এল ক্লাসিকো: দাবার ছকে মুখোমুখি জাভি–আনচেলত্তি
মৌসুমের পঞ্চম এল ক্লাসিকো, ফুটবল রোমান্টিকদের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রিয়াল-বার্সার দ্বৈরথে কাতালান ক্লাবটির জয়ই যেন শেষ কথা হয়ে উঠেছে।
তবে আজকের ম্যাচটি আগের ম্যাচগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। এই ম্যাচে যারা জিতবে, তারা কোপা দেল রের শিরোপা মঞ্চে পৌঁছে যেতে পারবে। প্রথম লেগে জিতেছিল বার্সা। শুধু প্রথম লেগ কেন, শেষ তিন এল ক্লাসিকোর প্রতিটিতে জিতেছে বার্সা। ম্যাচটি তাই রিয়ালের জন্য প্রতিশোধ এবং মর্যাদা রক্ষারও।
পাশাপাশি ম্যাচটি যে জাভি হার্নান্দেজকে কার্লো আনচেলত্তির জবাব দেওয়ারও। যদিও এই দ্বৈরথকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নামাতে চান না রিয়াল কোচ, ‘কোচদের মাঝে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব তৈরির বিষয়টা বেশ কঠিন। আমরা জেতার জন্যই খেলব।’ অন্যদিকে রিয়ালের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেও নিজেদের ফেবারিট মানতে নারাজ বার্সা কোচ জাভি। উল্টো চাপে থাকা রিয়ালকেই ফেবারিট মনে করছেন স্প্যানিশ কিংবদন্তি। যদিও নিজেদের কথায় যতই বিনয়ের অবতার হন, মাঠে লড়াইয়ে কেউ কাউকে যে ছেড়ে কথা বলবেন না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এমন রোমাঞ্চকর ম্যাচগুলোয় মূলত দুই দলের কৌশল, মাঠে খেলার মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা এবং খেলোয়াড়দের ছন্দে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এল ক্লাসিকোয় সেই কৌশল ও প্রবণতা কেমন হতে পারে?
বড় ম্যাচগুলোতে সাধারণত দলগুলো একই ফরমেশন এবং কৌশলে স্থির থেকে খেলার চেষ্টা করে। এমন ম্যাচে ঝুঁকি নেওয়ার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। ২০২০-২১ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে কৌশল পরিবর্তন এনে দলকে শিরোপাবঞ্চিত করেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। তাই বড় ম্যাচগুলোয় দলগুলো নিজেদের কৌশলে স্থির থেকে ফল বের করার চেষ্টা করে। আগের বছরগুলোতে রিয়াল-বার্সাও নির্দিষ্ট কাঠামোয় খেলার চেষ্টা করেছে। যদিও এ মৌসুমে দুই দলই সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
এ মৌসুমে দুই দলই অবশ্য প্রায় সব ম্যাচে ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলা শুরু করেছে। কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতি এবং গতি বুঝে নিজেদের সেই কৌশলে পরিবর্তনও এনেছে তারা। কোপা দেল রের প্রথম লেগের কথায় ধরা যাক। সেই ম্যাচে কৌশল বদলে দলকে ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলাতে শুরু করেন জাভি। মূলত রক্ষণকে সুদৃঢ় করতেই এই কৌশল নেন বার্সেলোনা কোচ। যার ফলও অবশ্য বার্সা হাতেনাতে পেয়েছে। সেই ম্যাচে ১৩টি শট নিয়েও কোনো শট লক্ষ্যে রাখতে পারেনি রিয়াল। সেদিন রিয়ালকে ঠেকাতে রক্ষণে বার্সা দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে আলাদাভাবে খেলোয়াড় রেখে রক্ষণের কৌশল সাজান জাভি, যা কিনা রিয়ালের শট ঠেকানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
বিপরীতে আনচেলত্তিও ভিন্ন ভিন্ন ফরমেশনে দলকে খেলিয়েছেন। তবে যে কৌশলটি রিয়াল কোচ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন, সেটি ছিল ৪-৪-২, যেখানে তিনি ফেদে ভালভার্দেকে উইঙ্গার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আবার ভায়াদোলিদের বিপক্ষে সর্বশেষ লিগ ম্যাচের কথায় ধরা যাক। এই ম্যাচে দলকে আনচেলত্তি খেলিয়েছেন ৪-২-৩-১ ফরমেশনে। যেখানে রদ্রিগো খেলেছেন মিডফিল্ডার হিসেবে। বার্সার সঙ্গে পেরে না উঠলেও ইতালিয়ান কোচের পরিবর্তিত কৌশল এ মৌসুমে বেশ ভালোভাবেই কাজে লেগেছে।
বার্সেলোনার বিপক্ষেও কৌশলে পরিবর্তন এনে একাদশ সাজাতে পারেন আনচেলত্তি। যেখানে তিনজন মিডফিল্ডারের সঙ্গে ভালভার্দে কিংবা দানি সেবায়োসের চেয়ে অধিক আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের খেলাতে পারেন এই কোচ। যেমন দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে রদ্রিগোর পারফরম্যান্স বেশ ইতিবাচক। সঙ্গে তাঁর একক নৈপুণ্য তো রয়েছেই। নিজেকে মেলে ধরার সঙ্গে বাকি কাছ থেকে খেলাটা বের করে নিয়ে আসতে পারেন এই ব্রাজিলিয়ান। বলতে হবে ভিনিসিয়ুসের কথাও। দলগত ঐক্যের ভেতর দিয়েই মূলত বেশি ফুটে ওঠে ভিনিসিয়ুসের খেলা। বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে দারুণ সব সুযোগ তৈরি করতে পারেন ভিনি। এ ছাড়া করিম বেনজেমা তো আছেনই। আগের ম্যাচের হ্যাটট্রিকের স্মৃতি নিয়েই মাঠে নামবেন এই ফরাসি স্ট্রাইকার। নিজের দিনে যে শক্তিশালী রক্ষণের বিপক্ষে বেনজেমা একাই যথেষ্ট হতে পারেন।
রক্ষণ ও আক্রমণের সমন্বয়ের যারা বেশি দাপট দেখাতে পারবে, তাদের ম্যাচের সাফল্য লাভের সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে। প্রথম লেগে তেমনই আগ্রাসী রূপান্তর থেকে গোল আদায় করে ম্যাচ বের করে নিয়েছিল জাভির দল। পাশাপাশি ডিফেন্সিভ ভুলের প্রবণতাও ম্যাচের ফল নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে।
দুই দলই যেখানে জয়ের জন্য খেলবে, চোখ থাকবে দ্রুত আক্রমণে উঠে গোল আদায় করে নেওয়ার দিকে, যা রক্ষণকে প্রতিপক্ষের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে। ফলে ডিফেন্সিভ ভুল ও পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না-থাকা প্রতি-আক্রমণ থেকে গোল হজমের আশঙ্কাও অনেক বাড়িয়ে দেবে। দুই দলকেই তাই এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। সব মিলিয়ে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ থেকে দলগত ঐক্যের ভেতর দিয়ে যারা ম্যাচ করে আনার চেষ্টা করবে, এল ক্লাসিকোতে তাদের সাফল্য লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে।
ক্লাসিকোর এ লড়াইয়ে ফল নির্ধারক হয়ে উঠতে পারেন স্ট্রাইকাররাও। আগের ম্যাচগুলোয় দুই দলের দুই স্ট্রাইকারই নিজেদের সেরা ছন্দে ছিলেন না। কোপা দেল রের প্রথম লেগে তো রবার্ট লেভানডফস্কি খেলতেও পারেননি। যা দুই দলকে গোল মুখে ভুগিয়েছে। তবে এই এল ক্লাসিকোতে বেনজেমা এবং লেভানডফস্কি দুজনই নামবেন নিজেদের সেরা ছন্দে থেকে।
ভায়াদোলিদের বিপক্ষে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন বেনজেমা, আর এলচের বিপক্ষে লেভানডফস্কি করেছেন জোড়া। দুই স্ট্রাইকারের ছন্দ থাকাও দুই দলকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাবে। আজ রাতে এ দুজনের লড়াইয়ে যে জিতবেন, তিনিই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। তবে এ দুজনের পাশাপাশি রাফিনিয়া, গাভি, ভিনিসিয়ুস কিংবা রদ্রিগোর সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। নিজেদের দিনে যে তারাও ম্যাচের রূপ বদলে দিতে পারেন।