্রোয়েশিয়ার জোসিপ সিমুনিচকে তিনবার হলুদ কার্ডে দেখান।
অবশ্য পোলের এই ভুল এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আমাদের ভিন্ন এক জগতের সন্ধান দেয়—‘রেফারিরাও মানুষ’ আর খেলোয়াড়দের মতো তাঁদেরও কী ভীষণ চাপে থাকতে হয়! পোল ছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা রেফারি। গুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলোতে তিনি দায়িত্ব পেতেন। তবে সেদিন তিনি অদ্ভুত এক ভুল করেন। সিমুনিচের নামটা অস্ট্রেলীয়দের মতো হওয়ায় তিনি ভুলে অস্ট্রেলিয়ার ৩ নম্বর জার্সির নাম লিপিবদ্ধ করেন তাঁর হলুদ কার্ডের তালিকায়। ম্যাচের পর ভুল বুঝতে পেরে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর আর জীবনে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেননি। সংবাদমাধ্যেমে তিনি জানান, ফিফার কাছে তিনি আবেদন করেছেন তাঁকে অব্যাহতি দিতে।
কার্ডের ছড়াছড়ি হলেও গোলের বেলায় ব্যাপারটা ছিলো উল্টো। বিশ্বকাপ এলেই জ্বলে ওঠা জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা মাত্র ৫ গোল দিয়েই সেরা গোলদাতা হন। এত কম গোল দিয়ে ১৯৬২ সালের পর কেউ আর সেরা গোলদাতা হয়নি।
২০০৬ বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থ টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ফেবারিট এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। রোনালদিনিও বিশ্বকাপের আগে দুর্দান্ত ছন্দে ছিলেন। কিন্তু জার্মানির রঙ্গশালায় ছিলেন বড্ড ম্লান। আদ্রিয়ানো, কাকা বা রবিনিওরাও সুবিধা করতে পারেননি টুর্নামেন্টে। রোনালদো তো ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। অবশ্য গ্রুপ পর্যায়ে তিনটি ম্যাচেই জিতে তারা পরের রাউন্ডে যায়।
সেখানে ঘানার সঙ্গে ৩-০ গোলে জেতে কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল। শেষ আটে তাদের থামিয়ে দেয় ফ্রান্স, আরও স্পষ্ট করে বললে জিদান। যদিও স্কোরবোর্ড দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কারণ, ব্রাজিল হারে থিয়েরি অঁরির একমাত্র গোলে, কিন্তু সে ম্যাচে জিদান দারুণ কিছু ঝলক দেখালেন। কিছু ড্রিবল, কিছু বডি ডজ আর কিছু রক্ষণচেরা পাস—এত বছর পরও নিশ্চিতভাবেই সেদিনের ম্যাচ যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মনে থাকার কথা।
আর্জেন্টিনাকে ফেবারিটের তকমা না দিলেও হোসে পেকেরমানের অধীনে দলটা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে যায় এবং মেক্সিকোকে ২-১ গোলে হারায়। কিন্তু জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। বার্লিনের সেই ম্যাচে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষে দুই দলের মধ্যে হাতাহাতি হয়। আর্জেন্টিনার লিয়ান্দ্রে কুরফ্রে, যিনি সেই খেলায় মাঠেই নামেননি, তিনি জার্মানির পার মার্টেসেকারকে লাথি দেওয়ায় লাল কার্ড পান। ম্যারাডোনা-উত্তর আর্জেন্টিনার আরও একটা বিশ্বকাপ শেষ হয় হতাশায়।
একই রকমভাবে হতাশায় শেষ হয় বিশ্বকাপের আগে সদা উত্তেজিত থাকা ইংলিশ মিডিয়ার উচ্ছ্বাস। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইংল্যান্ড দ্বিতীয় রাউন্ডে হারায় ইকুয়েডরকে, কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে দলের সেরা খেলোয়াড় ওয়েন রুনি ৬২ মিনিটের মাথায় লাল কার্ড দেখেন। এরপর ১০ জন নিয়েই ইংলিশরা পর্তুগালকে আটকে দেয় ১২০ মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু, ওই যে ’৯০–এ ক্যামেরুনকে দুই পেনাল্টিতে হারানোর পর টাইব্রেকারের অভিশাপ, তা আবার ছোবল মারে ইংলিশদের। পেনাল্টি মিস করেন ল্যাম্পার্ড, জেরার্ড আর ক্যারাগার।
পর্তুগালের তথাকথিত সোনালি প্রজন্ম এবার অনেকটা দূর গিয়েও বড় কাপ জেতার স্বপ্ন পূরণে আবারও ব্যর্থ হয়। বছর দুয়েক আগে নিজের দেশে আয়োজিত ইউরোর ফাইনালে গ্রিসের কাছে হারা পর্তুগিজরা সেমিফাইনালে হারে জিদানের একমাত্র গোলে।
জার্মানরা ইতালির কাছে ১১৯ আর ১২১ মিনিটে দুই গোল খেয়ে সেমিফাইনালে হারে। ডাচরা পর্তুগালের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে ১-০ গোলে হারে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচেই। স্প্যানিশরা বড় স্বপ্ন দেখলেও জিদানের আরও একটা জাদুতে তারা ৩-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। জিদানের যোগ্য সঙ্গ দেন ২৩-বছর বয়সী ফ্রাঙ্ক রিবেরি।
জুলাইয়ের ৯ তারিখে বার্লিনের ফাইনালে সব বড় ঘটনাতেই ছিলেন মাতেরাজ্জি। খেলার পাঁচ মিনিটে অঁরির একটা লম্বা পাস ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন মাতেরাজ্জি আর ফ্লোরেন্স মালুদাকে ফাউল করলে রেফারি পেনাল্টির বাশি বাজান। জিদান এগিয়ে দেন ফ্রান্সকে। মাতেরাজ্জির একটি হেড থেকে ফরাসিরা আরেকটু হলেই আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসেছিল। তবে এই মাতেরাজ্জিই ১৯ মিনিটে আন্দ্রেয়া পিরলোর কর্নারে দারুন এক হেডে খেলায় সমতা ফেরান। আবার এই মাতেরাজ্জিই টাইব্রেকারে গুরুত্বপূর্ণ গোল দেন।
তবে মাতেরাজ্জির জয়ের পরেও দেশে ফিরে জিদান বীরের সম্মান পান। প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক যখন এই বীরকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন, ক্ষণিকের তরে জিদান মাথা নিচু করায় কেউ কেউ হয়তো আঁতকে উঠেছিল। এই রে! আবার ঢুস দিচ্ছে নাকি!