মায়ামিতে পাওয়া যাচ্ছে মেসি চিকেন, মেসি বার্গার, মেসি বিয়ার

মায়ামিতে চলছে মেসি–ম্যানিয়াছবি: টুইটার

‘আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি’—লিওনেল মেসির এক ঘোষণাতেই যেন বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল। জনপ্রিয়তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এত দিন ধরে পিছিয়ে থাকা খেলাটিই চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রে। প্রায় তিন মাস ধরে মাঠ ও মাঠের বাইরে মেসি-ম্যানিয়ায় উন্মাতাল হয়ে আছে মার্কিন মুলুক।

এরই মধ্যে ইন্টার মায়ামির মাঠের খেলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন মেসি। তাঁর হাত ধরে ইন্টার মায়ামি পেয়েছে নিজেদের প্রথম শিরোপার দেখা। নিশ্চিত করেছে আরেকটি টুর্নামেন্টের ফাইনাল। এমনকি মেজর লিগ সকারেও (এমএলএস) তলানি থেকে উঠে এসে প্লে–অফ নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখছে মায়ামি। এ তো গেল মাঠের অবস্থা, মাঠের বাইরে পরিস্থিতি আরও উন্মাতাল। পুরো দেশেই পড়েছে মেসি-ইফেক্ট।
কদিন আগেও মায়ামির গোলাপি রঙের যে জার্সি ছিল অতি সাধারণ, এখন সেটি যেন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

সব জায়গাতেই দেখা মিলছে মায়ামির ১০ নম্বর জার্সিতে মেসির মুখ। দানবীয় দেয়ালচিত্র, বিলবোর্ড, গণপরিবহন, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সবকিছুতে যেন মেসি আর মেসি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকানে এবং ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রির স্থানগুলোয় ঠাঁই পেয়েছে মেসিকেন্দ্রিক জিনিসপত্র। সমুদ্রসৈকতের বারগুলোয় বিক্রি হচ্ছে মেসি পানীয়, দ্য হার্ড রক ক্যাফেতে বিক্রি হচ্ছে মেসি চিকেন স্যান্ডউইচ ও মেসি বার্গারও। এমনকি স্থানীয় বিয়ার বিক্রেতারাও এখন ক্যানে করে বিক্রি করছেন মেসি নামের বিয়ার। মায়ামির জার্সির আদলে বানানো ক্যানগুলোর ওপরে লেখা জিওএটি (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম) ১০ (মেসির জার্সি নম্বর)।

মেসিকে ঘিরে তৈরি হওয়া এমন পরিস্থিতি নিয়ে ফ্লোরিডা আটলান্টিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া ইতিহাস ও আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজের অধ্যাপক জার্মেইন স্কট বলেছেন, ‘আক্ষরিক অর্থেই যেন এক রাতের মধ্যে সব বদলে গেছে। এমন কিছু আগে কখনো দেখিনি।’

ইন্টার মায়ামির হয়ে লিওনেল মেসির অভিষেক ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন লেব্রন জেমস
ইনস্টাগ্রাম

মেসি আসার পর থেকে ইন্টার মায়ামির ম্যাচ মানেই টিকিট বিক্রির ধুম। এরই মধ্যে প্রতি ম্যাচে সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি টিকিটের দামেও দেখা মিলেছে নতুন নতুন রেকর্ডের। আর মেসি-ম্যানিয়া দেখা যাচ্ছে গ্যালারির ভিআইপি স্ট্যান্ডের দিকে তাকালেও। কিম কার্ডাশিয়ান, লেব্রন জেমস, সেরেনা উইলিয়ামস, পাফ ড্যাডি, ডিজে খালেদ, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, প্রিন্স হ্যারি ও সেলেনা গোমেজদের মতো তারকারা মেসির খেলা দেখতে মাঠে গেছেন।

আরও পড়ুন

টিকিট বিক্রির অনলাইন সাইট টিকপিক বলছে, মেসির আসর পর টিকিটের দামে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন দেখা গেছে। টিকিটের গড় দাম ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ১১০ ডলার থেকে ৬৯০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। সর্বশেষ লস অ্যাঞ্জেলেসের বিপক্ষে ম্যাচের টিকিটের কথাই ধরা যাক। ম্যাচটির টিকিটের মূল্য বেড়েছিল ৫২৭ শতাংশ। সেদিন এমএলএসের ইতিহাসে টিকিট বিক্রিতে নতুন রেকর্ড দেখা গিয়েছিল, যেখানে সবচেয়ে সস্তা টিকিটের দামও ছিল প্রায় ৯০০ ডলার। একই অবস্থা দেখা গেছে জার্সি বিক্রিতেও। বাজারে আসার পর মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সব জার্সি। এমনকি ১৭ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেও অর্ডারের জার্সির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে অক্টোবর পর্যন্ত।

মাঠেও দেখা মিলছে লিওনেল মেসির জাদুর
ছবি : এএফপি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মেসির আগমনের প্রভাব ছিল বৈপ্লবিক। গ্রীষ্মের শুরুতে মেসি আসার ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত ইনস্টাগ্রামে ইন্টার মায়ামির অনুসারী ছিল ১০ লাখ। এখন সেটি ১ কোটি ৫০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এটা শুধু লিগ প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই নয়, বরং আইস হকি, বেসবল বা আমেরিকান ফুটবলকেও ছাড়িয়ে গেছে।

মেসির হাত ধরে বদলে গেছে এমএলএসের ব্যবসায়িক ধ্যানধারণাও। মেসির অভিষেকে এক দিনে সবচেয়ে সাবস্ক্রিপশন হয়েছে অ্যাপল টিভি এবং এমএলএস স্ট্রিমিং পরিষেবায়। এর পর থেকে এই সংখ্যা বেড়েছে ত্বরিত গতিতে। মেসির আগমন এমএলএসের সঙ্গে অ্যাপলের চুক্তিকে লাভের নতুন চূড়ায় নিয়ে গেছে। এটা অবশ্য মেসিকেও সুবিধা দিয়েছে। কারণ তাঁর চুক্তিতে এখানকার লভ্যাংশও যুক্ত আছে।
মেসির মায়ামিতে আসাকে ২০১০ সালে লেব্রন জেমসের মায়ামি হিটে যোগ দেওয়ার পর যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, সেটার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

তবে ফুটবলের বৈশ্বিক জনপ্রিয়তার কারণে এই উন্মাদনা শুধু মায়ামিতেই আটকে থাকেনি; বিশ্বজুড়ে এখন মেসিকে ঘিরে মায়ামির উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে স্কট বলেছেন, ‘আমি জেমসের প্রভাবকে খাটো করতে চাই না। সেটা ছিল আমেরিকান ফেনোমেনন। কিন্তু মেসি যখন এখানে এল, আমরা গোটা দুনিয়াকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করলাম। এটা গোটা দুনিয়া এবং মায়ামিকে এমনভাবে যুক্ত করেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এই মুহূর্তে এমন সমর্থন দেখাটা অবিশ্বাস্য।’

আরও পড়ুন

মায়ামির সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে লম্বা সময় ধরে এই শহরকে ঘিরে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত ছিল। তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। মাদক, সহিংসতা ও সংঘবদ্ধ অপরাধ কার্যক্রম চলে আসছিল ১৯৭০-এর দশকে কোকেন কাওবয়েজের (মাদক সাম্রাজ্যের নাম) সময় থেকে। একসময় মায়ামিকে দেখা হতো ব্যর্থ শহর হিসেবে। এই শহর, এখানকার সন্ত্রাসজগৎ ও মাদককে ঘিরে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রগুলোতেও ফুটে উঠত শহরটির ভয়াবহতা। এমন নয় যে সবকিছু একমুহূর্তে বদলে গেছে। তবে মেসির আগমন এই শহর নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে অনেকটাই পেছনে ঠেলে দিয়েছে।

২০০১ সাল থেকে মায়ামিতে বাস করছেন আর্জেন্টাইন চিত্রশিল্পী অগাস্তো এসকিভেল। তিনি বলেছেন, ‘এটা (মেসির আগমন) আমাদের বৈধতা দিয়েছে। এ জন্য নয় যে সে অসাধারণ খেলোয়াড়; বরং এ জন্য যে সে একজন ভালো মানুষ এবং পারিবারিক মানুষ। সে এখানে ইতিবাচক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।’