গার্দিওলা–ক্লপের দ্বৈরথ কেন আধুনিক ফুটবলের সেরা কোচিং যুদ্ধ
পেপ গার্দিওলা এবং ইয়ুর্গেন ক্লপের ডাগআউট-যুদ্ধই কি আধুনিক ফুটবলের সেরা কোচিং দ্বৈরথ? কেউ কেউ হয়তো আপত্তি করতে পারেন। কারও কারও পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে আরেকটু বেশি শত্রুতা এবং তিক্ততার প্রতি। যুদ্ধংদেহী পরিবেশ, কথার লড়াই কিংবা মারমুখী অবস্থানও হতে পারে অনেকের প্রথম পছন্দ। কিন্তু বাস্তবতা এবং আবেগ দূরে সরিয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, গার্দিওলা-ক্লপের দ্বৈরথ কতটা বহুমুখী এবং রোমাঞ্চকর।
দুজনের কৌশলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বেরিয়ে এসেছে দুর্দান্ত সব ম্যাচ। প্রথমে জার্মানিতে বায়ার্ন মিউনিখকে গার্দিওলা এবং বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে প্রতিনিধিত্ব করেন ক্লপ। এরপর সেটি অন্য উচ্চতা স্পর্শ করে ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুলে। দুজনের দ্বৈরথ কেন আকর্ষণীয় এবং অনেক দিন মনে রাখার মতো— লিভারপুল–সিটি ম্যাচের আগে তা খুঁজে বের করার প্রয়াস নিয়েছে ক্রীড়াভিত্তিক পোর্টাল দ্য অ্যাথলেটিক।
সাফল্যের ষোলোকলা
গার্দিওলা-ক্লপ দুজনই সম্ভাব্য চার শীর্ষ শিরোপার সবগুলো জিতেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ এবং লিগ কাপ এরই মধ্যে ঘরে তুলেছেন তাঁরা। একসময় ইংলিশ ফুটবলে একজন কোচের একাধিক শিরোপা জয় ছিল বিরল ঘটনা। ক্লপ ও গার্দিওলা সেই ধারা ভেঙে দিয়েছেন এবং শিরোপা জয়কে এ দুজন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করেছেন।
গার্দিওলা-ক্লপের আগে কখনো এমন দুজন কোচ মুখোমুখি হননি, যাঁরা সব শিরোপা জিতেছেন। যেমন বব পাইসলে এবং ব্রায়ান ক্লফ ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতেছেন কিন্তু কখনো এফএ কাপ জেতেননি। অন্যদিকে আর্সেনালের কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং লিগ কাপ জেতেননি। এর আগে শুধু একজন কোচ চারটি শিরোপা জিতেছিলেন, তিনি স্যার আলেক্স ফার্গুসন। এদিক থেকে গার্দিওলা-ক্লপের দ্বৈরথকে অনন্যই বলতে হবে।
পরিচয়
গার্দিওলা ও ক্লপ দুজনই এসেছেন ভিন্ন দুটি দেশ স্পেন ও জার্মানি থেকে। তাঁদের কোচিং কৌশলও একেবারে ভিন্ন। কিন্তু ইংল্যান্ডে এসে মানিয়ে নেওয়ার পথে হাঁটেননি তাঁরা। বরং নিজেদের কৌশল দিয়েই ইংলিশ ফুটবলকে প্রভাবিত করেছেন। গার্দিওলা স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনায় যে পজিশনভিত্তিক ফুটবল দিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন, সেটি ধরে রাখেন সিটিতেও। অন্যদিকে ক্লপ ইংল্যান্ডে এসেছেন জার্মানির প্রেসিং ফুটবলের দীক্ষা সঙ্গে নিয়ে। তাই সিটি-লিভারপুলের মুখোমুখি হওয়া মানেই যেন ভিন্ন দুটি ফুটবলীয় আদর্শের একে অপরের মুখোমুখি হওয়া।
এমন মৌলিক লড়াই ইংলিশ ফুটবলে তো বটেই, সামগ্রিকভাবেও ছিল বিরল ঘটনা। ১৯৯০ দশকে ফার্গুসন এবং কেনি ডাগলিশের মুখোমুখি হওয়ার উদাহরণ চাইলে কেউ দিতে পারেন। তবে সে লড়াই যতটা ব্যক্তিত্বের ছিল, ততটা কৌশলের ছিল না। কারণ দুই স্কটিশ কোচ সাধারণত ৪-৪-২ ফরমেশনেই দলকে খেলাতেন, যা অনেকটাই কাছাকাছি ধরনের ছিল।
একে অপরের কাছ থেকে শেখা
গার্দিওলা-ক্লপ একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে দুজনের খেলা অনেক বিবর্তিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কৌশলের নিরীক্ষার ভেতর দিয়েও গিয়েছেন তাঁরা। এমনকি কখনো কখনো তাঁদের কৌশলের শৈলী একত্র হতেও দেখা গেছে। সম্ভবত মিডফিল্ড জোনেই একে অপরকে কখনো কখনো অনুকরণ করেছেন তাঁরা। নয়তো ক্লপের অধীনে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে বেড়ে ওঠা ইলকাই গুন্দোয়ান কখনো গার্দিওলার মিডফিল্ডে বড় অস্ত্র হতে পারতেন না।
অন্যদিকে পাসিং ফুটবলকে নিজের প্রেসিং কৌশলে আয়ত্ত করতে ক্লপ নিয়ে এসেছেন থিয়াগো আলকান্তারার মতো মিডফিল্ডারকে। আবার সাম্প্রতিক লড়াইগুলোতে লিভারপুলকে তুলনামূলক শান্ত হয়ে খেলার বিপরীতে সিটিকে দেখা গেছে প্রেস করে খেলতে। এতেই বোঝা যায় একে অপরকে এ দুজন কীভাবে প্রভাবিত করেছেন।
দুজনের যুদ্ধক্ষেত্র
সাধারণত গার্দিওলা-ক্লপের দ্বৈরথগুলো পরিচালিত হয়েছে দুটি প্রধান লিগের দুটি প্রধান ক্লাবের হয়ে। প্রথমে তাঁরা মুখোমুখি হন জার্মান দুই ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ এবং বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। গার্দিওলা ছিলেন বায়ার্নে এবং ক্লপ ছিলেন ডর্টমুন্ডে। সেই লড়াই শক্তি-সামর্থ্যের বিবেচনায় কিছুটা অসম ছিল। কিন্তু এরপর ক্লপ কৌশলের জাদুতে গার্দিওলার বায়ার্নের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইংল্যান্ডে অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে দুজন অনেকটাই সমতায় ছিলেন। যদিও তারকাদ্যুতিতে এখানে ক্লপকে খানিকটা ম্লান করেছেন গার্দিওলা। মাঠের ফলে অবশ্য চিত্রটা ভিন্ন। যেখানে গার্দিওলার ১১ জয়ের বিপরীতে ক্লপের জয় ১২টি।
স্থায়িত্ব
ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ চার বিভাগে এ দুজনের মতো এত লম্বা সময় ধরে (গার্দিওলা ৮ বছর, ক্লপ ৯ বছর) আর কোনো কোচিং করছেন না। হারোগেট টাউনের কোচ সিমন ওয়েভের ২০০৯ সাল থেকে দায়িত্ব পার করছেন। যদিও কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম এক দশক তিনি ইংলিশ ফুটবল লিগের বাইরে ছিলেন। কভেন্ট্রি সিটির মার্ক রবিনস এই সপ্তাহে সাত বছরে পা দেবেন। এর পরের স্থানটি আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতার। যিনি ৪ বছর ধরে ‘গানার’দের দায়িত্ব পালন করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে হাতে গোনা কয়েকজন কোচ আছেন, যাঁরা ৮ বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট ক্লাবের কোচিং করাচ্ছেন।
ইংলিশ ফুটবলে প্রভাব
কৌশলের দিক থেকে দুই কোচই ইংলিশ ফুটবলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছেন। গার্দিওলা ইংল্যান্ডে খেলাটাকে পুনরাবিষ্কারে সহায়তা করেছেন এবং টেকনিক্যাল ফুটবলারদের ওপর বিশ্বাস করার জায়গাটাকে উৎসাহিত করেছেন। নিচ থেকে আক্রমণ তৈরি এবং একাধিক প্লে মেকার খেলিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখার কৌশলও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেক কোচদের মধ্যে। ২০১৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডে মিডফিল্ডের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
যেখানে একই সঙ্গে ডেলে আলি এবং জেসে লিনগার্ডকে খেলিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন গ্যারেথ সাউথগেট। আর সাউথগেটের কৌশলে হোল্ডিং মিডফিল্ডার ছিলেন জর্ডান হেন্ডারসন। যিনি তখনই কেবল ক্লপের লিভারপুলে সেই পজিশনে খেলতে শুরু করেছিলেন। ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আরনল্ডকে খেলানোর ক্ষেত্রেও ক্লপের কৌশলের অনুসরণ করতে দেখা গেছে সাউথগেটকে।
মুখোমুখি লড়াই
এখন পর্যন্ত মুখোমুখি ২১ দেখায় ক্লপের লিভারপুল এবং গার্দিওলার সিটি ম্যাচপ্রতি ৩.২ করে গোল করেছে। একই সময়ে প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচপ্রতি গোলের হিসাব বিবেচনায় এ অনুপাত অনেক বেশি। এ দুই দলের দ্বৈরথে ম্যাড়মেড়ে ম্যাচের দেখাও মিলেছে কদাচিৎ। এর মধ্যে শুধু একটি ম্যাচ গোলশূন্য ড্রয়ে শেষ হয়েছে। সেটি দেখা গিয়েছিল ২০১৮-১৯ মৌসুমে। রিয়াদ মাহরেজ পেনাল্টি মিস না করলে হয়তো সেটিও গোলশূন্য থাকত না। ক্লপ-গার্দিওলার অধীনে বেশির ভাগ সময়ে লিভারপুল-সিটির ম্যাচকে বিবেচনা করা হয়েছে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ হিসেবে। এমনকি দুবার দেখা গেছে এক পয়েন্টে শিরোপা হারানোর ঘটনাও। দুবারই অবশ্য হতাশ হতে হয়েছিল লিভারপুলকেই।
ইউরোপিয়ান আধিপত্য
গার্দিওলা-ক্লপের এ দ্বৈরথ কেবল ইংলিশ ফুটবলে আটকে নেই। এ দুটি দল একই সঙ্গে ইউরোপেও সেরা দুটি দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ মৌসুমে স্মরণীয় এক দ্বৈরথে চ্যাম্পিয়নস সেমিফাইনালে মুখোমুখিও হয়েছিলেন তাঁরা। অ্যানফিল্ডে প্রথম লেগে ৩-০ গোলে জেতার পর দ্বিতীয় লেগে সিটির মাঠে জয় নিয়ে ফিরেছিল ক্লপের দল। ইতিহাদে লিভারপুল জিতেছিল ২-১ গোলে। আর এ সময় একটি করে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও জিতেছেন তাঁরা।
শ্রদ্ধা
এ ধরনের মুখোমুখি দ্বৈরথ সাধারণত কথার লড়াই থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপ্রীতিকর এবং দৃষ্টিকটু ঘটনার জন্ম দেয়। একসময় এসব ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। তবে ক্লপ-গার্দিওলার ক্ষেত্রে দুজনের লড়াইটা ছিল কেবলই কৌশলের। ফলে ম্যাচে শরীরী উত্তাপ দেখা যাওয়ার বদলে, ফুটবলের সৌন্দর্যই চিত্রিত হয়েছে বেশি। পাশাপাশি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলতেও সহায়তা করেছেন এ দুজন। ম্যাচের আগে-পরে সংবাদ সম্মেলনেও একে অপরকে প্রশংসায় ভাসাতে দেখা যায় তাঁদের, যা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
ক্লাবের প্রতীক
গার্দিওলা-ক্লপের অধীনে সিটি-লিভারপুলের দ্বৈরথে এ দুই কোচের মুখোমুখি হওয়াটাই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি, যা এর আগে দেখা যায়নি বললেই চলে। যেমন ফার্গুসন-ওয়েঙ্গার যখন মুখোমুখি হতেন, তখন সব ছাপিয়ে সামনে আসত রয় কিন বনাম প্যাট্রিক ভিয়েরার দ্বৈরথ। আবার গার্দিওলা যখন স্পেনে জোসে মরিনোর মুখোমুখি হতেন, তখন সবার চোখ থাকত লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দিকে। কিন্তু সিটি-লিভারপুলে খেলোয়াড়দের ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছেন গার্দিওলা এবং ক্লপই।
এ দুজনের লড়াইয়ে যদি কোনো আক্ষেপ থাকে, সেটি হচ্ছে বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে এ দুজনের মুখোমুখি না হওয়া। এফএ কাপ, লিগ কাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের বিভিন্ন পর্যায়ে দুজন মুখোমুখি হলেও ফাইনালের ডাগআউটে দেখা যায়নি এ দুজনকে। এবারের এফএ কাপ দিয়ে সে আক্ষেপ দূর হবে কি?