ভিনিসিয়ুসই কেন বারবার বর্ণবাদের শিকার
কথাটা জনপ্রিয় করেছিলেন মারিও বালোতেল্লি। ২০১১–১২ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৬–১ গোলে বিধ্বস্তের ম্যাচে গোল করে জার্সি তুলে ভেতরের টি–শার্টে লেখা একটি কথা দেখিয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকার মারিও বালোতেল্লি—‘হোয়াই অলওয়েজ মি?’
ইতালিয়ান স্ট্রাইকারের ক্যারিয়ারে বিতর্কের অভাব নেই। সব সময় বিতর্কের কেন্দ্রে থাকায় তিতিবিরক্ত হয়ে কথাটা লিখে এনেছিলেন বালোতেল্লি। কিন্তু ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে এমন কিছুই করতে হচ্ছে না। স্প্যানিশ ফুটবলে গত এক–দুই বছরে তাঁকে নিয়ে যা ঘটছে, প্রশ্নটা এমনিতেই উঠছে—কেন ভিনিসিয়ুসকেই বারবার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হচ্ছে?
রোববার রাতের কথাই ধরুন। ভ্যালেন্সিয়ার মাঠ মেস্তায়ায় রিয়াল মাদ্রিদের ১–০ গোলে হারের ম্যাচে বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন ব্রাজিল উইঙ্গার। গ্যালারি থেকে তাঁকে ‘বানর’ বলে কটূক্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে ফুটবল–বিশ্বে। ফিফা সভাপতি থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, সাবেক ও বর্তমান তারকাদের অনেকে ভিনির পক্ষে অবস্থান নিয়ে গর্জে উঠেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, ফিফা সভাপতি নিজেই বলেছেন, ‘ফুটবলে বর্ণবাদের কোনো স্থান নেই।’
কিন্তু এক মৌসুমেই কোনো খেলোয়াড় যদি সাতবার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হন এবং তাঁর কোনো শাস্তি বিধান যদি না হয়, তখন তো পাল্টা প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এমন হচ্ছে? কেন ভিনিসিয়ুসই টার্গেট?
গত ফেব্রুয়ারিতে রিয়াল মায়োর্কার সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভিনিসিয়ুস বর্ণবাদের অভিযোগ তোলার পর রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝি না ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে কেমন এমন করা হচ্ছে। সমস্যাটা ভিনিসিয়ুসের, সেটা মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তা নয়।’
ভিনিসিয়ুসের প্রতি স্প্যানিশ ফুটবলপ্রেমীদের বিরক্তির কারণ এর আগে খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি। নির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে না পারলেও দু–একটি ঘটনা সামনে আনা হয়েছে—সেসব কারণই ভিনি বনাম স্প্যানিশ ফুটবলপ্রেমী—‘লড়াই’ উসকে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে স্পেনের টিভি অনুষ্ঠান ‘চিরিনগুইতো শো’–তে স্পেনের ফুটবল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (এইএএফ) প্রধান পেদ্রো ব্রাভো বলেছিলেন, ভিনিসিয়ুসের গোল উদ্যাপন বানরের মতো, ‘প্রতিপক্ষকে সম্মান করতে হবে। নাচতে চাইলে ব্রাজিলে যাও। স্পেনে বানরের মতো আচরণ থামিয়ে প্রতিপক্ষকে সম্মান করতে হবে।’
ভিনিসিয়ুসও ভিডিও বার্তায় কড়া উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি ‘নাচ থামাবেন না’ এবং ‘ইউরোপে একজন কালো ব্রাজিলিয়ানের সফলতা পেয়ে খুশি থাকাটা’ অনেকের কাছে ‘বিরক্তির কারণ’ বলেও মন্তব্য করেন। অনেকের মতেই, ভিনি সেই কড়া জবাব স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশের পর ব্রাজিলিয়ান তারকা স্প্যানিশ ফুটবলপ্রেমীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
স্পেনের ফুটবল সংবাদকর্মী গিয়েম বালাগ বিবিসিকে এর আগে একবার বলেছিলেন, ভিনিসিয়ুস বর্ণবাদী আচরণের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যমের দায়ও আছে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘সংবাদমাধ্যম এ বিষয়টি ভালোভাবে সামলাতে পারেনি। তারা এটাকে বিতর্কের অংশ বানিয়েছে।’
বালাগ মনে করেন, সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছে এভাবে, ‘যা ঘটছে সে জন্য দোষ কি ভিনিসিয়ুসেরই? তার ড্রিবলিং ও উসকানিমূলক উদ্যাপনের কারণেই কি স্টেডিয়ামগুলোয় বর্ণবাদী আচরণ হচ্ছে? কিন্তু এমন কোনো বিতর্ক হওয়া অনুচিত।’
বালাগ খেলোয়াড় ও স্পেনের ফুটবলপ্রেমীদের দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যারা বলে এটা ভিনিসিয়ুসের কারণেই, তারা আসলে পরিসংখ্যান দেখে—ভিনিসিয়ুস ৯ ম্যাচে গোল করতে পারেনি। তাকে বিরক্ত করলে খারাপ খেলে আর তাই খেলোয়াড় ও ভক্তরা মিলে তাকে বিরক্ত করে যেন বাজে খেলে। কী ভয়াবহ ব্যাপার—এটার (বাজে খেলা) জন্য সবকিছু বলা বৈধ, এমনকি সেটা বর্ণবাদী আচরণও।’
স্পেনের সংবাদমাধ্যম ‘এএস’ জানিয়েছে, ২০২১ থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১০ বার স্প্যানিশ ফুটবলে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন ভিনিসিয়ুস। এ মৌসুমের হিসাবটা আরও ভয়ংকর। বিবিসি জানিয়েছে, শুধু এ মৌসুমেই ৭ বার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন রিয়াল উইঙ্গার। কখনো তাঁকে ‘বানর’ বলা হয়েছে, কখনোবা ‘মরো’—ভিনিসিয়ুসের জার্সি পরা পুতুলকে ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখার ছবিসহ ব্যানারও দেখা গেছে গ্যালারিতে। পত্রপত্রিকায়ও এসব প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি। ভিনিসিয়ুস প্রতিটি ঘটনাতেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বর্ণবাদী আচরণের শিকার হলে এর প্রতিবাদ জানানোর অধিকার আছে সবারই, শুধু খেলোয়াড় নয়। এখন প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অন্য কারও সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেছেন কি না, সেটা দেখার বিষয়। ভিনিকে নিয়ে এখনো এমন কিছু জানা বা দেখা যায়নি। সে হিসেবে স্পেনে ভিনি এখন কিছুটা কোণঠাসাই। প্রতিবাদ জানিয়ে যে আরও বেশি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হচ্ছে! সেই যে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ‘নাচ থামাবেন না’ বলে পাল্টা অবস্থান নিলেন, এর পর থেকে এ পর্যন্ত বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন পাঁচবার!
বিবিসিতে বালাগ তাঁর কলামে লিখেছেন, ধারাবাহিকভাবে বর্ণবাদী আচরণ সহ্য না করে ভিনি ঠিক কাজটাই করেছেন। স্প্যানিশ ফুটবলপ্রেমীদের মানসিকতাও ব্যাখ্যা করেছেন বালাগ। তাঁর মতে, ফুটবলে এক দলের সমর্থকেরা অন্য দলের সমর্থকদের নানাভাবে খুঁচিয়ে থাকেন, সেসব বন্ধুত্বপূর্ণ শ্লেষ কিংবা খোঁচা হলেও স্প্যানিশরা ভাবনায় একটু আলাদা। তারা বর্ণবাদী আচরণকেও এসবের অংশ বলে মনে করে আর তাই স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ তাদের কাছে স্বাভাবিক।
বর্ণবাদ নিয়ে স্পেনের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বালাগ, ‘লা লিগা যে চেষ্টা করছে তার বাইরে আমার মনে হয় না কারও এ বিষয়টি থামানোর আগ্রহ আছে। সামাজিকভাবে কেউ এটাকে জরুরি বলে মনে করে না। অনেকেই এ জন্য ভিনিসিয়ুসকে দোষারোপ করে।’
তাহলে স্পেনের খেলাধুলাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম কেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নেয় না? বালাগের ব্যাখ্যা, ‘ফুটবলভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের কাছে এটা কোনো সিরিয়াস বিষয় না। এটাকে (বর্ণবাদ) মাঠের বাইরে নিয়ে কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে চায় না। ব্রিটেনে এটা প্রতিদিনের আলোচনার বিষয় হলেও স্পেন কিংবা ইতালিতে নয়।’
অথচ স্পেনে বর্ণবাদের আইন বেশ কড়া। জেল পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ভিনিসিয়ুসের আগের ৯টি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার ঘটনায় কোনো শাস্তি বিধান হয়নি। প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে গেছে কিংবা বিচারক বর্ণবাদী আচরণের মতো কিছু খুঁজে পাননি। কেউ কেউ আবার এক কাঠি সরেস। স্পেনে বর্ণবাদকে ফুটবলের বাণিজ্যিক ভাষা বলেও মনে করেন কেউ কেউ। বালাগ স্পষ্ট করেই লিখেছেন, ‘স্পেনের বিচার বিভাগে বর্ণবাদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।’
স্পেনে বর্ণবাদকে যেহেতু কেউ সেভাবে আমলে নেয় না, তাই মাঠে নামলেই এর শিকার হচ্ছেন ভিনিসিয়ুস। ব্যাপারটা এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে যে ইউরোপিয়ান ফুটবল সংবাদকর্মী জুলিয়ান লরেন্স বলেই ফেলেন, ‘ফুটবলের আধুনিক সময়ে আর কোনো খেলোয়াড় মাঠে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের তুলনায় মাঠের বাইরে প্রতিপক্ষ দর্শকদের দ্বারা এত বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’
আর কারও জানা আছে?