৭৬৫ কোটি টাকায় যে ‘রত্ন’ কিনল ম্যানচেস্টার সিটি
থিয়েরি অঁরির একটি মন্তব্যেই বোঝা যায় জেরেমি ডোকু কেমন খেলোয়াড়, ‘তার সামনে (ওয়ান-অন-ওয়ান) পড়লে শুধু একটি কাজই করতে পারেন—প্রার্থনা।’
বেলজিয়ান ডোকুর দেশের সংবাদকর্মী ক্লাউদো রিউলেন্স ডোকুকে যে প্রশংসাপত্র দিয়েছেন, তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ম্যানচেস্টার সিটি, ‘গতি, শক্তি ও দক্ষতায় সে যেন নিজেকে প্রিমিয়ার লিগের জন্যই তৈরি করেছে। ভক্তরা তাকে পছন্দ করবেন, কারণ সে অসাধারণ খেলোয়াড়। তার পায়ে বল থাকলে কিছু একটা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।’
যে খেলোয়াড়কে নিয়ে এমন প্রশংসাপত্র, সেই জেরেমি ডোকু এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। ফরাসি ক্লাব রেঁনে থেকে গতকাল তাঁকে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইতিহাদে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে ম্যানচেস্টার সিটি। বেলজিয়ামের ২১ বছর বয়সী এই উইঙ্গারকে কিনতে ৫ কোটি ৫৪ লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৬৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা) খরচ করেছে সিটি। ইংলিশ ক্লাবটিতে রিয়াদ মাহরেজের জায়গা নেবেন ডোকু।
গত জুলাইয়ে ম্যানচেস্টার সিটি ছেড়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল আহলিতে যোগ দেন মাহরেজ। সে শূন্যতা পূরণে ওয়েস্ট হাম, টটেনহাম ও চেলসিকে পেছনে ফেলে মৌসুমের তৃতীয় সাইনিং হিসেবে ডোকুকে দলে টেনেছেন সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। এর আগে চেলসি থেকে মাতেও কোভাচিচ ও লাইপজিগ থেকে ইয়োস্কো গাভারদিওলকে কিনেছে সিটি।
বেলজিয়ান ক্লাব আন্ডারলেখটের বয়সভিত্তিক দলে বেড়ে ওঠা ডোকুকে ২০২০ সালে ২ কোটি ২৩ লাখ পাউন্ডে কিনে নেয় ফরাসি ক্লাব রেঁনে। ক্লাবটিতে তিন মৌসুমে ৭৫ লিগ আঁ ম্যাচে ১০ গোল করা ডোকুর এই পরিসংখ্যান দেখে তাঁকে বিচার করলে ভুল হবে। প্রতিভার আলোই ডোকুকে এতটা উঁচুতে তুলে এনেছে, যে কারণে তাঁকে অনেকেই আদর করে ডাকেন, ‘দ্য বেলজিয়ান ফ্লাশ।’ বাংলায় কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘বেলজিয়ান আলোর ঝলক’। প্রশংসাটা একদম মিথ্যা নয়।
এমনিতে রাইট উইঙ্গার হলেও ডোকুকে যেকোনো প্রান্তে খেলানো যায়। সিটিতে জ্যাক গ্রিলিশ যেহেতু বাঁ পাশের উইং অনেকটাই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে নিয়েছেন আর কেভিন ডি ব্রুইনার অনুপস্থিতিতে ফিল ফোডেনকে খেলতে হচ্ছে মাঝমাঠে, তাই মাহরেজের ফেলে যাওয়া বাঁ প্রান্তের উইংয়েই ডোকুর খেলার সম্ভাবনা বেশি। চোটের কারণে গত মৌসুমে ডোকু এসব তারকা খেলোয়াড়ের চেয়ে অনেক কম ম্যাচ খেলেছেন।
লিগ আঁতে রেঁনের হয়ে ১৩ ম্যাচে জায়গা পেয়েছেন শুরুর একাদশে, ১৬ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন বেঞ্চ থেকে। এর মধ্যেই ৬ গোল করার পাশাপাশি বানিয়েছেন আরও ২টি গোল। আর প্রতিভা?
বিবিসির একটি তথ্য দেওয়া যায়—গত মৌসুমের শুরু থেকে হিসাব করলে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে প্রতি ৯০ মিনিটে ডোকুই সবচেয়ে বেশি ড্রিবলিং করেছেন। হিসাবটা করা হয়েছে অন্তত ৯০০ মিনিট খেলেছেন এমন খেলোয়াড়দের নিয়ে। কিংবা গত ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির কাছে বেলজিয়ামের ২-১ গোলে হারের ম্যাচটি স্মরণ করুন। সে ম্যাচে পেনাল্টি আদায়ের পাশাপাশি ৮ বার সফল ড্রিবলিং করেছিলেন ডোকু, যা ইউরোর ইতিহাসে ‘টিন-এজ’ কোনো খেলোয়াড়ের এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ড্রিবলিংয়ের রেকর্ড।
ডোকুর প্রতিভার প্রমাণ আরও দেওয়া যায়। সেটি সিটির চার উইঙ্গারের (ফোডেন এখন মাঝমাঠে) সঙ্গে তুলনা টেনে। গত মৌসুমে লিগে প্রতি ৯০ মিনিটে সফল ড্রিবলিংয়ে ফোডেন (২.১ বার), গ্রিলিশ (২.১ বার) মাহরেজ (১.৩ বার) ও ডেভিড সিলভাকে (১.১ বার) বড় ব্যবধানে পেছনে ফেলেছেন ডোকু (৬.৭ বার)। পোস্টে শট নেওয়ার হারে এ সময় শুধু ফোডেনই (২.৩ বার) তাঁর (১.৮ বার) চেয়ে এগিয়ে। গোল করা এবং গোল করানোর পাস (অ্যাসিস্ট) দেওয়ায় এ সময় ডোকুর (০.৫৬ বার) চেয়ে এগিয়ে শুধু ফোডেন (০.৭৮ বার)।
ডোকু আসলে নিখাদ একজন ‘টেক্সটবুক’ উইঙ্গার যে ড্রিবল করতে ভালোবাসে, আর তাই পাসিংয়ের হারে মাহরেজের (৪২ টি) চেয়ে পিছিয়ে (২৯.৯ বার) থাকলেও গার্দিওলার নজরে পড়েন ভালোমতোই। ওই যে ক্লাউদো রিউলেন্সের কথাটা, ডোকুকে দেখলে মনে হবে সে যেন প্রিমিয়ার লিগের জন্যই তৈরি হয়েছে—আর কে না জানে গার্দিওলা রত্ন চেনায় খুব কমই ভুল করেছেন।
মাহরেজের সঙ্গে ডোকুর পার্থক্যটা বিবিসি রেডিও ফাইভে বুঝিয়ে বলেছেন টটেনহামের সাবেক ডিফেন্ডার লেডলি কিং, ‘মাহরেজ একটু ধীর গতির, ছান্দসিক, বল ধরে রাখে। কিন্তু ডোকু খুবই গতিশীল খেলোয়াড়, যে বাইরে থেকে আক্রমণে উঠতে পছন্দ করে।’ লেডলি কিং আরেকটু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, গত মৌসুমে ‘ট্রেবল’জয়ী সিটির খেলার ধরন সবাই জানে। বল প্রতিপক্ষের জালে জড়ানো পর্যন্ত তারা পাস খেলতে ভালোবাসে। লেডলি কিংয়ের যুক্তি, ‘আমি মনে করি গত মৌসুমে খেলার ধরন থেকে সিটিকে আরও এক ধাপ ওপরে তুলতে চান গার্দিওলা। এবার খেলাটা একটু আলাদা ধরনের হতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই ডোকু খুবই দক্ষ খেলোয়াড় যে (প্রতিপক্ষের) অনেক সমস্যার কারণ হবে।’
১০ বছর বয়সে আন্ডারলেখটে যোগ দিয়েছিলেন ডোকু। মূল দলে ডাক পান ৬ বছর পর। কিন্তু আন্ডারলেখটের মূল দলে ডাক পাওয়ার আগেই ১৫ বছর বয়সে লিভারপুলে নাম লেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। সিটি, চেলসি ও আর্সেনালের আগ্রহ থাকলেও ৫ লাখ পাউন্ড দাম হেঁকে তাঁকে কেনার দৌড়ে এগিয়ে ছিল অ্যানফিল্ডের ক্লাবটি। সে সময় মার্সেসাইডের ক্লাবটিতে গিয়ে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ, বয়সভিত্তিক দলের কোচ স্টিভেন জেরার্ড ও তারকা খেলোয়াড় সাদিও মানের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন ডোকু।
মানে তাঁর বয়স জেনে বলেছিলেন, ‘মায়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। যেহেতু তরুণ তাই হাতে প্রচুর সময় আছে।’ ডোকু সেদিন বুঝেছিলেন তাঁর কী করা উচিত। সেটি ২০২১ সালে বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, ‘জানতাম আন্ডারলেখটে থাকতে হলে আমাকে কী করতে হবে। এখন কেউ ওই ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে এতটুকু অনুশোচনা হয় না। কারণ লিভারপুল যদি আমাকে ১৫ বছর বয়সে পছন্দ করে তাহলে পরেও করবে।’
আন্ডারলেখটে সিটি কিংবদন্তি ভিনসেন্ট কোম্পানির অধীনে দুই বছরের কম সময় থাকার পর রেঁনেতে যোগ দেন ডোকু। লিগ আঁতে গত মৌসুমে ১২৮৫ মিনিট খেলেছেন ডোকু—যা ১৪টি ম্যাচের সমান। এর মধ্যে ড্রিবল করেছেন ৯৬ বার। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগ মিলিয়ে শুধু লিওনেল মেসি-ভিনিসিয়ুস এ সময় তাঁর চেয়ে বেশি ড্রিবল করেছেন। সংবাদকর্মী ক্লাউদো রিউলেন্স মোটামুটি নিশ্চিত, সিটিতে বেলজিয়ামের সেরা প্রতিভাই গিয়েছে, ‘আমার মতে ডোকু বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় প্রতিভা। রেঁনেতে থাকতে তার চোটে পড়া দুঃখজনক ছিল। কিন্তু গত ছয় মাসে সে ভালোই উন্নতি করেছে।’
বাবা অ্যাথলেট হওয়ায় শরীরে প্রকৃতিগতভাবেই গতি পেয়েছেন ডোকু। ক্যারিয়ারে তাঁর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৯.৫৭ মাইল, যা দেখে বোঝা যায় কিংবদন্তি স্প্রিন্টার উসাইন বোল্টের (ঘণ্টায় ২৭.৩৩ মাইল) চেয়ে বেশি পিছিয়ে নেই। ডিসি কমিকসের সুপারহিরো চরিত্র ‘ফ্লাশ’—যে কি না প্রচণ্ড গতিতে দৌড়াতে পারে, সেই চরিত্র অবলম্বনে ডোকুকেও ‘বেলজিয়ান ফ্লাশ’ নামে ডাকা হয়। দুই বছর আগে কিলিয়ান এমবাপ্পে এক সাক্ষাৎকারে ডোকুকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘গ্যালারি থেকে (সেদিন খেলেননি) এক খেলোয়াড়কে দেখে বাবার সঙ্গে তাকে নিয়ে কথা বলছিলাম। সেটি তার গতির কারণে—রেঁনেতে খেলা জেরেমি ডোকু। আমি আমার পাঁচ বছরের পেশাদার ফুটবলে শুরুতেই কাউকে এত জোরে দৌড়াতে দেখিনি।’
দৌড়, ড্রিবলিং ও শক্তি—এসবই ডোকুর প্রতিভার নিদর্শন, যা তাঁকে তুলে এনেছে ম্যানচেস্টার সিটিতে। ডোকু সেখান থেকে নিজেকে কোন উচ্চতায় তুলতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।