ব্রাজিলের জার্সিতে নেইমার কি সত্যিই পেলের রেকর্ড ভেঙেছেন
‘ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ফিফা অফিশিয়াল ম্যাচে রাজার গোলের রেকর্ড ভাঙার জন্য নেইমারকে অভিনন্দন। পেলে অবশ্যই আজ করতালি দিচ্ছেন।’
রাজা কে—তা না বললেও চলে। ফুটবলে ‘কিং’ বা ‘ও রেই’ একজনই। তবে সেই ‘রাজা’ এখন আর পৃথিবীতে নেই। গত বছর ২৯ ডিসেম্বর ঠিকানা পাল্টে এখন অন্যলোকের বাসিন্দা। সেই ‘লোক’-এ বসে তো আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালানো যায় না। পেলের হয়ে কাজটা অন্য কেউ করে দিচ্ছেন এখানে। আজও যেমন নেইমার ব্রাজিলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলের হিসাবে পেলেকে পেছনে ফেলে শীর্ষে ওঠার পর কিংবদন্তির অফিশিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই পোস্ট করা হয়।কথাগুলোয় একটু গভীরভাবে তাকালে সুক্ষ্ম ফারাকটা ধরা পড়ে।
‘ফিফা অফিশিয়াল ম্যাচে গোলের রেকর্ড’—কথাটা গভীরভাবে পড়ুন। গভীরভাবে বলতে ‘রিড বিটুইন দ্য লাইনস’—অন্তর্নিহিত অর্থ। সেটা উদ্ধার করতে পারলে মনের মধ্যে ঘুণপোকার মতো কেটে চলা ‘কিন্তু’টা আর থাকে না। ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আজ বলিভিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের ৫-১ গোলের জয়ে নেইমার একটি রেকর্ড গড়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো সরগরমই; কিছু সংবাদমাধ্যম, এমনকি এএফপির মতো সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনের শুরুতেও এই রেকর্ড নিয়ে বলা হয়েছে, ‘পেলেকে টপকে ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন নেইমার।’ কথাটা ঠিক, আবার ভুলও।
একটা হলো ‘ফিফা অফিশিয়াল ম্যাচ’—যেটাকে আন্তর্জাতিক হিসেবে ধরা হয় মানে দুটি দেশের মধ্যে ম্যাচ। আরেকটি হলো ‘ব্রাজিলের হয়ে’—মানে ব্রাজিল যে দলেরই মুখোমুখি হোক, সেটি দেশ বা ক্লাব। এই পার্থক্যটি মাথায় রেখে ফিফার পরিসংখ্যানটি জানিয়ে দেওয়া যাক। ফিফা অফিশিয়াল কিংবা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে নেইমারের গোলসংখ্যা এখন ১২৫ ম্যাচে ৭৯। পেলের গোলসংখ্যা ৯১ ম্যাচে ৭৭। বলিভিয়ার বিপক্ষে আজ জোড়া গোল করে তিনবার বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তিকে পেছনে ফেলে ফিফা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন নেইমার—এ নিয়ে তিল পরিমাণ প্রশ্নের সুযোগও নেই।
কিন্তু ফিফার এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয় ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ)। হ্যাঁ, নেইমারের গড়া রেকর্ডকে উদ্যাপন করতে সিবিএফ আজ তাঁকে একটি স্মারক উপহারও দিয়েছে। কিন্তু ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ জানিয়েছে, সিবিএফ মনে করে ব্রাজিলের জার্সিতে ১১৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৯৫ গোল করেছেন পেলে। ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’ তো এক কাঠি সরেস। সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে, সিবিএফের হিসাব অনুযায়ী ব্রাজিলের হয়ে নেইমার আরও ১৬ গোল করলে ধরতে পারবেন পেলেকে। প্রশ্ন হলো, সিবিএফ কিসের ভিত্তিতে এই হিসাব করেছে?
আসলে পেলের গোলসংখ্যা নিয়ে ফুটবলের এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে হিসাবের গরমিলের মূলে আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংজ্ঞা নির্ধারণ। ফিফার আন্তর্জাতিক ম্যাচ কী—সেটা তো আগেই বলা হলো। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট তো বটেই, প্রীতি ম্যাচের গোলসংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত করে ফিফা। যেমন ধরুন, ব্রাজিল জাতীয় দল ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের মধ্যকার প্রীতি ম্যাচে শেখ মোরছালিন গোল করলে তা ফিফার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের হয়ে মোরছালিনের গোলসংখ্যায় যোগ হবে।
কিন্তু সিবিএফ ব্রাজিলের জার্সিতে পেলের সব ম্যাচ হিসাব করেছে। খুলে বলা যাক। গত শতকে দেশগুলোর জাতীয় দল বিভিন্ন দেশের ক্লাবগুলোর সঙ্গেও ম্যাচ খেলেছে। ষাট ও সত্তর দশকে—পেলে যখন খেলেছেন—ইন্টার মিলান ও আতলেতিকো মাদ্রিদের মতো দলগুলো ম্যাচ খেলেছে ব্রাজিলের সঙ্গে। ফিফা এই ম্যাচগুলো পেলের আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করেনি, তাই এসব ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যাও যোগ হয়নি। কিন্তু সিবিএফ এমন ২২টি ম্যাচে পেলের ১৮টি গোল অন্তর্ভুক্ত করেছে তাঁর হিসাবে। আর তাই ফিফার হিসাবে পেলের ৯১ ম্যাচে ৭৭ গোলই সিবিএফের হিসাবে বেড়ে ১১৩ ম্যাচে ৯৫ হয়েছে।
ফিফার হিসাবে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ পাঁচ গোলদাতা
প্রশ্ন করতে পারেন, নেইমারেরও কি এমন ম্যাচ নেই? যেসব ম্যাচে নেইমার ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতেই খেলেছেন, কিন্তু ফিফা সেগুলো জাতীয় দলের অফিশিয়াল ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করেনি। আছে, আলবৎ আছে। ২০১২ ও ২০১৬ অলিম্পিকে নেইমার ব্রাজিলের হয়ে মোট ১৪ ম্যাচে ৮ গোল করেছিলেন। কিন্তু অলিম্পিকে জাতীয় দল নয়, অফিশিয়ালি অনূর্ধ্ব-২৩ দল খেলে থাকে, যেখানে তিনজন সিনিয়র খেলোয়াড় সুযোগ পান। ফিফা বিচারে এটি অনূর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্ট, তাই এর পরিসংখ্যানও আলাদা। সিবিএফও এই অলিম্পিককে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কাতারে রাখায় নেইমারের এই ৮ গোল তাঁর পরিসংখ্যানে যোগ করা হয়নি।
সিবিএফের হিসাবে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ পাঁচ গোলদাতা
এবার আসল প্রশ্নটা করা যাক। আচ্ছা, ফুটবলপ্রেমীদের নেইমারের এই রেকর্ড নিয়ে আলোচনার সময় কি একদম ঠিকঠাক করে সব বলার দরকার আছে? মানে, নেইমার আজ যে রেকর্ড গড়লেন, সেটি নিয়ে কথা বলার সময় যদি কেউ বলেন ‘ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এখন নেইমারের’—তাহলে কি কথাটা ভুল হয়? অবশ্যই না। প্রচলিত অর্থে এটাও সঠিক। জাতীয় দলের ম্যাচ বলতে যে আন্তর্জাতিক ম্যাচই বুঝে নেওয়া হয়। আর নেইমার তো আন্তর্জাতিক ম্যাচের হিসাবেই পেলের গোলের রেকর্ড ভেঙেছেন। ব্রাজিল তারকার সমর্থকদের তাই মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) হিসাবটা আলাদা। তারা ওই দেশের ফুটবলের দায়িত্বশীল সংস্থা, সমর্থকদের যে স্বাধীনতা আছে, সেটা তাদের নেই। নিজেদের যে হিসাব সে অনুযায়ীই তাঁদের কথা বলতে হবে, আর তাই সিবিএফ সভাপতি এদনালদো রদ্রিগেজ নেইমারের হাতে গোলের রেকর্ডের স্মারক তুলে দেওয়ার সময় বলেছেন, ‘জাতীয় দলগুলোর বিপক্ষে ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা।’
সিবিএফ সভাপতি সচেতনভাবেই নেইমারকে ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলদাতা বলেননি। ব্রাজিলের জার্সিতে—এই কথাটার মধ্যে যে পেলের জাতীয় দলের হয়ে ক্লাবের বিপক্ষে খেলা ম্যাচগুলোয় গোলের পরিসংখ্যানও যোগ হয়। সে হিসাবে পেলে এখনো নেইমারের চেয়ে এগিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, গোলের রেকর্ড গড়ার পর নেইমার নিজেই বলেছেন, ‘রেকর্ডটির মানে এটা নয় যে, আমি পেলের চেয়ে ভালো...।’
কথাটা শুনে পেলে নিশ্চয়ই আবারও করতালি দিয়েছেন! ঠিকানা পাল্টানোয় যে কথাটি তিনি নিজে বলতে পারছেন না, সেটা বলে দিলেন নেইমার নিজেই। বিশাল হৃদয়ের ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর পাশে বসে নিশ্চয়ই খুঁচিয়েছেন, ‘ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোল’—এটা ওঁকে এখনই দিয়ে দিলেই বা কী যায় আসে! বয়স তো সবে ৩১, তুমি জাতীয় দল ও ক্লাবের বিপক্ষে মিলিয়ে যত গোল করেছ, সেটা ও একদিন শুধু জাতীয় দলগুলোর বিপক্ষেই করে ফেলবে, দেখে নিয়ো!’