ব্রাজিলের ‘ছোট মেসি’ স্বপ্ন দেখেন বার্সেলোনায় খেলার
‘নতুন পেলে’, ‘নতুন ম্যারাডোনা’ বা ‘নতুন মেসি’—ফুটবলে এমন বিশেষণ খুবই নিয়মিত ও সাধারণ বিষয়। প্রতিভাবান নতুন কোনো ফুটবলারের আবির্ভাবে নামের সঙ্গে প্রায়ই এ বিশেষণগুলো জুড়ে দিতে দেখা যায়। অতি ব্যবহারে এই বিশেষণগুলো অনেক সময় বিরক্তির কারণও হয়। আর এসব নামের ভার সামলাতে না পেরে অনেক সম্ভাবনাময় ফুটবলার ছিটকে পড়েন দৃশ্যপট থেকে। কে জানে, এ নামের ভারটাই তাঁদের জন্য কাল হয় কি না!
এরপরও অবশ্য বন্ধ হয়নি এ ধারা। এখনো প্রতিনিয়ত শোনা যায় ‘নতুন মেসি’ বা ‘নতুন পেলে’দের উঠে আসার গল্প। সে ধারায় এবার যুক্ত হয়েছে ব্রাজিলিয়ান বিস্ময়বালক এস্তেভাও উইলিয়ান। যাকে অবশ্য ঠিক ‘নতুন মেসি’ বলা হচ্ছে না, তাকে ডাকা হচ্ছে ‘মেসিনিও’ নামে। মেসিনিওর আক্ষরিক অর্থ ছোট মেসি। এরই মধ্যে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর নজরেও পড়েছে ১৬ বছর বয়সী এই কিশোর।
উইলিয়ান তার বয়সভিত্তিক ক্যারিয়ার শুরু করে ক্রুজেইরোতে। সেখানেই মূলত মেসিনিও হিসেবে পরিচিতি পায় এই উদীয়মান ফুটবলার। চার বছর এই ক্লাবে কাটিয়ে সে চলে আসে পালমেইরাসে। ক্রুজেইরো থেকে তাকে নাকি রীতিমতো ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে যায় পালমেইরাস। এ নিয়ে অবশ্য ব্রাজিলের ফুটবলে লঙ্কাকাণ্ডও হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পালমেইরাসে রয়ে যায় এই ব্রাজিলিয়ান। এরপর থেকে এই ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলে খেলে নিজেকে আরও পরিণত করে গড়ে তুলছে উইলিয়ান।
সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলার তৈরির জন্য পালমেইরাস অবশ্য বেশ আলোচিত নাম। কদিন আগে এ ক্লাব থেকে রিয়ালে যাওয়ার কথা পাকা করেছেন আরেক ব্রাজিলিয়ান কিশোর এনদ্রিক। সবকিছু চূড়ান্ত হলেও বয়সের বাধায় এখনো সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ক্লাবটিতে যোগ দেওয়া হয়নি তাঁর। আগামী জুনে ১৮ পূর্ণ করার পর রিয়ালে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লেখাবেন এই ব্রাজিলিয়ান।
এখন এনদ্রিকের মতো উইলিয়ানকেও ইউরোপিয়ান কোনো পরাশক্তির কাছে পাঠাতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে পালমেইরাস। ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর আগ্রহ বলছে, সে কাজটা খুব কঠিন হবে না। ইউরোপের একাধিক ক্লাব এরই মধ্যে উইলিয়ানকে নিতে আগ্রহী। যদিও খুদে এই ফুটবলারের স্বপ্ন বার্সেলোনার হয়ে খেলা।
ইউরোপিয়ান ক্লাবের রাডারে আসায় এই মুহূর্তে আলোচনায় এলেও উইলিয়ান কিন্তু আরও আগেই আলোটা নিজের দিকে টেনে নেয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে নেইমার এবং রদ্রিগোকে টপকে সবচেয়ে কম বয়সী ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তি করেছে নাইকির সঙ্গে। পরে এ চুক্তি বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।
আর মাঠেও উইলিয়ানের সাফল্যের চিত্রটা দারুণ রোমাঞ্চকর। ২০২১ সাল থেকে পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে ৮টি শিরোপা জিতেছে মেসিনিওখ্যাত ফুটবলার। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক দলের একটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে সাও পাওলোর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেও সবার নজর কেড়েছে উইলিয়ান।
বয়সভিত্তিক দলে আলো ছড়িয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সী মূল দলেও সুযোগ পেয়েছে উইলিয়ান। গত বছর ব্রাজিলিয়ান সিরি ‘আ’র শেষ ম্যাচে সাবেক ক্লাব ক্রুজেইরোর বিপক্ষে মাঠে নেমে অভিষেক হয় তার। যা তাকে ক্লাবটির কম বয়সী খেলোয়াড়দের তালিকায় ৪ নম্বরে জায়গা করে দিয়েছে।
এ বছর উইলিয়ানের ক্যারিয়ারের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে। তবে মেধা ও যোগ্যতায় দুই হাতে সাফল্য কুড়িয়ে নিতে উইলিয়ান প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলের প্রধান জোয়াও পাওলো সাম্পাইও। ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এই ধরনের খেলোয়াড়ের খুব শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব থাকে, অহমে চালিত হয়ে তারা বলতে পারে, “আমি আমিই, আমি পারি এবং আমি পারব।” আর তারা সেটা করেও দেখায়। এমন অন্য গ্রহের প্রতিভাদের জন্য কাজটা সহজও হয়ে যায়।’
উইলিয়ানকে মেসিনিও নামে ডাকা নিয়েও এ সময় কথা বলেছেন সাম্পাইও। এই নামকে পেছনে ফেলে নিজেকে আলাদাভাবেই চেনাতে চায় এখনো কৈশোরের বৃত্তে থাকা এই ফুটবলার। তবে প্রতিভার দিক থেকে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সঙ্গে তাঁর মিলের বিষয়টি অস্বীকার করেননি এই কোচ। ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মেসিনিও ডানা মেলতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনূর্ধ্ব–১৭ বিশ্বকাপ দিয়ে অভিষেকও হয়েছে তার। টুর্নামেন্টে দলের হয়ে তিন গোলের পাশাপাশি তিনটি সহায়তাও করেছে উইলিয়ান। যদিও আর্জেন্টিনার কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় তার দলকে।
মেসির সঙ্গে তুলনাই বলে দিচ্ছে তার মূল শক্তির জায়গা হচ্ছে ড্রিবলিং। যদিও উইঙ্গার হিসেবে খেলা এই ফুটবলারের যাত্রাটা মাত্র শুরু। এখনই মেসির সঙ্গে তুলনা তাই অনেকের কাছে বাড়াবাড়িও মনে হতে পারে। তবে সামনে থেকে তাকে দেখা সাম্পাইও জানালেন উইলিয়ানকে কেন মেসিনিও বলে ডাকা ন্যায্য, ‘বলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য। বল পায়ে গতিতেও সে অসাধারণ। পালমেইরাসের ফটোগ্রাফার তার বল পায়ে নিয়ে দৌড়ানোর পরপর ১০০টি ছবি তুলেছেন। সবগুলোয় দেখা গেছে, বলটা তার বাঁ পায়ে আটকে ছিল।’
প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এখনো উন্নতির অনেক জায়গা আছে উইলিয়ানের। সাম্পাইও অবশ্য সময়ের সঙ্গে ঘাটতিগুলো পুষিয়ে যাবে বলেই মনে করেন, ‘এরপর তাকে শারীরিকভাবে উন্নতি লাভ করতে হবে। যদিও এটা কেবলই সময় এবং পরিপক্বতার ব্যাপার।’
তার সঙ্গে পালমেইরাস সতীর্থ এনদ্রিক ও লুইস গিলের্মের তুলনা করে এ সময় সাম্পাইও বলেছেন, ‘উইলিয়ান টেকনিক্যালি দারুণ প্রতিভা। যদিও শারীরিকভাবে সে এখনো পুরোপুরি পরিপক্ব নয়। বাকি দুজনের চেয়ে সে বয়সে ছোট এবং শারীরিকভাবে পরিপক্বতা আসা বাকি আছে। তবে সে একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড়।’
নামটা মেসিনিও হলেও তার মধ্যে অনেকে আরেক আর্জেন্টাইন আনহেল দি মারিয়ার ছায়াও দেখতে পান। বল পায়ে রাখার ক্ষমতা এবং জাদুকরি বাঁ পায়ের কারণে মূলত সে উইলিয়ান এত দুর্দান্ত। তা ছাড়া উইং দিয়ে ঢুকে যেকোনো রক্ষণকে নাস্তানাবুদ করতে পারে এই ফুটবলার। এসবের সঙ্গে দুর্দান্ত ড্রিবলিং এবং জোরালো শটের বিষয়টি তো আছেই।
প্রতিভায় ভরপুর হলেও ২০২৫ সালের এপ্রিলে ১৮ হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে ব্রাজিলেই থাকতে হবে। তবে এনদ্রিকের মতো আগেই হয়তো ইউরোপে নিজের গন্তব্য ঠিক করে রাখবে সে। এরই মধ্যে চেলসি, আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি এবং বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাবগুলো তার প্রতি আগ্রহী। তবে এরই মধ্যে বার্সা নিজের স্বপ্নের ক্লাব বলে মন্তব্য করেছেন উইলিয়ান। তিনি বলেছেন, ‘আমার স্বপ্ন বার্সেলোনায় খেলা, এটা বিশ্বের সেরা ক্লাব। আমি মেসি, নেইমার এবং লুইস সুয়ারেজের খেলা দেখে বড় হয়েছি।’
বার্সা অবশ্য তাকে নিতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন আছে। কারণ, তার রিলিজ ক্লজ ধরা হয়েছে ৩৮ থেকে ৫১ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে থাকা বার্সা এত টাকা খরচ করে তাকে কিনবে কি না, সে প্রশ্নও তাই প্রাসঙ্গিক। তবে এই মুহূর্তে বার্সায় না হলেও ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলো যে তাকে লুফে নেবে, সে কথা বলাই যায়।