পুনর্মিলনীর মঞ্চে বন্ধু যখন শত্রু
অনেক দিন পর নিজের পুরোনো ঘরে ফেরা কিংবা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া...এক অনিবর্চনীয় অনুভূতি। আনন্দ, আড্ডা, খোশগল্প, স্মৃতিচারণা—এ–ই তো! কিন্তু এ তো জীবনের কথা। মাঠের চিত্র ভিন্ন। সেখানে সাবেক ক্লাব, সাবেক সতীর্থ সময়ের মারপ্যাঁচে ‘শত্রু’ হয়ে যায়। ৯০ মিনিটের লড়াই শেষে সেই ‘শত্রু’ই আবার বন্ধু।
এমন গৌরচন্দ্রিকার কারণ আছে। আগামী দুই দিনে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে অদৃশ্য পুনর্মিলনীর মঞ্চ রচিত হবে। যে দুজন ফুটবলার পুরোনো সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তাঁরা এই সময়ের অন্যতম সেরা দুই তারকাও। বার্সেলোনা তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি যাবেন নিজের পুরোনো ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। আর্লিং হলান্ড ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে আতিথ্য দেবেন নিজের সাবেক ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে।
কথাটা যত সহজে বলা গেল, মাঠের দৃশ্য কি ততটাই সরল হবে? মোটেও নয়। চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ, ইউরোপ–সেরা হওয়ার এই মঞ্চে সবাই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচ্যগ্র মেদিনী’ পণ করেই নামে।
ফুটবলের মঞ্চে পুনর্মিলনীর ইতিহাস অম্লমধুর সব ঘটনায় ভর্তি। বেশির ভাগ সময় পুরোনো ডেরায় ফিরে গিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান খেলোয়াড়েরা। তবে মুদ্রার অন্য পিঠটাও খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। পুনর্মিলনী উত্তপ্ত ঘটনার জন্মও দেয়, যদি দলবদলে কেউ শত্রুপক্ষের ঘরে গিয়ে ওঠেন। তখন ফেরাটা হয়ে উঠতে পারে আরও দুর্বিষহ।
এমন ফেরার কথা উঠলে মনে পড়তে পারে লুইস ফিগোর সেই ঘটনা। ফিগো বার্সেলোনা ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে গিয়েছিলেন। পরে রিয়ালের হয়ে ক্যাম্প ন্যুতে খেলতে এলে শুয়োরের মাথা ছুড়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল তাঁকে।
ফিগো একাই নন, আরও অনেক ফুটবল তারকাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। রবার্তো বাজ্জোকে নিয়ে তো ছোটখাটো দাঙ্গাই বেধে গিয়েছিল। তাঁর ফিওরেন্তিনা ছেড়ে জুভেন্টাসে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক আপত্তি ছিল সমর্থকদের। এরপর প্রথমবার জুভদের জার্সিতে ফিওরেন্তিনার মাঠে খেলতে গিয়ে নাটকীয় সব ঘটনার জন্ম দেন বাজ্জো নিজেই। ম্যাচজুড়ে সেদিন দুয়ো শুনতে হয়েছিল ইতালির ‘ডিভাইন পনিটেইল’কে।
জুভেন্টাস যখন পেনাল্টি পায়, সেটা নিতেও অস্বীকৃতি জানান বাজ্জো। তাঁর দাবি ছিল, ফিওরেন্তিনা গোলরক্ষক তাঁর মানসিকতা সম্পর্কে জানেন। আর বাজ্জো যখন বদলি হয়ে মাঠ ছাড়ছিলেন, তখন গ্যালারি থেকে ছুড়ে ফেলা ফিওরেন্তিনার স্কার্ফ মাঠ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যান। এ কাণ্ডে জুভেন্টাস সমর্থকদের রোষের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। পুনর্মিলন তাই সব সময় মধুর হয় না, কখনো তা বেদনারও।
যা–ই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত অনেক গাওয়া হলো। এবার বর্তমানে ফেরা যাক। চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের পরই লেভা ও হলান্ডের পুরোনো ক্লাবের সঙ্গে পুনর্মিলনী নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় ফুটবলপ্রেমীদের। তবে হলান্ডের পুনর্মিলনীর চেয়ে লেভাকে নিয়েই আগ্রহ ছিল বেশি।
লেভার বায়ার্নের সঙ্গে দেখা হওয়ার উপলক্ষকে আরও তাতিয়ে দেন তাঁরই পুরোনো সতীর্থ টমাস মুলার। সে সময় ভিডিও বার্তায় মুলার বলেছিলেন, ‘ফুটবল-ভক্তদের জন্য কী দারুণ একটা ড্র হলো। জনাব লেভান-গোল-স্কি (লেভাকে দেওয়া মুলারের ডাকনাম), শিগগিরই তোমাকে মিউনিখে দেখার অপেক্ষায়।’
অবশেষে ফুরোচ্ছে মুলারের অপেক্ষা। আজ রাতে দেখা মিলবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের—যখন বার্সেলোনার জার্সিতে বায়ার্নকে হারানোর উদ্দেশ্যে মাঠে নামবেন লেভা। বলে রাখা ভালো, পুরোনো ক্লাবের সঙ্গে দেখা হওয়ার এমন মুহূর্ত লেভার জন্য এবারই প্রথম নয়। এর আগে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে আসার পর বায়ার্নের হয়ে অনেকবার সিগনাল ইদুনা পার্কে খেলতে গিয়েছেন লেভা। তবে এবারের উপলক্ষ একেবারেই আলাদা।
সাম্প্রতিক সময়ে বায়ার্ন-বার্সেলোনা ম্যাচ বললে ঘুরেফিরে আসে লিসবনে এই চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে ২০১৯-২০ মৌসুমে ৮-২ গোলে বার্সার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। সেই থেকে প্রতিশোধের নেশায় তেতে আছেন বার্সার সমর্থকেরা। এবার ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র উপলক্ষ তাঁদের সামনে।
কোয়ার্টার ফাইনালের সেই ম্যাচে বায়ার্নের হয়ে গোলবন্যায় ভূমিকা ছিল লেভারও। এবার লেভাকে দিয়েই প্রতিশোধটা নিতে মুখিয়ে আছে ন্যু ক্যাম্পের ক্লাবটি। লেভা নিজেও কথা বলেছেন এ নিয়ে। বলেছেন, ‘পেছনে না তাকিয়ে আমরা সামনে তাকাতে চাই।’ কিন্তু চাইলেই পেছনে ফিরে না তাকানোর সুযোগ নেই লেভার। বার্সা সমর্থকেরা যে তাঁর কাঁধেই বন্দুক রাখতে মুখিয়ে!
লেভা-বার্সার পুনর্মিলনীতে ফিগো-বাজ্জোদের মতো যুদ্ধের দামামা না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়েও যেতে পারে। লেভার বায়ার্ন ছাড়ার ঘটনা খুব যে স্বাভাবিক ছিল, তা নয়। ক্লাবের আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে বিরক্তি দেখান পোলিশ তারকা। সেই ঘটনার জ্বালা মেটাতেও এই ম্যাচকে বেছে নিতে পারেন লেভা।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে গ্রুপে দুই দল লড়ছে, তা এবার গ্রুপ পর্বে ‘মরণকূপ’। এই গ্রুপের অন্য দুই দলের একটি হচ্ছে ইন্টার মিলান। নিজেদের প্রথম ম্যাচে মিলানকে হারিয়ে ইতিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বায়ার্ন। এখন বার্সার বিপক্ষে জয় পেলে মরণকূপ পেরোনো অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বায়ার্নের।
সব মিলিয়ে প্রতিশোধ, পুনর্মিলনী ও আধিপত্যের রোমাঞ্চে জমজমাট এক লড়াইয়ের আদর্শ দৃষ্টান্তে পরিণত হতে পারে মিউনিখের এই ম্যাচ। যেখানে উৎসবের মধ্যমণি হতে পারেন লেভা।
বায়ার্ন শিবিরে ইতিমধ্যে লেভাকে সতর্কতা জারি করেছেন কোচ ইউলিয়ান নাগলসমান। প্রতিপক্ষ লেভা নন, ব্যক্তি লেভার সঙ্গে নাকি দেখা করতে উন্মুখ হয়ে আছেন তিনি। ম্যাচ–পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমি তার অপেক্ষায় আছি। সে ব্যক্তি হিসেবে যেমন, প্রতিপক্ষ হিসেবে তেমন নয়। কারণ, প্রতিপক্ষ হিসেবে সে ভয়ংকর।’
তবে ব্যক্তি লেভা যে প্রতিপক্ষ হয়েই দেখা করতে আসছেন, সে সত্য কি চাইলেই ভুলতে পারবেন নাগলসমান। অন্যদিকে লেভাকে দিয়েই বায়ার্ন–জুজু তাড়াতে চায় বার্সা। মিউনিখ যে ভূতের বাড়ি নয়, তা বলে শিষ্যদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন জাভি হার্নান্দেজ, ‘বায়ার্নের বিপক্ষে আমি মুদ্রার দুই পিঠই দেখেছি—ওদের সঙ্গে হেরেছি আবার জিতেছিও। আমি জানি, সাম্প্রতিক ফলাফল আমাদের পক্ষে নেই, কিন্তু ফুটবলে সব ফলই ঘুরেফিরে আসে। আমি এটাকে ভূতের বাড়ি বলব না, এটা বায়ার্ন মিউনিখ।’ এখন জাভির দল ‘ভূতের বাড়ি’ তাড়াবে নাকি আরেকটি বায়ার্ন শো হবে, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
হলান্ডের জন্য ডর্টমুন্ডের মুখোমুখি হওয়া অবশ্য লেভার মতো উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের নয়। ইতিহাদে তাঁর দল ম্যানচেস্টার সিটি ফেবারিট হিসেবেই আতিথ্য দেবে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে। তবু পুরোনো ক্লাব বলে কথা! ডর্টমুন্ডেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম ধাপ পেরিয়েছেন হলান্ড। তাই রোমাঞ্চ কম থাকতে পারে। তবে আবেগ নিশ্চিতভাবে একটুও কমবে না।
আর গোল করার ধারাবাহিকতায় ডর্টমুন্ডে নিজেকে যেভাবে চিনিয়েছেন, সেটিও হলান্ড ধরে রাখতে চাইবেন কালকের ম্যাচে। হয়তো উদ্যাপনটা হলান্ড–সুলভ হবে না, গোলের পর হাত তুলে ক্ষমাও চাইতে দেখা যেতে পারে। তবে গোল করার লক্ষ্য থেকে যে একচুলও বিচ্যুত হবেন না, সে ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করাই যায়।