ফুটবল হারাল ‘গোলকিপার’ পোপকে

আর্জেন্টিনার ফুটবল ক্লাব সান লরেঞ্জোর সমর্থক ছিলেন পোপ ফ্রান্সিসসান লরেঞ্জোর এক্স হ্যান্ডল

‘দ্য টু পোপস’ সিনেমার শেষ দৃশ্য। পোপ বেনেডিক্ট ও পোপ ফ্রান্সিস একসঙ্গে বসে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখছেন। আর্জেন্টাইন পোপ ফ্রান্সিস অবশ্যই লিওনেল মেসিদের পক্ষে। জাতিতে জার্মান বেনেডিক্ট ফিলিপ লামদের পক্ষে। সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, নিজেদের দল নিয়ে ‘দুই পোপ’-এর মধ্যে খুনসুটি নিশ্চয়ই খুব মজা লেগেছে তাঁদের কাছে।

পরিচালক ফার্নান্দো মেইরেলেস ইউএসএ টুডেকে পরে জানান, দুই পোপের সিনেমায় খেলা দেখার দৃশ্যটি ‘বানানো’, কিন্তু সিনেমায় তাঁদের যে দার্শনিক দ্বন্দ্ব, সেটার ‘সবকিছু তাদের বক্তব্য, সাক্ষাৎকার ও লেখা থেকে নিয়ে সংলাপ সাজানো হয়েছে’।

মেইরেলেসের ভাষায়, ‘সিনেমায় তাঁরা যা বলেছেন, সেটা তাঁরা জীবনেরও কোনো এক পর্যায়ে বলেছেন।’

অর্থাৎ বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সময় সাবেক ও বর্তমান দুই পোপের মধ্যে যে খুনসুটি হয়েছে নিজ নিজ দল নিয়ে, সেই দর্শন তাঁরা মনের ভেতর ধারণ করেন। পোপ ফ্রান্সিসের ফুটবলপ্রেম অবশ্য প্রায় সবারই জানা। ভ্যাটিকান প্রাসাদে লিওনেল মেসি, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ থেকে জিয়ানলুইজি বুফনরা গেছেন পোপ ফ্রান্সিসের দর্শনপ্রার্থী হয়ে। পোপ ফ্রান্সিস শুধু তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করেই নেননি, প্রচুর জার্সি ও বলেও সই করেছেন।

ফুটবলের প্রতি পোপ ফ্রান্সিসের ভালোবাসাটা শৈশব থেকেই। বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় ছেঁড়া ও পুরোনো কাপড় দিয়ে বানানো ফুটবল খেলার স্মৃতিচারণা বহুবার উঠে এসেছে তাঁর মুখে। তখন তাঁর নাম ছিল জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হয়ে নতুন নাম নেন ফ্রান্সিস।

ফুটবলকে সব সময়ই ভালোবেসেছেন পোপ ফ্রান্সিস
এএফপি

শৈশবের সেই খেলার স্মৃতিচারণায় এই রোমান ক্যাথলিক ধর্মগুরু জানিয়েছিলেন, তিনি ‘সেরাদের কাতারে ছিলেন না’ এবং গোলকিপার হিসেবে খেলতেন। এ পজিশনে খেলা নিয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শনও আছে, ‘যেকোনো জায়গা থেকে বিপদ এলে কীভাবে সামলাতে হবে’, সেটা শেখার জন্য গোলকিপিং পজিশনটি নাকি বেশ ভালো। কিন্তু যে বিপদ আজ এল, পোপ ফ্রান্সিস তা এড়াতে পারেননি। কেউই তা পারে না। ৮৮ বছর বয়সে আজ ভ্যাটিকানে স্থানীয় সময় সকালে মারা গেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তাঁর মৃত্যুতে আজ ইতালিয়ান সিরি আ–তে সব ম্যাচ স্থগিত করা হয়েছে।

সান লরেঞ্জোতে তার পর থেকেই শোকের আবহ। আর্জেন্টিনার প্রিমেরা লিগের এ ক্লাবের সবচেয়ে বিখ্যাত সমর্থক এই পোপ ফ্রান্সিস। এই ক্লাবকে সমর্থনের কথা এর আগে অকপটে বলেছেন। মৃত্যুর পর ক্লাবটির জার্সি হাতে পোপের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছে সান লরেঞ্জো। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘তিনি কখনোই শুধু আমাদের একজন ছিলেন না, তিনি সব সময়ই আমাদের একজন। তিনি শৈশবে “কুয়েরভো”(সান লরেঞ্জো এ নামে পরিচিত), বড় হয়েও কুয়েরভো...পাদরি ও কার্ডিনাল হয়েও কুয়েরভো...পোপ হয়েও কুয়েরভো...সদস্য নম্বর ৮৮২৩৫...জর্জ মারিও বারগোগ্লিও থেকে পোপ হওয়ার পথে “সাইক্লোনের” (সান লরেঞ্জো এ নামেও পরিচিত) প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো পাল্টায়নি। খুব গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা পোপ ফ্রান্সিসকে বিদায় জানাচ্ছি। ধন্যবাদ এবং আবারও দেখা হবে ওপারে অনন্তকালের জন্য।’

পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম ১৯৩৬ সালে বুয়েনস এইরেসে। ১০ বছর বয়সে সান লরেঞ্জোর ম্যাচ দেখতে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করেছিলেন একবার, ‘বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের চ্যাম্পিয়নশিপ মনে আছে, যেটা আমার দল সান লরেঞ্জো জিতেছিল। সেসব দিনগুলোয় ফুটবলারদের খেলা দেখে বাড়ি ফেরার পথে আমরা ছোটরা বিমল আনন্দ লাভ করেছি। রক্তে অ্যাড্রেনালিন ও চোখেমুখে আনন্দ প্রতিফলিত হতো।’ পোপ ফ্রান্সিসের কাছে তাঁর ফুটবলকে ভালোবাসার সেই সময় ‘রোমান্টিক ফুটবল’।

সান লরেঞ্জোর ’৪৬–এর সে দলের আর্মান্দো ফারো, রেনে পন্তোনি ও রিনালদো মার্তিনোরা শিশু মারিও বারগোগ্লিওর (পোপ ফ্রান্সিস) মনে চিরকালের মতো গেঁথে গিয়েছিলেন। ক্লাবটির শতবর্ষপূর্তিতে স্থানীয় গির্জায় বক্তব্যও দিয়েছেন। পোপ হওয়ার পর ভ্যাটিকানের নিয়ম ভেঙে সান লরেঞ্জোর প্রতি ভালোবাসাও প্রকাশ করেছেন অকপটে। খেলোয়াড় ও কোচদের স্বাগত জানিয়েছেন, ‘প্রার্থনাও করেছেন দলটির জন্য’। তিনিই একমাত্র পোপ, যিনি একটি ফুটবল ক্লাবের কার্ড আমৃত্যু নিজের কাছে রেখেছেন—আইডি নম্বর ৮৮২৩৫।

পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ম্যারাডোনা
এএফপি

সান লরেঞ্জোর আরেকটি নামও কিন্তু ‘দ্য সেন্টস’। তবে ভ্যাটিকানের শিক্ষামূলক পার্টনারশিপের অংশ হিসেবে পোপ ফ্রান্সিস সান লরেঞ্জোর প্রতিদ্বন্দ্বী বোকা জুনিয়র্সের সদস্য কার্ড নেওয়ায় ‘সেন্টস’ সমর্থকদের রোষানলেও পড়েছিলেন। পোপ হয়ে সান লরেঞ্জোর খোঁজখবর তিনি কীভাবে রাখতেন, সেটা একটা প্রশ্ন। উত্তর হলো, ভ্যাটিকানের সুইস গার্ডদের একজন সদস্য লিগ টেবিলে সান লরেঞ্জোর অবস্থান ও ফল নিয়মিত পোপ ফ্রান্সিসের ডেস্কে রাখতেন। ফুটবলকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন, সেটার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ২০১৯ সালের একটি মন্তব্য, ‘অনেকে বলেন, ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলা। আমিও তা–ই মনে করি।’

সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনাও সাক্ষাৎ পেয়েছেন পোপ ফ্রান্সিসের। ইতালিয়ান টিভি রাই ১–এ জিয়ান মার্কো চিওচ্চিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে কাকে তাঁর পছন্দ? মেসি ও ম্যারাডোনাকে উদ্ধৃত করে প্রশ্নটি করা হয়েছিল এবং পোপ ফ্রান্সিসের উত্তর এখনো মনে রেখেছেন অনেকে, ‘আমি তৃতীয় একজনকেও রাখব, পেলে।’ ফ্রান্সিস আরও বলেছিলেন, ‘এই তিন ফুটবলারকে আমি অনুসরণ করেছি, তিনজনই নিজ নিজ প্রতিভায় গ্রেট। এ মুহূর্তে সেটা মেসি।’

ব্রাজিলের হয়ে তিনবার বিশ্বকাপজয়ী প্রয়াত কিংবদন্তি পেলের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেছেন পোপ ফ্রান্সিস, ‘তিনি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। বুয়েনস এইরেসে বিমানে দেখা হয়, আমি কথা বলেছি তার সঙ্গে। অবিশ্বাস্য মানুষ।’

লিওনেল মেসিও দেখা করেছেন পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে
এএফপি

‘দ্য টু পোপস’ সিনেমার শেষে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার যে দৃশ্যের কথা লেখায় বলা হয়েছে, সেটা কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি। পোপ ফ্রান্সিস ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেননি। এ নিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘আমি ফাইনাল দেখিনি। ছয়জন আলিতালিয়া (ইতালিয়ান এয়ারলাইন) পাইলট এবং তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে ছিলাম। একপর্যায়ে কিছু একটা নিতে সেখান থেকে উঠে যাই। ফিরে আসার পর তাঁদের একজন বলেছেন, “তারা ৩-০ কিংবা ২-০ অথবা ৩-১ গোলে জিতবে”—সঠিক মনে নেই...আমি নিজেও আর্জেন্টাইন। এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল...আর্জেন্টাইনদের ভেতরে এটা আছে। উৎসাহের সঙ্গে সবকিছু শুরুর সংস্কৃতিটা আমাদের আছে, কিন্তু মাঝপথে এসে হাল ছেড়ে দিই। সময় হওয়া কিংবা জয়ের আগেই আমরা হাল ছেড়ে দিই। সেটা হোক ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক বিষয়। আমাদের কোনো কিছু শেষ করতে সমস্যা হয়।’

সেই ফাইনাল না দেখার আরও একটি কারণ হয়তো ১৯৯০ সাল থেকে পোপ ফ্রান্সিসের টিভি দেখা ছেড়ে দেওয়া। ২০১৪ সালে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা ও ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলারদের এক প্রীতি ম্যাচে ম্যারাডোনার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় পোপ ফ্রান্সিসের। ‘ফ্রান্সিস’ লেখা আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি ধর্মগুরুকে উপহার দিয়েছিলেন ’৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তি। পরেও ম্যারাডোনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

ম্যারাডোনা যখন অসুস্থ, তাঁর খোঁজখবরও রেখেছেন। আর্জেন্টিনার ’৮৬ বিশ্বকাপ জয়ও কিন্তু তিনি দেখেননি। সেই ফাইনাল নিয়ে বলেছিলেন, ‘১৯৮৬ বিশ্বকাপ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে, যেটা আর্জেন্টিনা জিতেছে। ম্যারাডোনাকে ধন্যবাদ। আমি ফ্রাঙ্কফুর্টে ছিলাম। ভাষা শিখছিলাম এবং থিসিসের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। বিশ্বকাপ ফাইনাল আমি দেখতে পারিনি। পরের দিন জার্মান ভাষার ক্লাসে এক জাপানি মেয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে “ভিভা আর্জেন্টিনা” লেখার পর জেনেছি, আর্জেন্টিনা জিতেছে। সেই বিজয়কে আমি একাকিত্বের বিজয় হিসেবে মনে রেখেছি; কারণ, আনন্দটা ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ ছিল না।’

২০১৪ সালে সান লরেঞ্জো কোপা লিবার্তোদোরেস জেতার পর পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করেন ক্লাবটির খেলোয়াড়েরা
এএফপি

মেসির সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিসের দেখা হয়েছিল তিনি পোপ পদে আসীন হওয়ার কয়েক মাস পর। পোপকে সম্মান জানিয়ে ইতালির সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল আর্জেন্টিনা। চোট পাওয়া মেসি এবং আর্জেন্টিনা দলের বাকিদের সঙ্গে ভ্যাটিকানের ক্লেমেন্তাইন হলে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট দেখা করেন পোপ ফ্রান্সিস। আর্জেন্টিনা দলের পক্ষ থেকে তাঁকে রুপার পাত্র, পন্তোনির (ফ্রান্সিসের শৈশবের ফুটবল নায়ক) তৈলচিত্র, সব খেলোয়াড়ের সই করা জাতীয় দলের জার্সি এবং ম্যাচ নিয়ে একটি সাময়িকী উপহার দেওয়া হয়। মেসিকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ এক ছেলে, যে নিজের অহমকে প্রদর্শন করে না।’ পিএসজিতে থাকতেও পোপ ফ্রান্সিসকে একটি জার্সি উপহার পাঠান মেসি।

গত বছর প্রকাশিত আত্মজীবনীতে পোপ ফ্রান্সিস একটি অধ্যায় ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করেন। ’৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল নিয়ে ফুটবল কিংবদন্তির সঙ্গে মজার একটি ঘটনা গত বছর জানিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস, ‘পোপ থাকাকালে আমি কয়েক বছর আগে ভ্যাটিকানে ম্যারাডোনাকে বরণ করে নিই। মজা করে জানতে চেয়েছিলাম, তোমার পাপী হাত কোনটি?’

২০২২ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে দুই দল আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের প্রতি পোপ ফ্রান্সিসের আহ্বান ছিল, জয়ী দল যেন ‘নম্রতা’ বজায় রেখে উদ্‌যাপন করে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আর্জেন্টিনা পোপের আহ্বান পুরোপুরি রাখতে পারেনি। তাতে কি তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন? সেটি জানা যায়নি। তবে আনন্দ যে পেয়েছিলেন, তা তো এমনিতেই বোঝা যায়। একজন ফুটবলপ্রেমী আর্জেন্টাইন বিশ্বজয়ে খুশি না হয়ে পারেন না!

বিদায় পোপ ফ্রান্সিস। আপনার পূর্বসূরিদের বেশির ভাগই শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতে ও বই পড়তে ভালোবাসতেন। পোপ হয়েও যে ফুটবলকে ভালোবাসা যায়, এ উদাহরণে ’৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর আপনার যেমন একা লেগেছিল, তেমনি এখানেও আপনি সম্ভবত একাই।