এমবাপ্পেকে কত দিন ‘বম্ব স্কোয়াড’-এ রাখতে পারবে পিএসজি
কিলিয়ান এমবাপ্পে এখন ‘বম্ব স্কোয়াড’–এর সদস্য।
কথাটা লিখেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’। ফুটবলে ‘বম্ব স্কোয়াড’ কথাটার একটা বিশেষ মানে আছে। সাধারণত অতি বেতনের খেলোয়াড়, যাঁরা প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেন না কিংবা ক্লাব আর যাঁদের দরকারি মনে করে না, তাঁদের যখন মূল দল থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তাঁদের ‘বম্ব স্কোয়াড’-এর সদস্য বলা হয়। এমবাপ্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে গিয়ে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ একটি শব্দ ব্যবহার করেছে ‘জেটিসনড’। অর্থাৎ উড়োজাহাজ থেকে যা নিক্ষেপ করা হয় কিংবা যাকে ত্যাগ করা হয়।
এমবাপ্পেকে নিয়ে ঠিক এই কাজই করছে পিএসজি। ফরাসি ক্লাবটি এখন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করছে। দলের নিয়মিত সদস্যদের ছেড়ে আলাদা অনুশীলন করছেন এমবাপ্পে। পিএসজি অধিনায়ক একা নন, তাঁর সঙ্গে আছেন ইউলিয়ান ড্রাক্সলার, জর্জিনিও ভাইনালডাম, লিয়ান্দ্রো পারেদেসরা। এসব খেলোয়াড় এখন পিএসজির সদর দরজার সামনে। অর্থাৎ ক্লাব তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেই আলাদা করেছে এবং সম্ভবত তাঁরা কোচ লুইস এনরিকের পরিকল্পনায়ও নেই। ফ্রান্সে এমন বিচ্ছিন্ন দলকে নাকি ‘লফট’ বলা হয়। বাংলায় এর কাছাকাছি অর্থ ‘মাচা’। বোঝাই যাচ্ছে, এই মাচা পিএসজির মূল দল থেকে আলাদা।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে পিএসজি কেন সেই বিচ্ছিন্ন দলে অনুশীলনের জন্য পাঠিয়েছে, সে কারণ এত দিনে সবার জানা। কিছুদিন আগে এমবাপ্পে পিএসজিকে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ক্লাব ছাড়তে চান। অর্থাৎ এমবাপ্পে পিএসজি ছাড়তে চান ‘ফ্রি এজেন্ট’ হিসেবে। যে খেলোয়াড়ের পেছনে এত বিনিয়োগ, সে খেলোয়াড়ই যদি ফ্রি এজেন্ট হিসেবে চলে যান, তাহলে ক্লাবের কী লাভ?
এমন চিন্তা থেকেই পিএসজি তাঁকে চুক্তির মেয়াদের মধ্যেই বিক্রি করে দিতে চায়, যেন কিছু টাকা ঘরে আসে। আরেকটি পথ খোলা আছে। এমবাপ্পেকে চুক্তি নবায়ন করতে হবে। সেটা শুধু এমবাপ্পেই পারবেন এবং তা করতে হবে ৩১ জুলাই অর্থাৎ আগামী সোমবারের মধ্যে। ফরাসি তারকা যেহেতু চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি নন, তাই তাঁকে সেই ‘বম্ব স্কোয়াড’–এ পাঠানো হয়েছে। অনুচ্চারে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, হয় চুক্তি নবায়ন করো নতুবা টাকার বিনিময়ে তোমাকে বেচে দেওয়া হবে। আল হিলালের ৩০ কোটি ইউরোর প্রস্তাবও আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, পিএসজি কি আইনগতভাবে এই পথে হাঁটতে পারে? ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
ফ্রান্সের পেশাদার ফুটবলারদের সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব প্রফেশনাল ফুটবলার (ইউএনএফপি) এমবাপ্পে–পিএসজি পরিস্থিতি নিয়ে গত শনিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে। ফ্রান্সে শ্রমিক আইনের অধীনে পিএসজি এমবাপ্পের চুক্তি নিয়ে আইন লংঘন করে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে ইউএনএফপি—এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে এবং পিএসজি আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
পিএসজি মনে করছে, এমবাপ্পেকে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের ‘মাচা’য় তুলে তারা কোনো আইন ভাঙেনি। তবে পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয়, তাহলে আইনি বিষয়াদি আলোচনায় উঠে আসবে। এবার এমবাপ্পের জন্য সৌদি আরব থেকে যে প্রস্তাব এসেছে, তা আরেকবার জেনে নেওয়া যাক। সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলাল ৩০ কোটি ইউরোয় তাঁকে কিনতে চায় এবং এক মৌসুমের জন্যই ৭০ কোটি ইউরো পারিশ্রমিক দিতে চায় এমবাপ্পেকে।
পারিশ্রমিকের অঙ্কটা এখনো নিশ্চিত নয়, তবে সংখ্যাটা চোখ কচলে দেখার মতো। এদিকে এমবাপ্পে পিএসজিতে তাঁর বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ করে ক্লাব ছাড়তে চান। এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। তবে আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে, আগামী পুরো মৌসুম এমবাপ্পে যদি পিএসজিতে থাকেন, তাহলে তাঁকে আনুগাত্য বোনাস ছয় কোটি ইউরো দিতে হবে ফরাসি ক্লাবটিকে। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের খেলাধুলায় নিয়োগবিষয়ক আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ জানার চেষ্টা করেছে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পিএসজির ঝুঁকি কতটা এবং এমবাপ্পের অধিকারই বা কতুটুকু।
১৯৭৩ সালে ফ্রান্সের ফুটবলারদের ধর্মঘটের পর সবাইকে নিয়ে একটি সনদ বানানো হয়েছিল। ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন (এফএফএফ), পেশাদার ফুটবল লিগ (এলএফপি), ক্লাব, কোচ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, সেসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে সেই সনদে। ইউএনএফপি নিজেদের বিবৃতিতে এই সনদের কথাও উল্লেখ করেছিল। এই সনদের ৫০৭ নম্বর অনুচ্ছেদ সরাসরি সেই ‘লফট’ এবং ‘বম্ব স্কোয়াড’–এর খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। খেলাধুলাবিষয়ক আইনজীবী লঁরা ফেলোস এই ধারা ব্যাখ্যা করে বলেন, ১ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর দলবদলের মৌসুমে ৫০৭ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে ক্লাব এমন স্কোয়াড গঠন করতে পারে এবং ক্লাব ‘চাইলে কিছু খেলোয়াড়কে “লফট” বানাতে পারে। তবে ২ সেপ্টেম্বর থেকে এটি আর বলবৎ থাকবে না।’
এই বিশেষ গুচ্ছের খেলোয়াড়দের প্রয়োজনীয় অনুশীলনের ব্যবস্থা, চিকিৎসাসেবা এবং কোচরা দেখভাল করলে ‘ফ্রেঞ্চ ফুটবল চার্টার’ (সনদ)–এর অধীনে আইনগত কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু ২ সেপ্টেম্বর থেকে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫০৭ নম্বর অনুচ্ছেদের ২.২ ধারার অধীনে যথোপযুক্ত জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। লঁরা ফেলোসের ব্যাখ্যা, ‘তাদের রিজার্ভ দলে রাখলে সেটা ক্ষণস্থায়ী হতে হবে। আর এক পাশে সরিয়ে রাখা এসব খেলোয়াড়ের সংখ্যা অন্তত ১০ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন সিদ্ধান্তের খেলাধুলাগত কারণ থাকতে হবে, যেটা বিশেষভাবে ব্যাখ্যাও করতে হবে।
আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে তাঁর যথাযথ জায়গায় না রাখাটা কঠিন হবে, ২ সেপ্টেম্বরের পর থেকেও যদি এমন অবস্থা চলতে থাকে।’
এমন পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধানে লিগ আঁর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ আইনি কমিশন গঠন করা হয়েছিল এর আগে। সেখান থেকে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যায়। ২০১৯ সালে ফরাসি মিডফিল্ডার আদ্রিয়াঁ রাবিও পিএসজিতে চুক্তি নবায়ন করতে রাজি না হওয়ার পর তাঁকে শাস্তি হিসেবে রিজার্ভ দলের সঙ্গে অনুশীলনে পাঠানো হয়েছিল।
পিএসজির মূল দল যেসব সুবিধা পায় অনুশীলনে, রিজার্ভ দল তা পায় না। আইনি কমিশন বিষয়টি উত্থাপনের পর ইউএনএফপি পিএসজির এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল এবং রাবিওকে পরে মূল দলে ফেরানো হয়, তবে পিএসজির হয়ে সে মৌসুমে তিনি আর খেলার সুযোগ পাননি। এমবাপ্পের ক্ষেত্রে পিএসজি তাঁকে বিচ্ছিন্ন সেই দলের অংশ হিসেবে ১ সেপ্টেম্বরের পরে আর রাখতে পারবে না। তাতে ‘ফ্রেঞ্চ ফুটবল চার্টার’–এর আইন লঙ্ঘিত হবে।
ইউএনএফপি তাদের বিবৃতিতে আরেকটি আইনি বিষয় উত্থাপন করেছে—নৈতিক হয়রানি। বলা হয়েছে, ‘ইউএনএফপি ম্যানেজারদের এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে যে কর্মীর (খেলোয়াড়) ওপর চাপ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাজের পরিবেশের নিম্নমান—তাঁকে বের করে দেওয়া কিংবা মালিকপক্ষ যা চায়, তা মানতে বাধ্য করা নৈতিক হয়রানির শামিল। ফ্রান্সের আইন এ বিষয়ে খুব কঠোর। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে রিঁম আপিল চেম্বারের সিদ্ধান্ত দ্বারা বিষয়টি স্বীকৃত।’
এমবাপ্পেকে নিয়ে নৈতিক হয়রানির বিষয়টি ফ্রান্সের শ্রমিক আইনের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেছেন কর্মচারী নিয়োগবিষয়ক আইনের বিশেষজ্ঞ ডেবোরা ডেভিড, ‘এমবাপ্পে একজন নির্দিষ্ট মেয়াদের কর্মী, তিনি ফ্রান্সের শ্রমিক আইনের অধীনে আছেন এবং এই আইনের অধীনে নৈতিক হয়রানিতে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই হয়রানির আইনি ব্যাখ্যা হতে পারে কর্মীর কর্মপরিবেশ নষ্ট করা, অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন করা। মূল দল থেকে কোনো খেলোয়াড়কে আলাদা করাকে নৈতিক হয়রানি হিসেবে ধরা হতে পারে, কিংবা চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা।’
ফ্রান্সের ফুটবল চার্টার আইনে এমবাপ্পে নৈতিক হয়রানির সমাধান না পেলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। ফরাসি আইনে নৈতিক হয়রানি দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি ধারায় ৩০ হাজার ইউরো জরিমানার পাশাপাশি দুই বছর কারাবাসের শাস্তি হতে পারে। আর ফুটবল ক্লাবের ক্ষেত্রে জরিমানার অঙ্কটা হতে পারে পাঁচ গুণ। নৈতিক হয়রানির ক্ষেত্রে ‘অ্যাথলেটিক’ হাতেম বেন আরফার ঘটনার উদাহরণ টেনেছে।
২০১৭ সালে ১ সেপ্টেম্বরের পর বেন আরফাকে দুইবার রিজার্ভ দলে পাঠানো হয়েছিল। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তাঁকে দ্বিতীয়বারের মতো মূল দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। এ বছরের মার্চে প্যারিসের আপিল আদালত রায় দেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অন্য দলের প্রস্তাব গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে বেন আরফাকে রিজার্ভ দলে পাঠিয়েছিল পিএসজি। এটাকে নৈতিক হয়রানি হিসেবে দেখা হলেও রূপক ক্ষতিপূরণ হিসেবে পিএসজিকে মাত্র এক ইউরো জরিমানা করা হয়েছিল।
ডেবোরা ডেভিড বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘বেন আরফার বিষয়টিতে তাকালে আমরা বুঝতে পারি যে আদালত মনে করেন, একজন পেশাদার খেলোয়াড়কে আলাদা করে রাখাটা নৈতিক হয়রানি নয়। সে কোথায় থাকবে, তা ঠিক করার অধিকার আছে পিএসজির।’ তাই এমবাপ্পেকে ফেরানোর পর তাঁকে যদি বেঞ্চে রাখা হয়, সেটি নৈতিক হয়রানি হবে না।
এমবাপ্পে বনাম পিএসজি ‘ম্যাচ’ এখন কীভাবে নিষ্পত্তি হয়, সেটাই দেখার বিষয়।