লিভারপুল বলেই কি ইউনাইটেড এত ভালো খেলল

লিভারপুল–ইউনাইটেড ম্যাচে জেতেনি কেউইএএফপি

গতকাল সারা দিন অ্যানফিল্ড রোডের চারপাশ ছিল শুভ্র তুষারে ঢাকা। পথঘাট, মাঠের যেসব ছবি সামনে আসছিল, সাদা রং ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো রঙের যেন অস্তিত্বই নেই। সাদায় ছেয়ে যাওয়া অ্যানফিল্ডে লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হবে কি না তা নিয়েও ছিল শঙ্কা।

এমন মনমরা পরিবেশে কিছুটা প্রাণ ফেরালেন লিভারপুল ও ইউনাইটেডের দুই কিংবদন্তি জেমি ক্যারাঘার আর গ্যারি নেভিল। ম্যাচের আগে ভাইরাল এক ভিডিওতে ক্যারাঘারকে দেখা যায় মাঠের ভেতর থেকে বেলচা দিয়ে তুষারকণা বাইরে ফেলতে, আর নেভিল ভেতরে।

আরও পড়ুন

প্রতীকী এই  দৃশ্যের অর্থ ক্যারাঘার চান ম্যাচটা খেলা হোক, আর নেভিল চান না। একের সঙ্গে অবশ্য চৌদ্দর খেলতে চাওয়ার কথাও নয়! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ইউনাইটেড সমর্থকের মনোভাবটা এমন ছিল যে ম্যাচটা বাতিল হওয়াই ভালো। এই লিভারপুলের মুখোমুখি কে-ই-বা হতে চাইবে! গত সেপ্টেম্বরে ওল্ড ট্রাফোর্ডে গিয়ে তিন গোল দিয়ে এসেছিল আর্নে স্লটের দল, অ্যানফিল্ডে এবার কি না কি হয়!

ইউনাইটেডের ৭-০ গোলে হারের দুঃস্মৃতি তো এখনো খুব বেশি পুরোনো হয়নি। তারওপর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ৪ ম্যাচে হার। বোর্নমাউথের বিপক্ষেও হজম করতে হয়েছে তিন গোল। অন্য দিকে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা লিভারপুল সমর্থকরাও ছিল আরেকটি সহজ জয়ের অপেক্ষায়। ভাবটা এমন যে, এই ইউনাইটেড কি এমন আর প্রতিরোধ গড়বে!

ইউনাইটেডের বিপক্ষে আরও একবার গোল করলেন সালাহ
রয়টার্স

ম্যাচের শুরুতে জ্বলল না কোনো দলই। তুষারের শীতলতা যেন দুই দলের খেলোয়াড়দের পাগুলোকেও আড়ষ্ট করে রেখেছিল। ৪৫ মিনিটের খেলায় না চাইলেও যেমন কিছু সু্যোগ তৈরি হয়, এই ম্যাচের প্রথমার্ধেও তা-ই। আলাদা করে বলার মতো কিছুই নয়। এমনকি দুই দলে খেলা দেখে বিশেষ পার্থক্যও করা যাচ্ছিল না। দ্বৈরথের উত্তাপও যেন আড়াল হয়ে পড়েছে তুষার চাপায়।  

কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে কমে এল তুষারের প্রভাব। আড়ষ্টতা ভাঙল মোহাম্মদ সালাহ, কোডি গাকপো, ব্রুনো ফার্নান্দেজ আর আমাদ দিয়ালোদের পা। শুরুটা করেছিল ইউনাইটেডই। ঠান্ডা অ্যানফিল্ডকে আরও স্তব্ধ করে দিয়ে গোল করলেন লিসান্দ্রো মার্তিনেজ।

আরও পড়ুন

ঘরের মাঠে পয়েন্ট তালিকার ১৪ নম্বর দলের কাছ থেকে আগে গোল খেয়ে লিভারপুল খানিকটা হতচকিতই হয়ে গিয়েছিল। যদিও চ্যাম্পিয়ন মেজাজে ছুটতে থাকা লিভারপুল ঘুরে দাঁড়াতে দেরি করল না। গাকপো করলেন ট্রেডমার্ক গোল। এরপরের গোলটা সালাহর। ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচে সালাহ গোল না করলে হয় নাকি!

ইউনাইটেড কোচ রুবেন আমোরিম ও লিভারপুল কোচ আর্নে স্লট
রয়টার্স

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে গোলটা যেন মিসরিয় রাজার অধিকারে পরিণত হয়েছে। পেনাল্টি থেকে করা সালাহর গোলই এগিয়ে দিল লিভারপুলকে। এটি ইউনাইটেডের বিপক্ষে লিগে ১৫ ম্যাচে সালাহর ১৩তম গোল। আর সব মিলিয়ে ১৭ ম্যাচে ১৬।

এই গোল খেয়েই ইউনাইটেড জেগে উঠল অন্য মেজাজে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলটাকে হয়তো কেউ মনে করিয়ে দিয়েছিল, কাদের বিপক্ষে তারা খেলছে কিংবা ইতিহাসে এই ম্যাচের গুরুত্ব কেমন! তবে পেছনের কারণ যাই হোক, পরের সময়টুকুতে ইউনাইটেড বদলে যাওয়া এক দল। এ সময় পাসিংগুলো ছিল দুর্দান্ত।

ডিফেন্স ও গোলকিপিং ‘রক সলিড’। লিভারপুলের আক্রমণের ছাঁচগুলো ইউনাইটেড রক্ষণ ভেঙেছে দারুণভাবে। এমনকি বক্সের ভেতর কিছু ট্যাকল ছিল চোখে লেগে থাকার মতো। তবে আলাদা করে বলতে হবে গোলরক্ষক আন্দ্রে ওনানার কথা। নিশ্চিত কিছু গোলের সুযোগ নষ্ট করে ইউনাইটেডকে বাঁচিয়েছেন এই গোলরক্ষক।

আরও পড়ুন

রক্ষণে দৃঢ়তা দেখানোর পাশাপাশি এ সময় আক্রমণেও ভীতি ছড়াচ্ছিল ইউনাইটেড। এরপর ৮০ মিনিট গত মৌসুমে এফএ কাপ কোয়ার্টার ফাইনালের স্মৃতি ফিরিয়ে ইউনাইটেডকে সমতায় ফেরান আমাদ। তবে অ্যানফিল্ডে পাওয়া জয়ের সমান এই ড্র ম্যাচটাতে জিততেও পারত ইউনাইটেড। নিজেদের ডিফেন্সে অসংখ্যবার ‘প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের’ ভূমিকা পালন করা হ্যারি ম্যাগুয়ার সুযোগ পেয়েও জায়গামতো প্রকৃত স্ট্রাইকার হয়ে উঠতে পারলেন না। লিভারপুল বক্সের ভেতর শেষ মুহূর্তে তাঁর অবিশ্বাস্য মিসের কারণেই জয়টা ফেলে আসতে হয়েছে ইউনাইটেডকে।

আরও পড়ুন

শেষ পর্যন্ত টানা চার হারের পর গতকাল রাতেও জয়টা পায়নি ইউনাইটেড। ম্যাচ ড্র হয়েছে ২–২ গোলে। কিন্তু এরপরও লিভারপুলের বিপক্ষে তাদের পারফরম্যান্স দেখে কে বলবে, এই দলটা লিগে শেষ ৬ ম্যাচের ৫টাতেই হেরেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে কোন মন্ত্রবলে ইউনাইটেড এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল? একই প্রশ্ন ইউনাইটেড মিডফিল্ডার ব্রুনো ফার্নান্দেজেরও, ‘আমি কিছুটা হতাশ এই ভেবে যে আমরা যদি লিভারপুলের বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স করে দেখাতে পারি তবে প্রতি সপ্তাহে কেন পারি না?’

লিভারপুল–ইউনাইটেড ম্যাচের একটি মুহূর্ত
রয়টার্স

এর সম্ভাব্য সঠিক উত্তর হতে পারে, প্রতিপক্ষ লিভারপুল বলেই তারা পেরেছে, তারা পারে। ইউনাইটেড-লিভারপুল ম্যাচের গুরুত্ব ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত। দুই দলের দ্বৈরথের গল্পও রূপকথার গল্পের মতো। তাই হারতে হারতে পিষে যাওয়া ইউনাইটেডের যখন অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়, তখন তাদের হাত পাততে এই সব ম্যাচের কাছেই।

এই ম্যাচগুলোই হয়ে ওঠে ঘুরে দাঁড়ানোর টনিক। গতকাল রাতে লিভারপুল ম্যাচটা ইউনাইটেডের জন্য তেমন কিছু ছিল কি না সেটা হয়তো সময়ই বলবে। তবে কাল রাতের পারফরম্যান্সে ধারাটুকুও যদি ইউনাইটেড ধরে রাখতে পারে, তবে নিজেদের দুর্দশা কিছুটা হলেও ঘুচাতে পারবে তারা।