ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না–হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।
বাংলাদেশ সে বছর দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। ঢাকাসহ দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অঞ্চল তলিয়ে যায়। বাঙালির ছেলে অমর্ত্য সেন নোবেল পান আর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন গুগল নামে একটি কোম্পানি খোলেন, যা গোটা দুনিয়াকেই পাল্টে দেয়। এসবের মধ্যে ফ্রান্সে শুরু হয় বিশ্বকাপ। আগের দুবার বিশ্বকাপে খেলতে ব্যর্থ হলেও এবার স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় ফ্রান্স।
জিনেদিন জিদান নামে আলজেরীয় এক মুসলিম সন্তান ছিলেন ফ্রান্সের এই দলটার প্রাণভোমরা। আর দলের একটা বড় অংশই ছিল বিভিন্ন কলোনি থেকে আসা কালো চামড়ার লোকদের বংশধর। এদের হাত ধরেই জাত্যভিমানী, আফ্রিকাকে লুটে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলা ফরাসিরা স্বপ্নের কাপটা জিতে নেয়।
তবে জয় হয় আরও কয়েকজনের। হোয়াও হাভেলাঞ্জ এবং তাঁর সহযোগী সেপ ব্লাটারের। ২৪ বছর ধরে ফুটবল-দুনিয়া শাসন করে, ফুটবলকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক খেলা বানানোর পর হাভেলাঞ্জ মসনদে বসান সুইস আইনজীবী, তাঁর অতি বিশ্বস্ত ব্লাটারকে। যদিও ধরা হচ্ছিল উয়েফার প্রেসিডেন্ট লেনার্ট জোহানসনই ফিফার প্রেসিডেন্ট হবেন, কিন্তু হাভেলাঞ্জ ঠিক যেভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেভাবেই রুদ্ধশ্বাস রাজনীতির প্যাঁচে তাঁকে ছিটকে ফেলে ব্লাটারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। আর এই যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বকাপে বাড়ে ম্যাচের সংখ্যা, দল হয় ৩২টি।
ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরেছিল ব্রাজিল। আগেরবার ২৪ বছরের খরা কাটানো দলটা স্বপ্ন দেখেছিলেও ’৫৮ ও ’৬২-র মতো আবারও টানা বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু, অদ্ভুত এক ফাইনালে তারা হারে ৩-০ গোলে। সেদিন মাঠে ‘অচেনা’ ব্রাজিল আর রহস্যজনকভাবে নিষ্প্রভ থাকা রোনালদোকে নিয়ে পরে দিস্তা দিস্তা অনুসন্ধান ও গবেষণা হয়েছে।
নতুন করে গড়া স্তাদে ফ্রান্সের সেই ম্যাচের আগে রোনালদো আর ব্রাজিল দলের কী হয়েছিল, তা আজও পুরোপুরি জানা যায়নি। মাত্র ২১ বছর বয়সেই দুনিয়ার অন্যতম দামি খেলোয়াড় হয়ে যাওয়া, ব্রাজিলের মতো দেশের স্বপ্নপূরণের চাপ সেদিন সম্ভবত রোনালদোর ওপর চেপে বসেছিল।
পরের বছর সাও পাওলোর ‘প্লাকার’ ম্যাগাজিনে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয়, রোনালদো ফাইনালের দিন বেলা ২টার দিকে রুমমেট রবার্তো কার্লোসের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ভীত কার্লোস অন্যদের ডাক দেন। সিজার সাম্পাইও এসে রোনালদোর মুখটা হাঁ করে রাখেন, পাছে তিনি জিহ্বা গিলে না ফেলেন। এর মিনিট দুয়েক পর জ্ঞান ফিরলেও রোনালদো গভীর ঘুমে তলিয়ে যান।
ততক্ষণে চলে আসেন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ লিডিও টলেডো এবং ক্লিনিশিয়ান ডক্টর জোয়াকিম দা মাটা ও দলের সহযোগী ম্যানেজার জিকো। কোচ জাগালো অবশ্য তখনো কিছু জানেন না, আর জ্ঞান ফিরে আসার পর বিকেল ৫টার দিকে রোনালদোকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ঘণ্টা দেড়েক তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
রাত ৮টা দশে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার পর রোনালদো জোর দিয়ে বলেন তিনি ভালো বোধ করছেন এবং জাগালোকে অনুরোধ করেন তাঁকে ফাইনালে খেলাতে। ডাক্তার দুজনও তাঁকে সমর্থন করেন। ‘আমার অবস্থা চিন্তা করুন। রোনালদো নিজে জোর করছে (খেলার জন্য), সে জায়গায় কি ডাক্তারের বিরোধিতা করার জো আছে?’—বলেছিলেন ডক্টর টলেডো।
ধারণা করা হয়, এরপর ভ্যালিয়াম পিল খেয়ে রোনালদো মাঠে নেমেছিলেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে সেদিন তিনি আরও অনেক অসুস্থ, এমনকি মারাও যেতে পারতেন। সাও পাওলোর স্কুল অব মেডিসিনের প্রফেসর স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ আকারি সুজ বুয়েল অলিভিয়ের মনে করেন, রোনালদোর সেদিন কনভালশন (মূর্ছা যাওয়া) হয়েছিল, যদিও তাঁর ক্লাব ইন্টার মিলানের ডাক্তার পিয়েরো ভলপি তেমন মনে করেন না।
রোনালদোকে পরে পরীক্ষা করা ব্রাজিলিয়ান স্নায়ু বিশেষজ্ঞ এলেক্স কাইতানো দে বাররোস মনে করেন, ব্রাজিল স্ট্রাইকারের মূর্ছা যাওয়ার সাত ঘণ্টা পরই তাঁকে মাঠে নামিয়ে দেওয়াটা ছিল ‘পুরোপুরি ভুল’। কারণ, কনভালশনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষের চোখের সামনেই রোনালদোর ‘গুরুতর কিছু’ হতে পারত।
সেদিন কী হয়েছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে রোনালদোর পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করা নাইকি চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে তাঁকে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলানো হোক। পেশাদার ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণের শত শত উদাহরণে রোনালদোর ওই ম্যাচটি আরও একটি অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হওয়ায় বঞ্চিত হয় ব্রাজিল।
তবে জিতেছিল ফরাসিরা। কোচ আইমে জ্যাক সে সময়ে সবচেয়ে নামী দুজন ফরাসি স্ট্রাইকারকে বাদ দিয়েই দল গঠন করেন। এরিক ক্যান্টোনা সমন্ধে জ্যাক বলেছিলেন, খেলোয়াড় হিসেবে খুবই সম্মানের পাত্র হলেও তাঁর সিস্টেমে ক্যান্টোনা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি খাপ খান না। অন্যদিকে ডেভিড জিনোলাকে জ্যাক ভাবতেন, ‘ক্ষতিকর প্রভাব’ হিসেবে। জিনোলার ভুলে বুলগেরিয়ার সঙ্গে গোল খেয়ে ফ্রান্স যে আগের বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি তা জ্যাক কখনোই ভুলতে পারেননি। ফরাসি সংবাদমাধ্যমের চাপ নিয়েই খেলতে নেমেছিল জ্যাকের ফ্রান্স।
ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে সংবাদমাধ্যমে অন্যতম ফেবারিট বলা হলেও দলটার অবস্থা সুবিধার ছিল না। ইউরোপিয়ান ‘ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ ম্যাথিয়াস সামার চোটের কারণে খেলতে না পারায় শুরুতেই জার্মানি ধাক্কা খেয়েছিল। কোচ বার্টি ভোগটসের দলটির গড় বয়সও ছিল বেশি, ৩৭ বছর বয়সী লোথার ম্যাথিয়াসকে দলে ডাকায় বয়সের ভার আরও বেড়ে যায়।
ইতালির দায়িত্বে ছিলেন ৬৬ বছর বয়স্ক সিজার মালদিনি। ‘কাতানোচ্চিও’ খেলার ভক্ত এই কোচ ফর্মে থাকা বাজ্জিওকে উপেক্ষা করেন এবং তাঁর বদলে আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোকে বারবার সুযোগ দেন কিন্তু জুভেন্তাস তারকা তাঁকে হতাশ করেছিলেন। স্পেনের কোচ হাভিয়ের ক্লেমেন্তে আরও বেশি হতাশ হন রাউল আর লুই এনরিকের মতো তরুণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও। ম্যারাডোনা-পরবর্তী আর্জেন্টিনা অনেকটা দূরই গিয়েছিল, কিন্তু কাপ জেতার মতো দল আর্জেন্টিনার ছিল না।
বিশ্বকাপের প্রথম দিন খেলে চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবং স্কটল্যান্ড। এবার যেহেতু ৮ গ্রুপ থেকে ১৬ দল যাবে, তাই আগের মতো তৃতীয় স্থান নিয়ে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। অবশ্য স্কটিশরা তা-ও পারেনি, ব্রাজিলের সঙ্গে হেরে শুরু করার পর, নরওয়ের সঙ্গে ড্র এবং শেষ ম্যাচে মরক্কোর সঙ্গে লজ্জাজনক ৩-০ গোলে হারে। ব্রাজিল তিন ম্যাচের দুটিতে জেতে আর নরওয়ের কাছে হারলেও গ্রুপ সেরা হিসেবে পরের রাউন্ডে ওঠে।
গ্রুপ ‘বি’তে ইতালি প্রথম ম্যাচে রেফারির বদন্যতায় একটা পেনাল্টি পেয়ে চিলির সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে। বাকি দুই দলকে হারিয়ে ইতালি অবশ্য গ্রুপের শীর্ষ স্থান দখল করে আর অস্ট্রিয়াকে হারালেও ক্যামেরুনের সঙ্গে হেরে দ্বিতীয় হয় চিলি। চিলির ইভান জামেfরানো-মার্সেলো সালাস জুটি দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলের সৌন্দর্য দেখিয়ে দেন।
‘সি’ গ্রুপ থেকে ওঠে ফ্রান্স ও ডেনমার্ক। বর্ণবাদের অন্ধকার অধ্যায় পার হয়ে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার সান্ত্বনা ছিল সৌদি আরব ও ডেনমার্কের সঙ্গে ড্র করা। অবশ্য আরেক আফ্রিকান দল নাইজেরিয়া প্রথম ম্যাচেই স্পেনকে হারায় ৩-২ গোলে।
বুলগেরিয়াকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় নাইজেরিয়া। রানার্সআপ হিসেবে পরের রাউন্ডে ওঠে হোসে লু্ই চিলাভার্টের প্যারাগুয়ে আর বাদ পড়ে স্পেন।
ডাচরা চ্যাম্পিয়ন—এই বাজি ধরার লোকের অভাব ছিল না। শৃঙ্খলার কারণে কোচ গাস হিডিংক মিডফিল্ডার এডগার ডেভিডসকে দলে না রাখলেও ডাক পান প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। বলগা হরিণের মতো গতিশীল মার্ক ওভারমার্সকে স্বাধীনতা দেন কোচ হিডিংক, দলকে ৪-৪-২ ফরম্যাশনে খেলিয়ে। যদিও বাছাইপর্বে ভয়াবহ কিছু ভুল করেছিলেন ডিফেন্ডার ইয়াপ স্ট্যাম্প, তবে প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড তাঁকে কিনে নিয়েছিল ৭৫ লাখ পাউন্ডে। আর ছিলেন ডেনিস বার্গক্যাম্প।
আর্সেনালের আক্রমণভাগ মাতানো এই খেলোয়াড় সেই বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচে বেলজিয়ামের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করলেও নেদারল্যান্ডস দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায় পাঁচ গোলে আর মেক্সিকোর সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে। কোরিয়ার সঙ্গে না জিততে পারার খেসারত দিয়ে তিন ড্র নিয়ে গ্রুপ থেকে বাদ পড়ে বেলজিয়াম।
‘ই’ গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে যায় জার্মানি আর ২১ জুন লিওতে ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচটা রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায়। ইরানের বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ হওয়াই ছিল দারুণ এক ঘটনা। ফুটবলের জয়কে ঘিরে নারীরা যেভাবে রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছিলেন, তাতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন সে দেশের রক্ষণশীল শাসকেরা।
রোমানিয়ার কাছে হারলেও ইংল্যান্ড পরের রাউন্ডে যায় আর গ্রুপ ‘এইচ’ থেকে যায় আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল চিলিকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয়। রোনালদোর দুই গোল আর সিজার সাম্পাইওর জোড়া গোলে ম্যাচ জিতে ব্রাজিলের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সালাস একটি গোল শোধ দিলেও ২৭ জুনের প্যারিসে সেই খেলায় হেরে তাঁর দল বিদায় নেয়।
মার্শেইতে ইতালি ১-০ গোলে হারায় নরওয়েকে এবং সে জন্য তারা ধন্যবাদ দিতে পারে গোলকিপার জিয়ানলুকা পালিউকাকে, অসাধারণ একটি সেভ করেছিলেন খেলার শেষ দিকে। আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো দুটো সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে ‘আজ্জুরি’রা শেষ দিকে আরও নির্ভার থাকতে পারত।
মেক্সিকোর জন্য আফসোসের নাম ছিল হার্নানদেজ। তিনি একটি গোল করে জার্মানির বিরুদ্ধে সমতা আনলেও সহজতম সুযোগ হারান। আর দলটা জার্মানি, যেকোনোভাবে জেতাই তাদের বৈশিষ্ট্য। মেক্সিকোর ডিফেন্ডার লারার ভুলে ৭৫ মিনিটে ক্লিন্সম্যানের গোলে জার্মানি জিতে পরের রাউন্ডে যায়।
ফ্রান্স জিতেছে ঘাম ঝরিয়ে। প্যারাগুয়ের পাগলাটে গোলরক্ষক, বাঁ পায়ের ফ্রি কিকে বেশুমার গোল করা হোসে লুই চিলাভার্ট সেদিন ‘চীনের প্রাচীর’ হয়ে দাঁড়ান, কিন্তু ১১৪ মিনিটের মাথায় লরেন্ত ব্লাঁর গোলে বিদায় নেয় লাতিন আমেরিকার দলটি। আফ্রিকার দল নাইজেরিয়া ডেনমার্কের সামনে ভেঙে পড়ে ৪-১ গোলের হারে, আর ক্রোয়েশিয়া প্রথমবার খেলতে এসেই কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় ডেভর সুকারের একমাত্র গোলে রোমানিয়াকে হারিয়ে।
তবে এই রাউন্ডের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা হয় আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। ম্যারাডোনা নেই, নেই ফকল্যান্ড যুদ্ধের উত্তাপও, কিন্তু দল দুটোর শত্রুতা তুঙ্গেই ছিল। প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে দুই দলের দুটো পেনাল্টি, আর গোল করেন বাতিস্তুতা ও অ্যালান শিয়েরার। কিন্তু খেলার সেরা মুহূর্তটা আসে ১৬ মিনিটে। লিভারপুলের হয়ে খেলা তরুণ ইংরেজ মাইকেল ওয়েন অবিশ্বাস্য গতিতে আর্জেন্টিনার রক্ষণ ভেঙে দলকে এগিয়ে নেন। হাভিয়ের জানেত্তি সমতা ফেরান প্রথমার্ধের বাঁশি বাজার ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে। খেলার বাকি সময়ে গোল না হলেও উত্তেজনা বেড়েছে।
৮৭ মিনিটের মাথায় ডিয়েগো সিমিওনের ফাউলে পড়ে যান ডেভিড বেকহাম। সিমিওনে আর্জেন্টিনার ‘নেগেটিভ ফুটবল’ স্কুলের একজন যোগ্য ছাত্র (এবং পরে মাস্টার ও হেডমাস্টার) এবং সেদিন তাঁর কাজই ছিল ইংল্যান্ডের সেরা খেলোয়াড়টিকে উত্ত্যক্ত করা। তিনি সফল হলেন, মেজাজ হারিয়ে সিমিওনেকে লাথি দিয়ে লাল কার্ড দেখেন বেকহাম। ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত রক্ষণভাগ বাকি সময় দুর্গ আগলে রাখলেও টাইব্রেকারে ডেভিড বেটি মিস করায় বিদায় নেয় রানির দেশের দল।
তবে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা ডাচদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। টুর্নামেন্টের সেরা গোলটি করে ডেভিড বার্গক্যাম্প। খেলার ৮৯ মিনিটে ফ্রাংক ডি বোয়ের নিজেদের সীমানা থেকে উঁচু করে বল দিলে তিনজন ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে ডান পায়ে বলটা রিসিভ করেন বার্গক্যাম্প। এক ঝটকায় আয়ালাকে কাটিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নেন, এরপর ড্রিবল করে ডান পায়ের নিখুঁত শটে বলটা গোলকিপারের পাশ দিয়ে জালে জড়ান।
আগেরবারের ফাইনালের মতো টাইব্রেকারে ফ্রান্সের বিপক্ষে হেরে বিদায় নেয় ইতালি। এবারও শেষ শটটি মিস করেন এক ব্যাজিও, লুই ডি ব্যাজিও। ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রা অব্যহত থাকে। জার্মানিকে গুনে গুনে তিন গোল দিয়ে উঠে যায় শেষ চারে। আর মাইকেল লাউড্রপের শেষ ম্যাচে ডেনমার্ক ব্রাজিলকে চেপে ধরলেও শেষতক রিভালদোর জোড়া গোলে ব্রাজিল জেতে ৩-২ গোলে।
ব্রাজিল সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডসের। কিন্তু ওভারমার্শ চোটের জন্য খেলতে না পারায় এবং বার্গক্যাম্প নিষ্প্রভ থাকায় ডাচরা তাদের সেরাটা দিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও ব্রাজিল নির্ধারিত সময়ে জিততে ব্যর্থ হয় এবং শেষতক আগের টুর্নামেন্টের ফাইনালের নায়ক তাফারেলের ওপর ভর করে টাইব্রেকার জিতে ফাইনালে ওঠে।
সেমিফাইনালে ফরাসিদের নায়ক হয়ে ওঠেন অপ্রত্যাশিত একজন। লিলিয়ান থুরাম। গুয়াদেলুপেতে জন্ম নেওয়া এই কালো ডিফেন্ডার ফ্রান্সের হয়ে ১৪২টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। সেদিনের আগে কিংবা পরের ১৪১ ম্যাচে জুভেন্টাস আর বার্সালোনার হয়ে খেলা থুরাম কোন গোল দিতে পারেননি। আর সেদিনই দিলেন দুই গোল!
ডেভর সুকারের গোলে এগিয়ে যাওয়া ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রা শেষ হয় ২-১ গোলে হেরে।
ফাইনালের গল্প তো আগেই বলা হলো। ব্রাজিলের জন্য রহস্যময়, হতাশার এক ফাইনাল। তবে ফুটবল জাদুকর জিনেদিন জিদানের জোড়া গোলের দারুণ কীর্তি তাতে ম্লান হয় না। প্যারিসের রাজপথে ফরাসিদের বিপুল উল্লাসের কেন্দ্রে থাকা এই আলজেরীয় কিংবদন্তি হিসেবে সেই ম্যাচেই নিজের নামটা চিরস্থায়ী করেন।