পেলে যেদিন যুদ্ধ থামিয়েছিলেন
‘আমার নাম রোনাল্ড রিগ্যান। আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আপনার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সবাই জানে পেলে কে।’
রিগ্যান হলিউডে অভিনয় করেছেন। কিন্তু ওই কথাটা অভিনয়ের সংলাপ ছিল না। ফুটবলের প্রসারে সেবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন পেলে। তাঁকে অকৃত্রিম হৃদয়ে অভ্যর্থনা জানাতে কথাটা বলেছিলেন আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই প্রেসিডেন্ট।
আসলে পেলেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। মাঠের পেলেকে আমরা কমবেশি সবাই জানি। সেই পেলের মাধুর্য ও প্রভাব টাচলাইন পেরিয়ে সাধারণ মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই অনুভূতি এত প্রবল যে পেলেকে ঘিরে জন্ম হয়েছে বিভিন্ন গল্প–গাঁথার। একবার তাঁর জন্য নাকি আফ্রিকায় যুদ্ধও থেমেছিল!
এই ঘটনা সত্য না মিথ্য—লোকে তা নিয়ে এখনো তর্ক করে। তবে পেলে নিজেই এর সত্যতা নিশ্চিত করে গেছেন। সান্তোসের সমর্থকেরা ক্লাবের জন্য যে গান বেঁধেছেন, সেখানে এই ঘটনাকে ঠাঁই দেওয়ায় তা এখন স্থায়ী মিথ।
ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো স্পোর্তে’ জানিয়েছে, সেটি ১৯৬৯ সালের ঘটনা। আফ্রিকা মহাদেশ সফরে বের হয়েছিল ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোস। নাইজেরিয়ায় তখন চলছিল গৃহযুদ্ধ। সে বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি দেশটির মাটিতে অবতরণ করে সান্তোসের খেলোয়াড়দের বহনকারী বিমান। নাইজেরিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল দেশটির দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল—যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বায়াফ্রা’। তাতে নাইজেরিয়ার দুটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ‘ইগাবো’ ও ‘হাউসা’ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। মানুষ মরছিলে লাখে লাখ।
সান্তোস শর্ত দিয়েছিল, সব রকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই শুধু বেনিনে তাঁদের বিমান অবতরণ করবে। স্থানীয় গভর্নর স্যামুয়েল ওগবেমুদিয়া নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন।
২০২০ সালে পেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই এই ঘটনা সমন্ধে লিখেছিলেন, ‘১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ থামানো আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম গর্বের মুহূর্ত। তখন সান্তোস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করছিল। সেখানে গৃহযুদ্ধের মধ্যেই বেনিন সিটিতে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। সান্তোসকে সবাই এত ভালোবাসত যে ম্যাচের দিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। “সান্তোস যেদিন যুদ্ধ থামিয়েছিল”—পরে এই ঘটনাটা এভাবেও বলা যায়।’
সান্তোসে পেলের সঙ্গে খেলা সাবেক ফরোয়ার্ড এদু ‘গাজেত্তা এসপোর্তিভা’য় এক সাক্ষাৎকারেও এই ঘটনা নিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে আছে, এক ব্যবসায়ী বলেছিল কিছু দেশ আমাদের যুদ্ধের মধ্যে খেলতে দেখতে চায়। পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধবিরতি হয়।’
পেলে এবং এদুর মন্তব্যের পরও ‘গ্লোবো স্পোর্ত’ সেই ঘটনা বাস্তবতা না মিথ—তা বিশ্লেষণ করেছে। বায়াফ্রা–যুদ্ধ চলেছিল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। প্রায় ২০ লাখ সাধারণ মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে। আরও ৪৫ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়। তবে সান্তোসের সেই সফরে যে যুদ্ধ থেমেছিল তা অফিশিয়ালি কখনো স্বীকৃতি পায়নি। সান্তোসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় গভর্নর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিলেন এবং বায়াফ্রার মানুষেরাও যেন এই প্রীতি ম্যাচ দেখতে আসতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোস ও বায়াফ্রার মাঝে বেনিন সিটির স্থানীয় এক দলের মুখোমুখি হয়েছিল সান্তোস। প্রায় ২৫ হাজার দর্শকের সামনে ম্যাচটি ২–১ গোলে জিতেছিল সান্তোস। গোল করেছিলেন তোনিনহো, গুয়েরেইরো ও এদু।
‘গ্লোবো স্পোর্ত’ জানিয়েছে, নাইজেরিয়ার ব্লগার ওলাহো আয়েগবাও সেই ঘটনার সুলুকসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। সে সময় স্থানীয় সংবাদপত্র ঘেঁটে তিনি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির খবর পাননি। তবে আয়েগবাও জানিয়েছেন, ফুটবল ম্যাচের সময় যুদ্ধবিরতি নাইজেরিয়ার তখনকার প্রথা ছিল। এমন নয় যে শুধু সান্তোস সেখানে সফরে যাওয়ার কারণেই যুদ্ধবিরতিতে গিয়েছিল দুই পক্ষ। আত্মজীবনীতে পেলে এই ঘটনার সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করে বলেছেন, সান্তোস সফরে থাকতে বায়াফ্রানরা যেন লাগোস দখল করতে না পারে নাইজেরিয়ানরা তা নিশ্চিত করেছিল।
৫৩ বছর পর আজ সে ঘটনা স্মৃতিচারণের কারণও সবার জানা। সান্তোসের সমর্থকদের গানের একটি লাইন হলো ‘শুধু সান্তোসই যুদ্ধ থামিয়েছিল’—আর সে জন্য তারা যাঁকে ধন্যবাদ দেয়, সেই পেলে যাত্রা করেছেন অনন্তলোকে। সেদিন যুদ্ধ থেমেছিল বটে, তবে সেটি সান্তোসের জন্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সবাই যে পেলেকে দেখতে এসেছিল তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। ঠিক যেভাবে এখন ব্রাজিলে সবাই পেলেকে একবার দেখতে চাইছে শেষবারের মতো!