বিশ্বাসটা শেষমেশ অনেকেরই থাকে না। হয়তোবা সিংহভাগেরই।
থাকবে কী করে! দিন বদলে দেওয়ার সংকল্প তো এবারই প্রথম শোনা যাচ্ছে না। প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বরগুলো মিইয়ে যেতেও সময় লাগেনি। শোনা যায়, ১৯৭৫ সালে আমেরিকায় ড্রপআউট হয়েছিলেন ১৬ হাজার শিক্ষার্থী। তাঁদের ভেতর বিল গেটস ও পল অ্যালেনের নামটাই কেবল আপনি জানেন।
মারিয়া মান্দা-সানজিদাদের নিন্দুক থাকাই তাই স্বাভাবিক। এমনিতেই তাঁদের বেড়ে ওঠা সমাজে বাস্তবতা যা, তাতে মেয়ে হয়ে ঘরের বাইরে বেরোনোও নিষিদ্ধ মানেন অনেকে। বাংলাদেশ এমনি এমনি তো আর লিঙ্গবৈষম্যের র্যাঙ্কিংয়ে ৭১তম অবস্থান পায়নি! আর সে দেশে জন্মে কিনা মেয়েদের পায়ে ফুটবল? এর বিরুদ্ধে তাই রাস্তায়ও নামতে দেখা গেছে ও যাবে অনেককে।
সমাজ-সংস্কৃতি ভুলে কেবল ফুটবলেই যদি দৃষ্টিটা স্থির রাখা যায়, সেখানেও আশার বাতিঘর নেই। একের পর এক পরিকল্পনা হাতে নিয়েও লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না, উল্টো ফুটবলটা আরও পিছিয়ে যাচ্ছে যেন। পুরুষ ফুটবল দলের র্যাঙ্কিংই যেখানে ১৯২, নারী ফুটবল নিয়ে তাই কানাঘুষা চলবে আরও। যে দিন এত যুগেও বদলায়নি, এত পুরুষ মানুষের চেষ্টা সেটাই বদলে দেবে অজপাড়াগাঁ, দুর্গম অঞ্চল থেকে উঠে আসা কিছু মেয়ে—এ বিশ্বাস করতে পারবে না বেশির ভাগই।
‘রিস্ক স্যাভি’ বইয়ে জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ জার্ড গিগেরেঞ্জার যার নেপথ্য কারণটা লিখে গিয়েছিলেন সরাসরিই, ‘রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা মানুষের বাই-ডিফল্ট।’
‘হ্যাঁ, বদলাবে’—এ স্বপ্ন দেখার সাহস তাই হবে গুটিকয় মানুষের। এ স্বপ্নের পিছু ছুটেই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেবেন কোনো মা, কোনো বোন বাজারে তুলবে সাধের গয়না। কেউবা গোটা সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হবেন একজন মিনতি রানী।
কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই প্রধান শিক্ষিকার কাছে আমন্ত্রণ গিয়েছিল আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে মেয়েদের দল পাঠানোর। শুনে গ্রামের পাঁচজনে বলেছিল, ‘মেয়ে মানুষের আবার খেলা কিসের? এগুলো গ্রামে চলবে না।’ তবু টলেননি তিনি, ‘মেয়েরাও পারে’ বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সবার মধ্যে।
ওই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন আবার হয়ে গিয়েছিলেন ‘উন্মাদ’। এক বিকেলে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিলেন একদল কিশোরীকে। তখনো গ্রামটায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি বলে ফুটবল খেলা সম্পর্কে নিতান্তই গণ্ডমূর্খ গোছের কয়েকজনও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সেই দলে। মেয়েরা ফুটবল খেলতে শুরু করেছিল হাতে হাতে। এসব মেয়েকেই তিনি শেখালেন পাসিং, ড্রিবলিং।
ড্রিবলিংয়ের জাদুতে কোনো একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উথালপাতাল ঢেউ তুলবেন তাঁরই কোনো ছাত্রী, একদিন দেখা দেবেন কৃষ্ণা রানী সরকার হয়ে—এ স্বপ্নেই বোধ হয়!
কেউ একজন আবার হয়ে গিয়েছিলেন ‘রাজিব ভাই’। কলসিন্দুরের মেয়েরা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে অংশ নিয়ে প্রথম দুবার আটকে গিয়েছিল আঞ্চলিক পর্বেই। এ বাধা পেরোনোর দাওয়াই নিতে ঢাকা ছুটে এসেছিলেন ওই গ্রামেরই রাজিব নামের এক যুবক। তখনো তো ইন্টারনেট এমন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েনি, তাই আধুনিক ট্রেনিং-ট্যাকটিকসের সব ভিডিও ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্নেহের ভগিনীদের জন্য। যেন পরেরবার আর তাদের খালি হাতে ফিরতে না হয়।
সানজিদারা আর ফেরেনও না। আন্তস্কুল পেরিয়ে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট জেতেন তাঁরা, জেতেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ বিভাগের দক্ষিণ আর মধ্যাঞ্চলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপও।
৯ বছরের পরিক্রমায় পূর্ণতা পায় সানজিদাদের সাফল্যযাত্রা, জেতেন নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাও।
১০ বছরের পথচলায় টীকা-টিপ্পনী যেমন সানজিদাদের সঙ্গী হয়েছে, সঙ্গী হয়েছেন এই রাজিবেরাও। সানজিদা বোধ হয় এ কারণেই ফাইনালের আগে লিখেছেন, ‘যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি (শিরোপা) জিততে চাই।’
জীবনযুদ্ধের যে উপত্যকায় সানজিদার নিত্য যাওয়া-আসা, সেটাই বোধ হয় তাঁকে শিখিয়েছে, জিততে হয় আসলে ওই রাজিবদের জন্যই। প্রবল খরাতেও যাঁরা সোনালি ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান।