বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষিক্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার খেলবেন ৫৭ বছরেও
তাঁর যেন কোনো ক্লান্তি নেই। ফুটবল মাঠে ছুটে চলছেন নিরন্তর। পেশাদার ফুটবলে খেলছেন ৫৬ বছর বয়সেও। খেলতে চান ৬০ বছর পর্যন্ত। ভাবা যায়! নাম তাঁর কাজুইশো মিউরা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী এই ফুটবলারের আন্তর্জাতিক অভিষেকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম।
পর্তুগিজ ক্লাব অলিভিয়েরেন্সে ঘোষণা দিয়েছে, জাপানি ফুটবলার মিউরা আরও এক বছর খেলবেন তাদের হয়ে। হোক না অলিভিয়েরেন্সে পর্তুগিজ ফুটবলে দ্বিতীয় বিভাগের দল। কিন্তু পেশাদার দল তো, ৫৬ বছর বয়সেও মিউরার পারফরম্যান্স পেশাদারি মানের না হলে তাঁকে ধরে রাখার কথা না ক্লাবটির।
বয়স যে শুধুই একটা সংখ্যা, সেটি প্রমাণ করে দিয়েছেন মিউরা। যে বয়সে কোচ কিংবা সংগঠক হয়ে যান খেলোয়াড়েরা, সেই বয়সেও তিনি খেলছেন পেশাদারি ফুটবল। ১৯৮৬ সালে ব্রাজিলে যে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মাত্র ১৯ বছর বয়সে, সে ক্যারিয়ারকেই তিনি দিয়েছেন প্রায় অমরত্ব।
মিউরার এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারের রহস্যটা কী! তাঁর ক্যারিয়ার শুরুর পর জন্ম নেওয়া অনেক ফুটবলারের ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে গেছে। একজন পেশাদার ফুটবলারের ক্যারিয়ার যেখানে সর্বোচ্চ ২০ বছরের আশপাশে স্থায়ী হয়, সেখানে মিউরা খেলছেন ৩৭ বছর ধরে।
জাপানের কিংবদন্তি মিউরা ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ব্রাজিলে। ১৯৮৬ সালে পেলের ক্লাব সান্তোসের হয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা। এরপর ৩৮টি মৌসুম কাটিয়েছেন পেশাদার ফুটবলে। ভক্তরাও তাঁকে ভালোবেসে ডাকেন ‘কিং কাজু’।
বয়স ৫০ পেরোনোর সঙ্গে মিউরা পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ভেঙে দেন স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুজের রেকর্ড। ১৯৬৫ সালে ম্যাথুজ যখন অবসর নেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫০ বছর ৭ দিন। সবচেয়ে বেশি বয়সে পেশাদার ফুটবল খেলার এই রেকর্ড আগেই ভেঙেছেন মিউরা। এখনো খেলে চলায় তাঁর সেই রেকর্ড অমরত্ব পাওয়ার পথে।
সান্তোসের হয়ে শুরু করা মিউরার ক্লাব ক্যারিয়ারটা দেখে নিতে পারেন। সান্তোসের পর খেলেছেন পালমেইরাসে। এরপর খেলেছেন মাতসুবারা, সিআরবি ঘুরে এরপর কিছুদিন সান্তোসে খেলে যোগ দেন জাপানি ক্লাব কাওয়াসাকি ভার্দেতে। ধারে খেলেছেন ইতালীয় সিরি ‘আ’র দল জেনোয়াতেও। দিনামো জাগরেবেও কাটিয়েছেন কিছুদিন। কিয়োটো পার্পেল সাঙ্গা, ভেসেল কোবে, ইয়োকোহামা, সিডনি এফসিতেও খেলেছেন মিউরা। এখন খেলছেন অলিভিয়েরেন্সে।
ইয়োকোহামা এফসি থেকে এ বছরের শুরুতে মিউরা অলিভিয়েরেন্সে যোগ দেন। পর্তুগালের দ্বিতীয় বিভাগে তাঁর অভিষেক হয় অ্যাকাদেমিকো তি ভিসাউয়ের বিপক্ষে। সে ম্যাচে অলিভিয়েরেন্স জয় পায় ৪-১ গোলে। ২০ মিনিট খেলেছিলেন মিউরা। লেইক্সোসের বিপক্ষে তাঁর দলের ৪-৩ গোলের জয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন। ম্যাচের পর স্পোর্ত টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিউরা বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলব।’
জাপানের হয়ে ৮৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও বিশ্বকাপে খেলা হয়নি মিউরার। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে জাপানের খেলা হয়নি শেষ মুহূর্তের দুর্ভাগ্যের কারণে। ইরাকের বিপক্ষে ম্যাচে জিতলেই বিশ্বকাপে পৌঁছে যেত জাপান। কিন্তু ২ গোলে এগিয়ে থাকা সে ম্যাচ শেষ পর্যন্ত ড্র হয় ২-২ গোলে। ইরাক শেষ মুহূর্তে সমতা না ফেরালে হয়তো মিউরার স্বপ্নপূরণ হতো। ক্যারিয়ারের সেরা সময় যে তাঁর তখনই। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে যখন জাপান প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পেল, তখন মিউরা বাদ পড়ে গেলেন। বিশ্বকাপ না খেলার আক্ষেপ হয়তো ভোলার চেষ্টা করতে পারেন নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে। দেশের হয়ে ৮৯ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫৫টি গোল তো গর্ব করার মতোই।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে এক ম্যাচে ৬ গোল করারও অনন্য কীর্তিও আছে মিউরার। ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ম্যাকাওকে ১০-০ গোলে হারিয়েছিল জাপান। টোকিওতে সে ম্যাচে মিউরা একাই করেছিলেন ৬ গোল। মিউরার গোলের খিদে পুড়িয়েছে বাংলাদেশকেও। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই তাঁর অভিষেক। সেটি ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে। জাপান জিতেছিল ৩-০ গোলে। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর গোল ৫টি। এর মধ্যে এক ম্যাচেই আছে ৪ গোল। ১৯৯৩ সালে টোকিওতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৮ গোল হজমের দুঃস্বপ্নের মধ্যে মিউরার পা থেকে এসেছিল ৪ গোল। আরেকটি গোল ১৯৯৩ বাছাইপর্বেই ফিরতি পর্বে দুবাইয়ে। সে ম্যাচে জাপান জিতেছিল ৪-১ গোলে।
যে বয়সে কর্মকর্তার আসনে বসার কথা কিংবা ফুটবল শিক্ষক হিসেবে ডাগআউটে, সেখানে মিউরা মাঠে খেলে যান কিসের অনুপ্রেরণায়? বেশ কয়েক বছর আগে একবার তিনি বিবিসিকে কারণ হিসেবে বলেছিলেন ফুটবলের প্রতি ‘প্যাশন’–এর কথা। সেই ১৯ বছর বয়সে সান্তোসে খেলার সময় যে আনন্দ পেতেন, এখনো নাকি তেমনই আনন্দ পান। আসলে আনন্দ পাচ্ছেন, আনন্দ দিচ্ছেন বলেই ৫৬ বছর বয়সেও পেশাদার ফুটবল ক্লাব তাঁর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়। মিউরা নিজেই ফুটবল ইতিহাসে বিরাট এক অধ্যায়।