একটা চিৎকার: গার্দিওলার সঙ্গে যেভাবে মিলল ১৩১ বছর আগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম
দৃশ্য অনেক সময় শব্দেরও অধিক অর্থ বহন করে। সেই বিশেষ দৃশ্যগুলো এমন কিছু বলে, যা বোঝাতে শব্দকে হয়তো অনেক কসরত করতে হয়। দৃশ্য হয়তো আড়ালে থাকা পুরোটাকে উন্মোচন করতে পারে না। কিন্তু কথাও আর কতটাই বা রহস্যের পর্দা খুলতে পারে? আর এই না পারার কারণেই বারবার আমাদের হাত পাততে হয় দৃশ্যের কাছে। ওই যে জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত সেই লাইনটার মতো, ‘তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।’
শুধু জন্ম নয়, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তিও হতে পারে বারবার। এমন না যে সেই পুনরাবৃত্তি খুব সচেতনভাবে হবে। অবচেতনে তুমুল কোনো ঘোরের ভেতর কিংবা চাপের মুহূর্তে আপনি নিজেই হয়তো পুনরুৎপাদন ঘটাচ্ছেন সেই দৃশ্যের। যেমনটা গত পরশু রাতে ঘটালেন পেপ গার্দিওলা। এই পুনরাবৃত্তি নিছক দৃশ্যের প্রতিলিপি নয়, বরং অর্থকেও ধারণ করছে শতভাগ।
অ্যাস্টন ভিলার কাছে ২–১ গোলে হারা ম্যাচে ম্যানচেস্টার সিটি কোচের তৈরি করা সেই দৃশ্য বা মুহূর্তটি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১৩১ বছর পুরোনো বিশ্বখ্যাত এক চিত্রকর্মের কাছে। যে চিত্রকর্ম এখনো নানাভাবে আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে মিমের দুনিয়ায় এ চিত্রকর্মটি নিয়মিতই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
পরশু রাতে গার্দিওলা আমাদের যে চিত্রকর্মটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন সেটি ১৮৯৩ সালের, এঁকেছিলেন নরওয়ের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এডভার্ড মুঙ্ক। চিত্রকর্মের মূল চরিত্রটিকে আমরা দেখি, দুই কানে হাত দিয়ে চিৎকার করতে। মুঙ্কের এই চিত্রকর্মটির নাম নাম ‘দ্য স্ক্রিম’ বা চিৎকার। বলা হয়, শিল্পকলার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ‘এক্সপ্রেশেনিজম’–এর ওপর এই চিত্রকর্মের ব্যাপক প্রভাব আছে।
চিত্রকর্মের যন্ত্রণাদগ্ধ মুখটি শিল্পের সবচেয়ে আইকনিক মুখগুলোরও একটি। যা মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকেই মূলত আকণ্ঠ ধারণ করে আছে। এই চিত্রকর্মটির পেছনের গল্পেও সেই উদ্বেগ ও চাপের কথাই উল্লেখ করেছিলেন মুঙ্ক। বলেছিলেন, প্রকৃতির ভেতর দিয়ে চিরন্তন এই চিৎকারটাই তিনি সেদিন শুনতে পেয়েছিলেন।
মুঙ্কের ব্যাখ্যা বাদ দিয়েও চিত্রকর্মটি খালি চোখে দেখার সময় সেই উদ্বেগ ও চাপের কথাই সবার আগে মনে আসে। যে একই উদ্বেগ ও অন্তহীন চাপ নিজের মধ্যে ধারণ করে গত কিছুদিন ধরে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন পেপ গার্দিওলা।
মুঙ্কের চিত্রকর্মের যন্ত্রণাদগ্ধ মুখটি শিল্পের সবচেয়ে আইকনিক মুখগুলোরও একটি। যা মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকেই মূলত আকণ্ঠ ধারণ করে আছে।
এটা এমন একটা অদ্ভুত সময়, যা হয়তো গার্দিওলার জন্য পুরোপুরিই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু জীবন কি আর প্রত্যাশার পথ ধরে হাঁটে? জীবন অনেক সময় এমনভাবে আপনার ওপর আছড়ে পড়ে, যা আপনি হয়তো কল্পনাই করেননি। গার্দিওলাও কি আর করেছিলেন!
যে মানুষ হার কী জিনিস কখনো ঠিকঠাক উপলব্ধি করেননি, ব্যর্থতা কখনো যার চৌকাঠ স্পর্শ করেনি। কোচিং ক্যারিয়ারে লা লিগায় বার্সেলোনা আর বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখকে টানা তিন আসরে লিগ জিতিয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগে এসে সর্বশেষ চার মৌসুমসহ লিগ জয়ের সংখ্যা ৬টি। কখনো টানা চার ম্যাচেও হারেননি।
একই মানুষ যখন ১২ ম্যাচের ৯টিতেই হারেন, তখন তাঁর কেমন লাগে! মানুষের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এমন অসহায় সময় আসতেই পারে। যখন দীর্ঘশ্বাসের বদলে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে ‘দ্য স্ক্রিম’ চিত্রকর্মের মতো এমন আর্তনাদ। গার্দিওলার আর্তনাদটা অবশ্য পেইন্টিংয়ের মতো দৃশ্যমান নয়।
মনে হচ্ছে, কানে হাত দিয়ে নিজের সেই চিৎকার প্রকাশের বদলে নিজেই গিলে ফেলেছেন এই স্প্যানিশ কোচ। তবে সব সময় যে গার্দিওলা এই যন্ত্রণা হজম করতে পারছেন, তা–ও নয়। কিন্তু করতে না পারার যে অসহায়ত্ব তা যেন তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে। যা কখনো বেরিয়ে আসছে আত্মবিধ্বংসী রূপে। যার ফলে গার্দিওলা নিজেই নিজেকে আঘাত করছেন। নিজের নাক–মুখ নিজেই খামচে দিচ্ছেন। অবলীলায় জানিয়ে দিচ্ছেন, নিজের খেতে না পারার আর ঘুমাতে না পারার কথা।
গার্দিওলার জন্য এমন আচরণ মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ব্যর্থতার রং কী, তা তো তিনি জানেনই না। তিনি শুধু জানেন সাফল্যের সোনা চড়ানো রং কেমন সেটা। আর ব্যর্থতা সম্পর্কে না জানাটাই যে গার্দিওলার জন্য আরও বড় চাপ হয়ে এসেছে, সেটা তাঁর আচার-আচরণেই স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে গার্দিওলার আচরণ বুঝতে কদিন আগে ভাইরাল হওয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকার যথেষ্ট। যেখানে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নে একের পর এক অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন।
গার্দিওলার এমন অবস্থা মনে করিয়ে দিচ্ছে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসারের ‘ডোন্ট ইউ ব্লেম অ্যানিওয়ান’ নামে গল্পটার কথা। সেই গল্পে দেখা যায়, একটা লোক সোয়েটার পরার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পরতে পারছে না। পারছে না তো পারছেই না। এ নিয়ে তার রীতিমতো মরণ দশা। পুরো গল্পে শুধুই একজন মানুষের সোয়েটার পরতে না পারার কথা বলা হয়েছে। গার্দিওলার অবস্থাও এখন গল্পটার মতো।
একটি জয়ের জন্য কতই না কসরত করছেন। নাক-মুখ রক্তাক্ত করছেন, মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, হতাশায় ভেঙে পড়ছেন কিন্তু জয়টা কোনোভাবেই ধরা দিচ্ছে না।
গত দুই দশকে বিশ্ব–ফুটবলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন গার্দিওলা।
গার্দিওলার এমন অবস্থা মনে করিয়ে দিচ্ছে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসারের ‘ডোন্ট ইউ ব্লেম অ্যানিওয়ান’ নামে গল্পটার কথা।
এর মধ্যে অনেকের কাছ থেকে সর্বকালের সেরা কোচের মর্যাদাও পেয়েছেন। আধুনিক ফুটবলের খোলনলচে বদলে দেওয়ার পাশাপাশি কোচিং দর্শনেও নিয়ে এসেছেন নতুনত্ব। এর মধ্যে কদাচিৎ ব্যর্থতা যে কড়া নাড়েনি, তা নয়। কিন্তু এমন দীর্ঘ খারাপ সময়ের মুখোমুখি গার্দিওলা সম্ভবত দুঃস্বপ্নেও হননি।
দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে বলা যায় দেয়াল ভেঙে যাওয়ার অবস্থা তাঁর। কিন্তু নামটা যেহেতু গার্দিওলা, এখনই তাঁর ওপর থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছে না সিটি কর্তৃপক্ষ ও শিষ্যরা। কোনো সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠেই গার্দিওলা নিশ্চয় আবারও আঙুলি হেলনে গড়ে দেবেন ম্যাচের ভাগ্য। ভক্ত–সমর্থকেরাও এখন দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষায় আছেন, সেই মনোরম মুগ্ধতা ছড়ানো মুহূর্তের।