নেপালি ভাষায় স্টেডিয়ামকে বলে রঙ্গশালা। কাঠমান্ডুর ত্রিপুরেশ্বরে অবস্থিত রঙ্গশালায় আজ নিজেদের রাঙিয়ে নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফের ষষ্ঠ আসরে দ্বিতীয়বার ফাইনালে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে শিলিগুড়ি সাফের ফাইনালে ভারতের কাছে ৩-১ গোলে হেরে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় পুড়েছিলেন সাবিনা খাতুনেরা। আজ সুযোগটা মোটেও নষ্ট করতে চান না মেয়েরা।
ফাইনালে আজ বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক নেপাল। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে শুরু খেলা। এমনিতেই নেপালে ফুটবল খুব জনপ্রিয়। এর ওপর দেশের মেয়েরা ফুটবল খেলবে। দুপুরের পর থেকেই স্টেডিয়ামে ঢল নামবে দর্শকের। এরই মধ্যে টিকিট নিয়ে শুরু হয়ে গেছে কাড়াকাড়ি।
সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে প্রায় হাজার দশেক দর্শকের উন্মাদনা ছিল গ্যালারিতে। ১৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার দশরথ স্টেডিয়ামে আজ বিকেলে যে গ্যালারি উপচে পড়বে, তা না বললেও চলে।
বাংলাদেশের মেয়েরা তাই নেপালের ১১ জনের বিপক্ষেই খেলবে না, দ্বাদশ খেলোয়াড় হয়ে গ্যালারিতে থাকবে নেপালিরাও।
বাংলাদেশের জন্য আশার খবর, নেপালের সেরা ফরোয়ার্ড সাবিত্রা ভান্ডারিকে আজ নাও পেতে পারে দলটি। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে জোড়া গোল করার পরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তিনি।
গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে নেপালের কোচ কুমার থাপা স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় কথা হয় এই প্রতিবেদকের। অধিনায়ক আনজিলা তুমবাপো সুব্বাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই শুভেচ্ছা বিনিময় হয় তাঁর সঙ্গে।
সে সময় সাবিত্রার বর্তমান অবস্থা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি যা বলেছেন, সেটার সারমর্ম এ রকম—সাবিত্রার জ্বর সারলেও শরীর ভীষণ দুর্বল। এই অবস্থায় তাঁকে খেলানোর ঝুঁকিটা কতখানি নেবেন কোচ, সেটা নিয়ে সংশয় আছে।
টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই বৃষ্টি খেলার ছন্দ নষ্ট করেছে। কাঠমান্ডুর আকাশে সারাক্ষণই চলে মেঘ আর বৃষ্টির লুকোচুরি। তবে আজ যেন দিনটা বাংলাদেশের পক্ষেই কথা বলছে। সকাল থেকেই কাঠমান্ডুর আকাশ রোদ–ঝলমলে। যদি বিকেল পর্যন্ত কোনো বৃষ্টি না হয়, তাহলে মাঠ ভারী হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই থাকবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারবে।
বাংলাদেশ কোচ গোলাম রব্বানী সাফের গত চারটি ম্যাচেই একই একাদশ খেলাচ্ছেন। এই একাদশের মেয়েরাই কোচকে এনে দিচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত ফল। কোচের দর্শনই হচ্ছে, দ্রুত গোল বের করে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেওয়া। আজও মেয়েদের কাছে একই বার্তা দিয়েছেন রব্বানী।
গত চার ম্যাচে শুধু মালদ্বীপের বিপক্ষে গোল পেতেই একটু দেরি হয়েছিল বাংলাদেশের। ৭ সেপ্টেম্বর গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ৩২ মিনিটে গোল পান সাবিনা। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ জেতে ৩-০ ব্যবধানে।
এরপর ১০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ মিনিটেই গোল বের করেন মনিকা চাকমা। সেদিন পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ১২ মিনিটে ভারতের জালে বল জড়ান সিরাত জাহান। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে ২ মিনিটেই গোল করেন সিরাত।
জয়ের জন্য যে ১১ জন মেয়ে আজ মাঠে লড়বেন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক তাঁদের পারফরম্যান্স :
রুপনা চাকমা: বাংলাদেশের গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্র প্রহরী রুপনা। এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এখন পর্যন্ত কোনো গোল খায়নি বাংলাদেশ। এর বড় কৃতিত্ব রাঙামাটির এই গোলকিপারের।
আঁখি খাতুন: ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার বিশালদেহী এই ডিফেন্ডারের কাছ থেকে বল কেড়ে বক্সে ঢোকার ক্ষমতা খুব কম ফরোয়ার্ডেরই আছে। মাঝেমধ্যে ওভারল্যাপিং করে আঁখি আতঙ্ক ছড়ান প্রতিপক্ষের বক্সেও। ম্যাচে আঁখির বাড়ানো লং বল কার্যকর হয়ে থাকে প্রায়ই। নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় নেই একটিও। ৮ ম্যাচে ৬ হার, ২ ড্র। তবে ২০১৮ সালে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে নেপালের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্রয়ে ১টি গোল আঁখির। ম্যাচের যোগ হওয়া সময়ে কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেডে গোল করেছিলেন তিনি। আজও নিশ্চয়ই তাঁর দিকে চেয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
মাসুরা পারভীন: ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফুটবলারেরও দায়িত্ব রক্ষণ সামলানো। তবে মাসুরাও মাঝেমধ্যে দলের প্রয়োজনে গোল করেন। এবারও করেছেন ২টি গোল। একটি মালদ্বীপের বিপক্ষে, অন্যটি ভুটানের জালে।
শিউলি আজিম: বল নিয়ে বক্সে ঢোকার মুখে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের বড় বাধা হতে পারেন শিউলি। ভারতের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন তিনি।
শামসুন্নাহার: কোচ একসময় তাঁকে উইঙ্গার হিসেবে খেলাতেন। তবে দলের প্রয়োজনে বেশির ভাগ সময়ই রক্ষণ সামলে থাকেন। দ্রুতগতির এই ফুটবালের দিকেও চোখ রাখতে পারেন।
মনিকা চাকমা: বাংলাদেশের মাঝমাঠের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নাম মনিকা। ড্রিবলিং করে দ্রুত বক্সে ঢুকতে পারেন। ফরোয়ার্ডদের জন্য গোলের সুযোগ তৈরি করায় জুড়ি নেই মনিকার।
মারিয়া মান্দা: মাঝমাঠে কোচের আরেক আস্থার নাম মারিয়া। ভারতের বিপক্ষে যেখানেই বল, সেখানেই ছিলেন মারিয়া। মাঝমাঠ থেকে দুই উইংয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন খেলা।
সানজিদা আক্তার: কোচ সানজিদাকে রাইট উইংয়ে খেলিয়ে থাকেন। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে যে ক্রসগুলো বক্সে ফেলেন, সেগুলো ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে অনেকটাই।
কৃষ্ণা রানী সরকার: দ্রুতগতির, চতুর ও বুদ্ধিমতী এই স্ট্রাইকার এরই মধ্যে গোল পেয়েছেন দুটি। আজও নিশ্চয়ই গোলের খোঁজে থাকবেন।
সাবিনা খাতুন: স্ট্রাইকার সাবিনাকে কখনো কখনো কোচ দলের প্রয়োজনে পজিশন বদলিয়ে একটু পেছনে খেলান কোচ। অভিজ্ঞ এই স্ট্রাইকার সর্বোচ্চ ৮ গোল করে প্রতিপক্ষের রক্ষণের জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন।
সিরাত জাহান: পারফেক্ট নাম্বার টেন এই ফুটবলার অবশ্য ৪ গোল করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। সেমিফাইনালে চোট লাগায় তাঁর খেলা নিয়ে একটু সংশয় আছে আজ। তবে কোচ ম্যাচের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান সিরাতের জন্য।