ঘাড়ে ভর দিয়ে দুই পা ওপরে তোলা এমবাপ্পে: ছবি যেভাবে কথা বলছে
ছবি কথা বলে—বাক্যটি প্রায়ই শোনা যায়। ছবি আসলেই কয়েক হাজার শব্দের একটি লেখার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। বলে দিতে পারে ঘটনার আগে–পরের নানা বৃত্তান্ত। গতকাল রাতে লিভারপুল–রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচের পরও কথা বলছে তেমন একটা ছবি। এই ছবি একসঙ্গে বলে দিচ্ছে অনেক কথা। ছবিটিতে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে আমরা দেখছি ঘাড়ে ভর দিয়ে দুই পা ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই কথায় অবশ্য খানিকটা ফাঁকি আছে। এটি আসলে স্থির কোনো মুহূর্তের ছবি নয়। বরং ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা থেকে ফ্রেমবন্দী করে রাখা একটি মুহূর্ত। তবে সেই ঘটনার ব্যাখ্যায় সম্ভবত এর চেয়ে ভালো ছবি আর হতে পারত না। এমনকি পুরো ম্যাচটাকে ব্যাখ্যা করার জন্যও সম্ভবত এর চেয়ে ভালো ছবি আর হয়ও না।
দর্শনশাস্ত্রে আলোচনার বড় একটি ক্ষেত্র হচ্ছে দৃশ্যমান সত্য ও বাস্তবতা সম্পর্কিত। অর্থাৎ একটা ছবিতে যা দেখা যায়, সেটা সব সময় বাস্তব না–ও হতে পারে। আমরা যা দেখি, তার সঙ্গে বাস্তবতার মৌলিক পার্থক্য থাকতে পারে। এমবাপ্পের সেই ছবিটাকেও তাই আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার সুযোগ নেই। সেটি মূলত রূপক অর্থে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যে কারণে সাম্প্রতিক নানা বিষয়সহ বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে এই ছবিটা এখন মিমের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এবার বলা যাক ছবির পেছনের গল্পটা। ছবিটা মূলত লিভারপুলের রিপক্ষে রিয়ালের ২–০ গোলে হারা ম্যাচের একটি মুহূর্তের। ভার্জিল ফন ডাইকের ধাক্কায় এমবাপ্পে যখন উল্টো হয়ে পড়ে যান, তখনকার। ভাইরাল না হলেও কাছাকাছি আরেকটি দৃশ্য হয়েছিল একই ম্যাচে। যখন ম্যাচের ৩২ মিনিটে লিভারপুলের তরুণ ডিফেন্ডার কনর ব্রাডলি এমবাপ্পেকে একটি ট্যাকল করেছিলেন। গোল কিংবা জয়–পরাজয় বাদ দিলে সম্ভবত লিভারপুল–রিয়াল ম্যাচের সেরা মুহূর্ত ছিল সেটি।
ব্রাডলির ট্যাকলের এই ভিডিওটি একবার নয়, একাধিকবার টেনে দেখার মতো। প্রতি–আক্রমণ থেকে এমবাপ্পে যখন বাঁ প্রান্ত দিয়ে লিভারপুল বক্সের কাছাকাছি জায়গায় ছিলেন, তখনই ছুটে এসে মাখনের ওপর ছুরি চালানোর মতো করে পা চালিয়ে দেন ব্রাডলি। মুহূর্তের মধ্যে এমবাপ্পে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান, বলের দখল নেন ব্রাডলি। এই মুহূর্তটি এমবাপ্পেকে হয়তো আরও অনেক দিন তাড়া করবে, ফিরে আসতে পারে দুঃস্বপ্ন হয়েও।
এই ট্যাকল সম্ভবত এমবাপ্পের সাম্প্রতিক সময়ের প্রতীকী চিত্রও বটে। যেখানে তাঁর পা কিংবা মাথা কোনোটিই ঠিকঠাক চলছে না, নেই দুটোর মধ্যে কোনো সমন্বয়ও। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পেনাল্টি মিস, হতশ্রী পারফরম্যান্স এবং দলের হার মিলিয়ে অবিশ্বাস্য এক ভজকট অবস্থা। ক্যারিয়ারে এত বাজে সময় সম্ভবত কখনোই আর পার করেননি এমবাপ্পে!
ম্যাচ শেষে এমবাপ্পে পড়েছেন সমালোচকদের ছুরির নিচে। বিশেষ করে উল্টে পড়ার সেই ছবি শেয়ার করে তাঁকে ধুয়ে দিচ্ছেন নেটিজেনরা।
ম্যাচ শেষে এমবাপ্পে পড়েছেন সমালোচকদের ছুরির নিচে। বিশেষ করে উল্টে পড়ার সেই ছবি শেয়ার করে তাঁকে ধুয়ে দিচ্ছেন নেটিজেনরা। যাঁদের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকেরাও আছেন। যে এমবাপ্পেকে রিয়ালের জার্সিতে দেখার জন্য তাঁরা প্রার্থনা করেছিলেন, এখন সেই এমবাপ্পেকেই ভাসিয়ে দিচ্ছেন সমালোচনার ঝড়ে।
যেমন এই ছবি পোস্ট দিয়ে একজন লিখেছেন, ‘এই ছবিটা এমবাপ্পের পারফরম্যান্সের ব্যাখ্যা দিচ্ছে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আপনার মনে হতে পারে এটা স্রেফ একটা মিম। কিন্তু তা নয়, এটা আসলে কিলিয়ান এমবাপ্পে।’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘রিয়ালের স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সাইনিং কোনটি, এডেন হ্যাজার্ড নাকি এমবাপ্পে?’
এমন অসংখ্য মন্তব্য জুড়ে পোস্ট করা হয়েছে এই ছবিটি। এমবাপ্পের পারফরম্যান্স নিয়ে কথা বলেছেন সতীর্থ জুড বেলিংহাম। ফরাসি তারকার চাপে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বেলিংহাম বলেছেন, ‘এটা ম্যাচের বড় একটি মুহূর্ত। কিন্তু খেলায় এমনটা হতেই পারে। সে দারুণ একজন খেলোয়াড়। ভালো খেলোয়াড় হওয়ার কারণে যে চাপ তাকে বহন করতে হয়, সেটাও অনেক বড়। তার পেনাল্টি মিসের কারণে আমরা ম্যাচ হারিনি। কিলিয়ান মাথা উঁচু রাখতে পারে। আমি জানি, সে এমন সব মুহূর্তের জন্ম দেবে, যা ক্লাবের জন্য দারুণ কিছু বয়ে আনবে।’
বেলিংহাম যতই সান্ত্বনার কথা বলুন, এমবাপ্পের এই পারফরম্যান্স আক্ষরিক অর্থেই দুশ্চিন্তা করার মতো। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অস্বাভাবিকভাবে চুপসে যাচ্ছেন বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা। গতকাল রাতে যেমন রিয়াল পায়নি নিজেদের সেরা তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে। ছিলেন না দানি কারভাহাল ও রদ্রিগোর মতো পরীক্ষিতরাও। ফলে অ্যানফিল্ডের গর্জন থামাতে এমবাপ্পের দিকেই তাকিয়ে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ।
কিন্তু আস্থার প্রতিদান দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ এমবাপ্পে। নিতে পারেননি পেনাল্টি থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সমতা ফেরানোর সুযোগও। এমনকি অ্যানফিল্ডকে ১৫ বছর পর রিয়ালের বিপক্ষে লাল উৎসব করার সুযোগও করে দিয়েছেন এ ফরোয়ার্ড। এমবাপ্পের পারফরম্যান্স নিয়ে সাবেক রিয়াল মিডফিল্ডার স্টিভ ম্যাকমানামান বলেছেন, ‘আজ তাকে রিয়ালের দরকার ছিল, কিন্তু সে কিছুই করতে পারেনি। মাদ্রিদের সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে ধুয়ে ফেলবে, আরও একবার সে প্রয়োজনের সময় কিছু করে দেখাতে পারল না।’
এখন দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে এমবাপ্পেকে। ক্যারিয়ারে দুঃসময় একজন ফুটবলারের আসতেই পারে। কিন্তু রিয়ালের মতো দলে এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স নিয়ে নির্বিকার থাকার সুযোগ নেই। তাই যত দ্রুত এমবাপ্পে ছন্দে ফিরতে পারবেন, ততই রিয়ালের জন্য মঙ্গল, তাঁর নিজেরও।