মেসি–রোনালদো–নেইমারের বিদায়ে ইউরোপে যুগের সমাপ্তি
এক বছর আগেও কাউকে যদি বলতেন, পরের মৌসুমে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং নেইমার আর ইউরোপে খেলবেন না। তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই আপনাকে পাগল বলতেন। এ–ও আবার হয় নাকি!
অনেকের কাছেই তাঁরা গত দুই দশকের সেরা তিন তারকা। ইউরোপের বাইরে এই মুহূর্তে এ তিনজনের খেলার বিষয়টি হয়তো তাঁদের কঠোর সমালোচকেরাও কল্পনা করেনি। কিন্তু ফুটবল কখনো কখনো এমন বিস্ময় উপহার দেয়। উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গালেয়ানো তাঁর ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বইয়ে লিখেছিলেন, আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শিল্প থেকে যন্ত্রের দিকে। সেই যান্ত্রিকতায় ফুটবলের ওপর একসময় চাপিয়ে দিতে শুরু করে অর্থের বোঝা।
যার শুরুটা করেছিল ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোই। মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরদের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে তারা নিজেদের মধ্যেই তৈরি করে বিশাল অর্থনৈতিক ব্যবধান। আর এখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় ফুটবলকে ঠেলে দিয়েছে এক চরম অসহায়ত্বের দিকে। যার ফলে এখন রীতিমতো তারকাশূন্য হতে বসেছে লিগগুলো। এর মধ্যে নিজেদের সেরা তিন পোস্টার বয়কে হারিয়ে ফেলেছে ইউরোপ।
মেসি–রোনালদোর বিষয়টা তবু মেনে নেওয়ার সুযোগ আছে। ইউরোপে নিজেদের অর্জনের ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন তাঁরা। কিন্তু নেইমার? যাঁকে বলা হচ্ছিল মেসি–রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি! তিনি উত্তরসূরি হলেন বটে। কিন্তু সেটা অর্জনে নয়, বরং ইউরোপ ছেড়ে যাওয়ায়। আর আট মাসের ব্যবধানে এই তিনজনের ইউরোপ ছেড়ে যাওয়ায় একটি যুগের সমাপ্তিও ঘটল।
ইউরোপীয় ফুটবল মঞ্চে প্রথম তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন রোনালদো। ২০০২ সালে স্পোর্টিং লিসবনের বি দলের হয়ে যাত্রাটা শুরু হয় তাঁর। তবে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে শুরু করেন পরের বছর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসার পর। অন্যদিকে বার্সেলোনা সি দলের হয়ে পেশাদার ফুটবলে মেসি যাত্রা শুরু করেন ২০০৩ সালে। মূল দলে অভিষেক হয় এক বছর পর। অল্প সময়ের ব্যবধানে গোটা ইউরোপিয়ান ফুটবলের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন এই দুজন।
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতেন রোনালদো। সেই শুরু। এরপর থেকে গোটা মসনদ ভাগাভাগি করে নেন এই দুজন। পালা করে শাসন করেছেন। এ দুজন যখন চূড়ায় উঠে নিজেদের সেরা সময় পার করছিলেন, তখনই আবির্ভাব ঘটে নেইমারের। সান্তোসে প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে এসে মেসির সতীর্থ হিসেবে শুরুটা করেন নেইমার।
প্রতিভার পূর্ণ বিচ্ছুরণ দেখা না গেলেও, গত এক দশকে ফুটবলের পোস্টার বয় হিসেবে মেসি–রোনালদোর পরই জায়গাটা ছিল নেইমারের। জনপ্রিয়তার দিক থেকেও এ দুজনের কাতারেই অবস্থান ছিল নেইমারের। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাটনটাও ছিল তাঁর হাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩১ বছর বয়সে মেসি–রোনালদোর পথ ধরেই ইউরোপ ছাড়লেন নেইমারও।
ব্যক্তিগত অর্জনে নেইমারকে নিয়ে আক্ষেপটুকুকে এক পাশে সরিয়ে রাখলেও এই তিনজনের সম্মিলিত অর্জন ঈর্ষণীয়। তিনজন মিলে লিগ শিরোপা জিতেছেন ২৬টি। ইউরোপীয় শীর্ষ ৫ লিগের চারটিতেই লিগ শিরোপা আছে তাদের। রোনালদো লিগ জিতেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগায় এবং জুভেন্টাসের হয়ে সিরি ‘আ’তে। মেসি লিগ জিতেছেন লা লিগায় বার্সেলোনার হয়ে এবং লিগ ‘আঁ’তে পিএসজির হয়ে।
অন্যদিকে নেইমার লিগ জিতেছেন বার্সা ও পিএসজির হয়ে। এ তিনজন সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন ১০টি। এ ছাড়া ছোট–বড় অসংখ্য শিরোপা জিতেছেন তাঁরা। আর ইউরোপে এ তিনজনের সম্মিলিত গোলসংখ্যা ১ হাজার ৬৩৪। যেখানে মেসির গোল ৭১০, রোনালদোর গোল ৭০১টি এবং নেইমারের গোল ২২৩টি। কিন্তু এসবই এখন অতীত। নেইমারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে এই ত্রয়ীর ইউরোপের গল্পটা এখন অতীতের পেটে প্রবেশ করেছে।
কবি উৎপলকুমার বসু তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘সূর্য ডোবা শেষ হল কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর।’ হ্যাঁ, ইউরোপের ‘সূর্য’টা ডুবেছে বটে। কিন্তু যাত্রাটা এখনো শেষ হয়নি। আলাদা লিগে এরই মধ্যে অন্য এক দ্বৈরথে মেতে উঠেছেন মেসি–রোনালদো। সামনে নেইমারও নামবেন সেই লড়াইয়ে। যেখানে তিনি সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাবেন রোনালদোকে। আর এই তিনজন যখন একসঙ্গে ইউরোপ থেকে দূরে নিজেদের নতুন গল্প লিখবেন, তখন নক্ষত্র হারানোর বেদনায় ইউরোপিয়ান ফুটবলের বাতাসটা কি আরেকটু ভারী হয়ে উঠবে না!