বুটের ফিতা বাঁধতে না জানা ছেলেটিই এখন বার্সার স্বপ্নের সারথি
২০২১ সালের নভেম্বর মাস। দিনেমো কিয়েভের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলতে কিয়েভে গিয়েছিল বার্সেলোনা। কিয়েভে ঠান্ডার রাতে খেলার একপর্যায়ে বার্সার ১৭ বছর বয়সী মিডফিল্ডার গাভির জুতার ফিতা বেঁধে দিতে দেখা যায় সতীর্থ নিকো গঞ্জালেসকে। পরে সেই ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন গঞ্জালেস। ক্যাপশনে তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন সত্যিই তোমার শেখার সময় হয়েছে।’
হ্যাঁ, সত্যি কথা হচ্ছে, গাভি জুতার ফিতা বাঁধতে পারেন না। শিখছেন কি না, তা–ও নিশ্চিত না। তবে এখনো গাভিকে জুতার ফিতা খোলা রেখেই খেলতে দেখা যায়। গাভির জুতার ফিতা নিয়ে কথা বলতে হয়েছিল তাঁর প্রথম কোচ ম্যানুয়েল বাস্কো এবং বর্তমান কোচ জাভি হার্নান্দেজকেও। বাস্কো বলেছিলেন, ‘গাভি সব সময় তার বুটের ফিতা খোলা রেখে খেলে। ৬ বছর বয়স থেকেই সে এটা করে আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই ফিতাগুলোতে সে কখনো পা দেয়নি।’
একই প্রসঙ্গে বার্সার বর্তমান কোচ জাভি বলেছিলেন, ‘গাভি ছোটবেলা থেকে বুটের ফিতা খুলে রেখে খেলে আসছে। এর কারণ, সে জানে না কীভাবে এটা বাঁধতে হয়। সেটা নিয়ে অবশ্য সে ভাবেও এবং এভাবেই সে খেলতে পছন্দ করে।’
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাও বুটের ফিতা খোলা রাখতেন। এভাবে অনুশীলন করতে নাকি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন অনেকের কাছে সর্বকালের সেরা এই খেলোয়াড়। বুটের ফিতা খোলা রেখে খেললে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বার্সেলোনার ঘুরে দাঁড়ানোয় গাভির প্রভাব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। চলতি মৌসুমে জাভির অধীনে বদলে যাওয়া বার্সার হয়ে মিডফিল্ডে দারুণ প্রভাব রাখছেন গাভি।
বয়স এখনো ১৮–এর ঘরে। এর মধ্যেই বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে গাভিকে। বার্সায় এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৭৭ ম্যাচ। গত অক্টোবরে জিতেছেন বর্ষসেরা তরুণের কোপা ট্রফিও। কদিন আগে স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে ৩–১ গোলে হারিয়ে বার্সেলোনার শিরোপা জেতার পথে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন গাভি। এখন বার্সার মিডফিল্ডে কোচ জাভির বড় ভরসাও হয়ে উঠছেন গাভি। কদিন আগে গায়ে তুলেছেন কিংবদন্তি জাভির পরা ৬ নম্বর জার্সিটিও।
কাছের মানুষেরা বলেন, জাভির মধ্যে নাকি তাঁর মা–বাবা দুজনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে মাঠের বাইরে মায়ের শান্ত স্বভাব এবং অন্যদিকে মাঠে বাবার মতো লড়াকু মানসিকতা—এই দুই মিলিয়েই আজকের গাভি। ফুটবলে আগমনের মাত্র ১২ বছরের মধ্যে আন্দালুসিয়ান এই কিশোর বার্সেলোনার মূল দল ও স্পেন জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করেছেন। ছুটছেন বড় স্বপ্নের পথেও।
২০০৪ সালের ৫ আগস্ট গুয়াদালকুইভির নদীর পাড়ে জন্ম পাবলো পায়েজ গাভিরা বা সংক্ষেপে গাভির। লস পালাসিওস ভিলাফ্রাঙ্কাতে বেড়ে উঠেছেন গাভি। সেভিয়ার দক্ষিণে ৩৮ হাজার মানুষের এই অঞ্চলে গেলে সাদা বাড়িগুলোর বারান্দায় নানা ধরনের রঙিন ফুল আপনার চোখে পড়বে। সঙ্গে আপনি বুঝতে পারবেন এখানকার জীবনযাত্রা একটু ভিন্ন—ধীর এবং সদাজাগ্রত। যা কখনো কখনো আপনাকে গাভির খেলার ধরনের কথাও মনে করিয়ে দিতে পারে।
শহরটি নিয়ে মজার একটি গল্প আছে। এই অঞ্চলের মাটি নাকি টমেটো উৎপাদনের জন্য বেশ কার্যকর। এই টমেটোগুলো মানের কারণে বেশ বিখ্যাতও। শহরের অধিবাসীদের বিশ্বাস, এই টমেটোগুলো এবং এর মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ তাদের ফুটবলারদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। বলে রাখা ভালো, ভিলাফ্রাঙ্কা থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তিনজন খেলোয়াড় স্পেনের ফুটবলে আবির্ভূত হয়েছেন। পিএসজি মিডফিল্ডার ফাবিয়ান রুইজ, সেভিয়ার উইঙ্গার জেসুস নাভা এবং গাভি।
গাভি অবশ্য সব দিক থেকে বাকিদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। কে জানে, হয়তো টমেটোর প্রভাবটা হয়তো তাঁর ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়েছে! ২০১০ সালে লা লিয়ারার হয়ে মাত্র ৬ বছর বয়সে ফুটবলের পথে যাত্রাটা শুরু করেন গাভি। শুরুতে গাভিকে শিষ্য হিসেবে পেয়েছিলেন বাস্কো। যিনি বাটালা ডাকনামে নিজ অঞ্চলে অধিক পরিচিত।
গাভিকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন এই কোচ, ‘যখন সে আসে, তার আগেই আমার দল পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে অনুশীলনে দেখে আমি বুঝলাম তার মাঝে ভিন্ন কিছু আছে। ছয় বছর বয়সী কোনো শিশুর এত ভালো সমন্বয় করতে পারার কথা নয়। কিংবা তার লড়াকু মানসিকতার কথাও আমরা মনে করতে পারি।’
শুরুতে অবশ্য গাভির ডাকনাম ছিল পাবলো। তবে বাস্কোর সেই দলটিতে আরেকজন পাবলো থাকায় তাঁর নাম বদলে হয়ে গেল গাভি। সেই নামেই এখন ফুটবল বিশ্বে পরিচিত এই মিডফিল্ডার। মাঠের বাইরে শান্ত বালক গাভি বুট পরে মাঠে নামতেই কীভাবে বদলে যেতেন, তার বর্ণনা দিয়ে বাস্কো বলেছেন, ‘এখনকার মতোই ছিল তার স্বভাব। সে এতই লাজুক ছিল যে মনেই হতো না সে উপস্থিত আছে। এরপর সে মাঠে যেতেই দলের নেতা হয়ে যেত। সতীর্থদের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল। সে স্বার্থপর ফুটবলার ছিল না, যে কিনা শুধু নিজেই গোল করতে চাইত। আমার মনে হয় না সে খুব বদলেছে।’
লিয়ারা থেকে রিয়াল বেতিস হয়ে গাভি বার্সায় আসেন ২০১৫ সালে। লা মাসিয়ায় যোগ দেওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ১১। যুব একাডেমিতে গাভি কোচিং করানো পাও মোরাল বলেন, ‘যদিও আমাদের স্কোয়াড ছিল উচ্চমানসম্পন্ন, এর মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি যে সে আলাদা।’ অন্যদের চেয়ে আলাদা গাভির তাই মূল দলের খুব বেশি অপেক্ষাও করতে হয়নি। তাঁর বয়সী অন্য খেলোয়াড়েরা যখন যুব দলে প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন গাভিকে নিয়মিত বার্সার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে।
বার্সার মূল দলে গাভির নিজের জাদু দেখানোর শুরুটা হয় তৎকালীন কোচ রোনাল্ড কোমানের হাত ধরে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁকে প্রাক্–মৌসুম সফরের জন্য নিয়ে আসেন কোমান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট বার্সার মূল দলের হয়ে ক্যাম্প ন্যুতে অভিষেক হয় গাভির। একই বছরের ৬ অক্টোবর গাভির আন্তর্জাতিক অভিষেকও হয়ে যায়। যখন ইতালির বিপক্ষে প্রথম খেলতে নামেন তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর ৬২ দিন।
তাঁকে নিয়ে সাবেক স্পেন কোচ লুইস এনরিকে বলেছিলেন, ‘সে এমনভাবে খেলে যেন সে স্কুলের মাঠে কিংবা বাড়ির সামনের বাগানে খেলছে। তার মানের এবং ব্যক্তিত্বের একজন খেলোয়াড় পাওয়া দারুণ ব্যাপার।’
বয়সের তুলনায় অধিক পরিপক্ব গাভিকে দেখে সাবেক ইংলিশ ফুটবলার এবং ফুটবল বিশ্লেষক জেমি রেডন্যাপ মজা করে তাঁর জন্মসনদ পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে ছড়ি ঘোরানো গাভি ট্যাকটিক্যাল জায়গাতেও দুর্দান্ত। মাঠে তাঁর পজিশনাল সেন্স দারুণ। সব সময় ফাঁকা জায়গা বের করে পাস বাড়ানোর দিকে চোখ থাকে তাঁর। গাভি সাধারণত মাঝমাঠ আলোকিত করে রাখা খেলোয়াড়।
তবে দলের প্রয়োজনে পুরো মাঠে বিভিন্ন জোনে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন। দ্রুত সতীর্থদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন এবং প্রতিপক্ষকে মুহূর্তের মধ্যে বিপদে ফেলতে পারেন এই মিডফিল্ডার।বার্সার হয়ে নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠা গাভি বিশ্বকাপে দল ভালো না করলেও নিজের প্রতিভার ঝলক ঠিকই দেখান। বার্সা তাঁর ওপর কতটা ভরসা রাখছে, সেটা বার্সার আইকনিক ৬ নম্বর জার্সি পাওয়াটা বলে দেয়। এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা।