এক ভক্ত রোনালদোকে তুললেন কোলে, অন্যজন কাঁদলেন শিশুর মতো
লিসবনের এস্তাদিও দে লুইজ স্টেডিয়ামে তখন দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছিল। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে মাঠে ঢুকে পড়েন এক দর্শক। পর্তুগালের পতাকা হাতে দৌড়ে তাঁর মাঠে ঢোকার সময় সবাই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন কী হতে যাচ্ছে। আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও এসব মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কম নয়। মাঠেই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন পর্তুগাল কিংবদন্তি।
সেই দর্শক দৌড়ে তাঁর সামনে গিয়ে প্রথমে মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন। মাথাটা একদম রোনালদোর দুই পায়ের মাঝে মাটিতে রেখে গভীর ভালোবাসার সেই কুর্নিশেও মন ভরেনি ভক্তটির। এরপর করলেন কী, রোনালদোকে পাঁজা করে কোলেও তোলার চেষ্টা করলেন!
রোনালদো পৃথিবীব্যাপী ভক্তদের এমন ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত। পর্তুগিজ তারকা জানেন, ভক্তদের কারণেই আজ তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, এই ভক্তরাই তাঁদের মতো তারকাদের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারলে সেটা সারা জীবনের গল্পের খোরাক। রোনালদো সে জন্যই সম্ভবত মাঠে ঢুকে পড়া সেই উন্মাদ দর্শক যখন তাঁকে কোলে তুললেন, এতটুকু বাধাও দেননি। উল্টো ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে হাসছিলেন।
নিরাপত্তারক্ষীরাও ততক্ষণে ছুটে এসেছেন মাঠে। কিন্তু কিংবদন্তিকে সেই ভক্তের অর্ঘ্য দেওয়ার একটু বাকি ছিল। নিরাপত্তারক্ষীরা ধারেকাছে আসার আগেই রোনালদোর বিখ্যাত ‘সিউ’ গোল উদ্যাপনটা তাঁর সামনেই সেরে নিয়ে ভোঁ-দৌড় দেন সেই ভক্ত, যেন বিশ্বজয় করেছেন! স্টেডিয়ামে তখন করতালির আওয়াজ, শেষ বাঁশি বাজার পর সেই উন্মাদ ভক্তেরও নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার কথা।
২০২৪ ইউরো বাছাইপর্বে কাল রাতের এ ম্যাচে বসনিয়াকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে পর্তুগাল। তিন ম্যাচের সব কটি জিতে ‘জি’ গ্রুপের শীর্ষে রোনালদো-ব্রুনো ফার্নান্দেজরা। আল নাসরের তারকা রোনালদো অবশ্য গোল পাননি। প্রথমার্ধের ২৩ মিনিটে তার হেডে করা গোল অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেন রেফারি। তবে বের্নার্দো সিলভার গোলে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে প্রথমার্ধ শেষ করেছিল পর্তুগাল। বিরতির পর জোড়া গোল করেন পর্তুগালের মিডফিল্ডার ব্রুনো ফার্নান্দেজ।
গোল না পেলেও ভক্তদের ভালোবাসা এই ম্যাচে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়েছেন রোনালদো। ম্যাচ শেষে ঘটেছে আরেকটি মজার ঘটনা। ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যাস থাকলে ‘আইশোস্পিড’কে নিশ্চয়ই চেনা আছে। তাঁর আসল নাম ড্যারেন ওয়াটকিনস জুনিয়র। বিখ্যাত এই লাইভস্ট্রিমার ইউটিউবে সেরা কনটেন্ট নির্মাতাদের একজন।ব্যক্তিত্ব ও কৌতুক করার দক্ষতায় ভীষণ জনপ্রিয় ‘স্পিড’ নামে পরিচিতি পাওয়া ইউটিউবার। তিনি আবার রোনালদোর পাগলভক্তও।
বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন নিজের আদর্শ ও অনুপ্রেরণাদাতা কিংবদন্তির সঙ্গে দেখা করতে। রোনালদোর সঙ্গে দেখা করতে এর আগে একবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে চলে এসেছিলেন স্পিড। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সেদিন রোনালদোকে ম্যাচের স্কোয়াডে না রাখায় তাঁর ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি। তবে নিজের লক্ষ্য পূরণে লেগে থাকলে যে সফলতা পাওয়া যায়, সেটা স্পিডকে দেখলেই বোঝা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা স্পিড রোনালদোকে প্রথমবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন এস্তাদিও দে লুইজ স্টেডিয়ামে। পর্তুগালের উইঙ্গার রাফায়েল লিয়াওয়ের সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন স্পিড। স্টেডিয়াম থেকে রোনালদো যখন গাড়িতে বেরোচ্ছিলেন, তখন এক পাশেই স্পিডকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন লিয়াও। রোনালদোর গাড়ি দেখেই হাত ইশারা করে থামতে বলেন লিয়াও। এরপর গাড়ির কাছে গিয়ে লিয়াও হাত ইশারায় কিছু একটা বলেন রোনালদোকে। দেখে মনে হয়েছে, একজন ভক্তের সঙ্গে দেখা করতে হবে, সেটা বলেছেন রোনালদোকে।
এরপর যা ঘটল স্পিড সারা জীবন তা মনে রাখবেন। রোনালদো গাড়ির দরজা খোলার সময়ই আনন্দে শিশুর মতো লাফাচ্ছিলেন স্পিড। পর্তুগিজ কিংবদন্তি গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় স্পিডের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন! থরথর আবেগ ভর করেছিল তাঁর মধ্যে। শিশুর মতো লাফাতে লাফাতে ‘ও মাই গড! ও মাই গড!’ বলছিলেন। রোনালদো একটু কাছে আসতেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন স্পিড, যেন সামনে কোনো অবতার দাঁড়িয়ে! এরপর কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে কিছু একটা বলেই জড়িয়ে ধরেন রোনালদোকে। পর্তুগিজ তারকাও উষ্ণ আলিঙ্গন উপহার দেন স্পিডকে।
রোনালদো এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দের আতিশয্যে স্পিড বুঝতে পারছিলেন কী করা উচিত! বারবার বলছিলেন, ‘ও মাই গড!’; মানে, স্পিডের বিশ্বাস হচ্ছিল না রক্ত-মাংসের রোনালদো তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে! তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন—এটাও হয় নাকি! আবেগে কাঁপতে কাঁপতে স্পিড দেখিয়েছেন নিজের বাঁ হাতে রোনালদোর ট্যাটু। ছবি তোলার সঙ্গে রোনালদোকে নিয়ে তাঁর ‘সিউ’ গোল উদ্যাপনও সেরেছেন। রোনালদো চলে যাওয়ার পর স্পিডের প্রতিক্রিয়া মনে রাখবেন আশপাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখা অনেকেই। লাফাতে লাফাতে স্পিড বলছিলেন, ‘আই ডিড ইট! আই ডিড ইট! টোল্ড ইউ ব্রো, আই ডিড ইট!’
পর্তুগালের জার্সি পরিহিত স্পিড রোনালদো চলে যাওয়ার পরও নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি। সে জায়গাতেই বসে পড়ে ‘ও মাই গড’ বলতে বলতে শিশুর মতো বিলাপ করছিলেন। এই বিলাপ শোকের নয়, নির্ভেজাল আনন্দের, নিখাদ ভালোবাসাসূচক।
রোনালদোর এই ৩৮ বছর বয়সেও খেলে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়তো ভক্তদের এই নিখাদ ভালোবাসা। ভালোবাসা পাওয়ার লোভ তো সবারই থাকে, তাই না?