ফিফা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২০১৮ আর ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন-স্বত্ব একই সঙ্গে দেওয়া হবে। আর বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষত পশ্চিমা মিডিয়াকে হতবাক করে দিয়ে বিডে জিতে যায় যথাক্রমে রাশিয়া ও কাতার।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া এফবিআই বিশাল জাল ফেলে এবং ফিফার এক্সিকিউটিভ কমিটির বেশির ভাগ সদস্যকে অভিযুক্ত করে। সেপ ব্ল্যাটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও তিনি পদত্যাগ করেন। ফিফার সবচেয়ে প্রভাবশালীদের অনেকেই নিষিদ্ধ হন।
তবে এটাও ঠিক, ফুটবল বিশ্বকাপ তত দিনে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসরে পরিণত হয়েছে। প্রথমবারের মতো বাছাইপর্বে ফিফার ২০৯টি সদস্যই অংশ নেয়। সবাইকে অবাক করে মূল পর্ব নিশ্চিত করে মাত্র সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যার আইসল্যান্ডও! এত কম জনসংখ্যার দেশ এর আগে বিশ্বকাপ খেলেনি।
বছর দুই আগে ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া সিগার্ডসন, সিগবোর্সোনদের আইসল্যান্ড প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ড্র করে তাঁদের রূপকথা রচনা অব্যাহত রাখে। তবে ক্রোয়েশিয়া আর নাইজেরিয়ার সঙ্গে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা আগের বিশ্বকাপে ফাইনালে হারের ধাক্কা সামলে এবার বেশি দূর যেতে পারেনি। দ্বিতীয় ম্যাচে তারা দুরন্ত ক্রোয়েশিয়া—টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় লুকা মদরিচের তাণ্ডবে ৩-০ গোলে হারে।
তবে শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতে কোনোমতে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায়। সত্যি বলতে, তারা টুর্নামেন্টের সেরা খেলাটা খেলেছে দ্বিতীয় রাউন্ডেই। কিন্তু ফ্রান্সকে আটকানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। এমবাপ্পের জোড়া গোলে আর্জেন্টিনা হারে ৪-৩ গোলে।
মেসির মতো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েন। তবে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই রোনালদো হ্যাটট্রিক তুলে নেন। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিন, ১৫ জুন, সোচির অলিম্পিক স্টেডিয়ামে স্পেন বনাম পর্তুগালের খেলাটা ছিল টুর্নামেন্টেরই অন্যতম সেরা, যা শেষ হয় ৩-৩ গোলের ড্রয়ে।
সে সময়ের আরেক বড় তারকা লুইস সুয়ারেজের উরুগুয়ের কাছে দ্বিতীয় রাউন্ডে হারে পর্তুগাল। স্বাগতিক রাশিয়ার সঙ্গে গ্রুপ ‘এ’ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া উরুগুয়ে অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনালে হারে ফ্রান্সের বিপক্ষে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য পায় রাশিয়া। প্রথম দিনে সৌদি আরবের জালে ৫ গোল দিয়ে উৎসবের সূচনা করে। এর পরের চার বছর ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের অন্যতম তারকা মোহাম্মদ সালাহর মিসরকেও হারায় রাশিয়া। যদিও কাভানি, সুয়ারেজদের বিপক্ষে উড়ে যায়।
তবে রুশ গোলরক্ষক ও অধিনায়ক ইগর আকিনফিভের টাইব্রেকার-বীরত্বে দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে যায় তারকাখচিত স্পেন। দেশের মাটিতে হওয়া আগের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়া ব্রাজিল এবারের শুরুটা করে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ড্র দিয়ে।
সার্বিয়া আর কোস্টারিকার সঙ্গে জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে তারা। শেষ ষোলোতে মেক্সিকোকে হারায় নেইমারের দল। কিন্তু পরের রাউন্ডে হেরে যায় সেই টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেবারিট বেলজিয়ামের কাছে।
সময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনা কাজানে ব্রাজিলকে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আট বছর আগে জিদানের স্মৃতি। ডি ব্রুইনা আর বেলজিয়ামের চাপে আত্মঘাতী গোল করেন তাঁর ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির সহখেলোয়াড় ফার্নানদিনিও।
ডি ব্রুইনা নিজে একটি গোল দিয়ে দলকে এগিয়ে দেন আর রেনাতো আগুস্তো শেষ দিকে নেমে খেলায় গতি সঞ্চার করার পাশাপাশি একটি গোল শোধ দিলেও তা যথেষ্ট ছিল না ব্রাজিলের জন্য।
আরেক বড় দল জার্মানির কথাটা ছোট করে বলা দরকার। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় গ্যারি লিনেকার বলতেন, ফুটবল এমন এক খেলা, যাতে ২২ জন ৯০ মিনিট খেলে এবং শেষতক জেতে জার্মানি। কিন্তু আগেরবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ইওয়াখিম লুভের দল এবার প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়।
প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে হেরে, দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য জার্মানরা লিনেকারের কথাই সত্য প্রমাণ করেছিল টনি ক্রুসের ৯৫ মিনিটের দারুণ এক ফ্রিকিক গোলে সুইডেনকে হারিয়ে। কিন্তু শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া জার্মানদের হারায় দেয়।
কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে ওঠা সন হিউং মিন মরিয়া জার্মানির ওপরে উঠে যাওয়া ফাঁকা রক্ষণ চিরে দ্বিতীয় গোলটা দেন ৯৬ মিনিটে।
সহজ গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা ইংল্যান্ড দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে হারায় কলম্বিয়াকে। বড় বড় টুর্নামেন্টে বারবার টাইব্রেকারে হেরে এটাকে ইংল্যান্ড এতটাই ভয়ের ব্যাপার ভাবত যে বিবিসির ফুটবল–পণ্ডিতেরা বিশ্বকাপ ২০১৮-এর সেরা মুহূর্ত হিসেবে রায় দেন সেই জয়ের ক্ষণটাকেই।
কোয়ার্টার ফাইনালে সুইডেনকে হারানো ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে ৫ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। ‘ফুটবল কামিং হোম’ আওয়াজে ব্রিটিশ মিডিয়া ও জনগণ তখন উত্তেজনার তুঙ্গে। কিন্তু পেরিসিচের ৬৮ মিনিটের গোলে আর মানজুকিচের ১০৯ মিনিটের গোলে ফুটবলের আর ‘হোমে’ ফেরা হয় না।
অন্য সেমিফাইনালেও অন্য রকম এক ‘হোমের’ গল্প। বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম হারে ফ্রান্সের উমতিতির একমাত্র গোলে। এতে উমতিতির জন্মস্থান ক্যামেরুনের এক পত্রিকা শিরোনাম করেছিল, ‘ক্যামেরুন ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলল।’
আদতে ফ্রান্স দলের ১৫ জনেরই ‘আফ্রিকান কানেকশন’ ছিল। প্রেসনেল কিমপেম্বের বাবা কঙ্গোর, উমতিতির জন্ম ক্যামেরুনে, পল পগবার বাবা-মা গিনির, এমবাপ্পের বাবা ক্যামেরুনের আর মা আলজেরিয়ার, উসমান দেম্বেলের মা মৌরিতানিয়ান আর সেনেগাল বংশোদ্ভূত কোরেন্তি তোলিসো টোগোর হয়ে খেলতে পারতেন, কান্তে, ব্লেইজ মাতুইদিদের ক্ষেত্রেও তা–ই।
১৫ জুলাই মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারায় ফ্রান্স। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন ভ্লাদিমির পুতিন। ওদিকে ফরাসিরা আনন্দে ভাসে। কিন্তু এই আনন্দ আর দারুণ অর্জনের পরও ‘আফ্রিকান কানেকশনের’ মানুষের প্রতি সে দেশে ঘৃণা কমে না।