কোন পথে যাচ্ছে এমবাপ্পের দলবদল
তিন মৌসুম ধরে চলছে একটি দলবদল! অবাক করার মতো হলেও, কিলিয়ান এমবাপ্পের দলবদল নিয়ে চাইলে এ কথা বলায় যায়। প্রতিবারই এই ফরাসি স্ট্রাইকারের দলবদলের উত্তাপ যেন কয়েক গুণ করে বাড়ছে। যা এই মৌসুমে এসে রূপ নিয়েছে পিএসজি-এমবাপ্পে-রিয়াল মাদ্রিদের এক ত্রিমুখী লড়াইয়ে।
এই লড়াইয়ের শুরুটা আসলে ৬ বছর আগে, ২০১৭ সালে। এমবাপ্পের তখনো তারকা হয়ে ওঠেননি। মোনাকোতে মাত্রই নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছেন। তবে কিশোর এমবাপ্পের মধ্যেই বড় তারকা হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনাটাই দেখতে পেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ওই বছরের জুলাইয়ে এমবাপ্পের জন্য ১৬ কোটি ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিল স্প্যানিশ পরাশক্তিরা। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। পরের মাসেই ১৮ কোটি ইউরোতে তাঁকে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় বানিয়ে কিনে নেয় পিএসজি। সেখানেই শেষ পারত সব নাটকীয়তার। কে জানত, দলবদলের ঐতিহাসিক এক নাটকের সেটি মাত্র শুরু।
এরপর অবশ্য ২০২১ পর্যন্ত পিএসজির সেরা তারকা হিসেবে নির্বিঘ্নে খেলে গেছেন এমবাপ্পে। এমবাপ্পে–পিএসজির সাজানো সংসারে রিয়ালের কাছ থেকে দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসে ২০২১ সালের এপ্রিলে। সে সময় রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ ক্লাব সমর্থকদের এমবাপ্পেকে আনার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করার কথাও জানান। পেরেজের করা মন্তব্যের জবাবটা পিএসজি সভাপতি নাসের আল খেলাইফি দেন একই বছরের জুনে। তিনি জানিয়ে দেন, এমবাপ্পে বিক্রির জন্য নয়। এরপরও আগস্টের দলবদলে এমবাপ্পের জন্য ১৬ কোটি ইউরোর প্রস্তাব দেয় রিয়াল। কিন্তু জোর চেষ্টাতেও এমবাপ্পেকে পিএসজি থেকে বের করতে পারেনি রিয়াল। এমবাপ্পে থেকে যান পিএসজিতেই।
পরের বছরও মঞ্চস্থ হয় একই নাটক। তবে এবার নাটকীয়তা যেন আরও তুঙ্গে। এমবাপ্পে নিজেও স্বপ্নের ক্লাব রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিয়ে দেন। মরিয়া হয়ে উঠে রিয়ালও। তবে তাঁকে ধরে রাখার ব্যাপারে পিএসজি ছিল আগের চেয়েও বেশি অটল। এমনকি এই ফরাসি তারকাকে প্যারিসে থাকার জন্য অনুরোধ করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও। এমবাপ্পেকে নিয়ে রিয়াল–পিএসজির এই টানাটানি চলে একেবারে দলবদলের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
যেখানে শেষ পর্যন্ত সফল হয় পিএসজি। এমবাপ্পের সঙ্গে ২০২৫ পর্যন্ত চুক্তিও নবায়ন করে ক্লাবটি। এবার এমবাপ্পেকে না পেয়ে কিছুটা দমে যায় রিয়াল। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তো বলেই দেন, এমবাপ্পে আর সেই এমবাপ্পে নেই। তাঁর ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ না থাকার কথাও জানিয়ে দেন রিয়াল সভাপতি। কিন্তু ইউরোপীয় দলবদলে শেষ কথা বলে কিছু নেই। চুক্তি হওয়ার আগে কোনো কথায় চূড়ান্ত নয়। এমবাপ্পের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।
এবার এমবাপ্পেকে নিয়ে নাটকের শুরুটা হয়ে একটি ‘চিঠি’ রূপে পাঠানো একটি ‘বোমা’কে কেন্দ্র করে। সেই চিঠিতে এমবাপ্পে পিএসজিকে জানিয়ে দেন, ২০২৪ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি আর চুক্তি নবায়ন করতে চান না। এমবাপ্পের এই চিঠির জবাব দিতে দেরি করেনি পিএসজিও। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা জানায়, চুক্তি নবায়ন না করে এক মৌসুম ক্লাবে থাকার কোনো সুযোগ নেই। হয় চুক্তি নবায়ন করতে হবে, নয়তো এবারের দববদলই ছাড়তে হবে ক্লাব।
নিজেদের সেরা খেলোয়াড়কে কোনো অবস্থাতেই বিনামূল্যে ছাড়তে চায় না তারা। কিন্তু এমবাপ্পে বারবার জানান, তিনি এই গ্রীষ্মে নয়, দলবদল করতে চান আগামী গ্রীষ্মে। তবে এমবাপ্পে থাকতে চাইলেও পিএসজি এরই মধ্যে নিজেদের পরিকল্পনা থেকে তাঁকে ছেঁটে ফেলে। প্রাক্–মৌসুম সফরে এমবাপ্পেকে বাদ দিয়েই ফ্রান্স ছাড়ে দলটি। এমনকি ক্লাবে থেকে গেলে তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার কথাও শোনা যায়। যদিও এমন আচরণের জন্য তোপের মুখেও পড়তে হয় পিএসজিকে। খেলোয়াড়দের সংগঠনের পক্ষ থেকে মামলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
এদিকে এমবাপ্পের লক্ষ্য রিয়াল হলেও, এরই মধ্যে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে যায় লিভারপুল ও আল হিলালের নামও। আল হিলাল এমবাপ্পের জন্য ৩০ কোটি ইউরোর প্রস্তাব নিয়ে আসে। কিন্তু এমবাপ্পের আল হিলালের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখাই করেননি। এর মধ্যে শোনা যায় তাঁকে ১ বছরের জন্য ধারে নিতে চায় লিভারপুলও। যদিও এই খবর হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ।
এদিকে এমবাপ্পেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি নবায়নের জন্য চূড়ান্ত সীমা বেঁধে দিয়েছিল পিএসজি। সে সময় পার হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি এখন আরও ঘোলাটে হয়েছে। এখন পিএসজিকে হয় আগামী বছর এমবাপ্পেকে বিনা মূল্যে ছাড়তে হবে, নয়তো এবারের দলবদল চলাকালেই বিক্রি করে দিতে হবে। সেটা আবার এমবাপ্পে না চাইলে সম্ভব নয়। এদিকে ৩১ জুলাই পেরিয়ে যাওয়ার পরও পিএসজিতে থাকায় এমবাপ্পেকে আনুগত্য বোনাসের ৮ কোটি ইউরোর মধ্যে ৪ কোটি ইউরো দিতেই হবে পিএসজিকে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এমবাপ্পেকে বিক্রির করতে গিয়ে এখন কাঙ্ক্ষিত মূল্যের সঙ্গে আরও ৪ কোটি ইউরো বাড়তি যোগ করবে পিএসজি।
আপাতত পুরো পরিস্থিতি বেশ শান্তভাবেই পর্যবেক্ষণ করছে রিয়াল। আগের দুইবারের মতো এবার রিয়ালের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সবশেষ খবর অনুযায়ী, এমবাপ্পের জন্য ২২ কোটি ৫০ লাখ ইউরোর বেশি খরচ করতে চায় না তারা। যে খেলোয়াড়কে এক মৌসুম পর বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে তাঁর জন্য অঢেল অর্থ খরচ করতে যাওয়াইবা কেন?
সব মিলিয়ে গত প্রায় দেড় মাসে এমবাপ্পে ও পিএসজির দ্বন্দ্ব এতটাই তুঙ্গে উঠেছে যে এখন পুরো বিষয়টা সব ছাপিয়ে নিজেদের ‘অহম’–এ গিয়ে ঠেকেছে। সবশেষ খবর হচ্ছে, এমবাপ্পের ইস্যুতে পিএসজি নাকি ফিফার কাছে নালিশ করতে যাচ্ছে। পিএসজির দাবি, এমবাপ্পে ২০২৪ সালে রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে এরই মধ্যে মৌখিক চুক্তি করে ফেলেছেন। দলবদলের নিয়ম অনুযায়ী, জুনে চুক্তি শেষ করতে যাওয়া একজন ফুটবলার দলবদল নিয়ে দরকষাকষি শুরু করতে পারেন জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে। এর আগে করতে হলে বর্তমান ক্লাবের অনুমতি নিতে হবে। যদিও এ নিয়ম মানা হয় কদাচিৎ।
তবে এখন পিএসজি যদি এই নালিশ নিয়ে ফিফার কাছে যায়, নিশ্চিতভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। যা শুধু এমবাপ্পের দলবদলকেই নয়, দলবদলের পুরো বাজারকেই অস্থির করে তুলতে পারে।