‘ম্যানচেস্টার ডার্বি’র ফয়সালা হবে মাঝমাঠেই
ডাগআউটে বসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। প্রহর গুনছিলেন মাঠে নামার। ভক্তদেরও আশা, এই বুঝি তাঁকে মাঠে নামাবেন এরিক টেন হাগ। পুরো ম্যানচেস্টার সেদিন দুটি রঙে বিভক্ত। একভাগের রং লাল, অন্যটি নীল। এমন ম্যাচে রোনালদো দর্শক, ভাবা যায়!
ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই সব শান্ত। নীল অংশে তখন চলছে উৎসব, আর লালদের শিবিরে কবরের নিস্তব্ধতা। অক্টোবরের সেই ম্যাচে ৪৪ মিনিটের মধ্যেই ৪-০ গোলে পিছিয়ে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
এরপরও রোনালদো–ভক্তদের প্রত্যাশা ছিল, এই বুঝি মাঠে নেমে সব বদলে দেবেন ‘সিআর সেভেন’। সেদিনের সেই অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোয়নি। দলে আসা তরুণ তুর্কি আন্তনিকে নামিয়েছেন, তবু রোনালদোকে আর নামাননি টেন হাগ। রোনালদো-টেন হাগ দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বীজটাও রোপিত হয়েছিল সেদিন।
আর্লিং হলান্ড ও ফিল ফোডেনের হ্যাটট্রিকে ৬-৩ গোলে হারের পর রোনালদোর সম্মান রক্ষার্থে তাঁকে নামানো হয়নি বলে জানিয়েছিলেন টেন হাগ। খোদ ইউনাইটেড–ভক্তদেরই হজম হয়নি ডাচ কোচের এই যুক্তি। মাঠে নেমে দলের সম্মান রক্ষাই যে একজন ফুটবলারের কাজ! এরপর জল অনেক দূর গড়িয়ে তিক্ততা বাড়ল রোনালদো-টেন হাগের।
আর শেষ পর্যন্ত ঠিকানা বদলে রোনালদো চলেই গেছেন সৌদি আরবে। তিক্ত সেই স্মৃতিকে কবর দিয়ে ইউনাইটেডও এখন বদলে যাওয়া এক দল। আর তিন মাসের ব্যবধানে আরেকটি ম্যানচেস্টার ডার্বির অপেক্ষায় ইউনাইটেড। অপেক্ষাটা প্রতিশোধেরও। আর এই ম্যাচের ফয়সালাটা হতে পারে মাঝমাঠেই।
বিশ্বকাপ বিরতির পর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে খেলা ৬ ম্যাচের প্রতিটিতে জিতেছে ইউনাইটেড। ওল্ড ট্রাফোর্ডে আজ ‘রেড ডেভিল’দের আত্মবিশ্বাসটা তাই টগবগে থাকারই কথা। অন্যদিকে আগের ম্যাচে সাউদাম্পটনের কাছে হারের স্মৃতি নিয়ে ইউনাইটেডের মুখোমুখি হবে সিটি। শুধু হারই নয়, সেই ম্যাচে বিব্রত হওয়ার মতো আরও ঘটনাও ঘটেছে। কারাবাও কাপের ম্যাচটিতেই পোস্টে কোনো শট নিতে পারেনি পেপ গার্দিওলার দল। সর্বশেষ ২৭৫ ম্যাচের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম পেল ইতিহাদের ক্লাবটি।
তবে টানা ছয় জয় নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগতে গেলেই বিপদে পড়তে হতে পারে ইউনাইটেডকে। এ সময়ে যে ক্লাবগুলোকে তারা হারিয়েছে তাদের সবগুলোই সিটির চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। তাই চার্লটন, এভারটন, বোর্নমাউথ, উলভারহ্যাম্পটন, নটিংহামের মতো ক্লাবকে হারানোর সুখস্মৃতি ভুলেই আজ মাঠ নামতে হবে ইউনাইটেডকে।
তবে এরপরও ইউনাইটেডের বিল্ড-আপ এবং প্রেসিংয়ের যে উন্নতি সাম্প্রতি চোখে পড়েছে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইউনাইটেডের ঘুরে দাঁড়ানো ও সিটির ছন্দ হারানো দুই দলের শক্তির নিক্তিতেও এনেছে ভারসাম্য। তবে ম্যাচ জেতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মাঝমাঠের লড়াই। এ জায়গাতে যারা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে, তারাই ম্যাচটা জেতার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
আগের ডার্বিতে সিটি বাজিমাত করেছিল মূলত প্রেসিংয়ে। সেদিন তাদের হয়ে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন জোয়াও কাসনেলো, ইকেই গুন্দোয়ান এবং বের্নার্দো সিলভা। যেখানে কানসেলো আবার মিডফিল্ডের খেলোয়াড়ই নন। বিপরীতে ইউনাইটেডের হয়ে সেদিন ডাবল পিভট (আক্রমণভাগ ও রক্ষণভাগের সেতু বন্ধনকারী) হিসেবে খেলেছিলেন স্কট ম্যাকটমিনে ও ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। সিটির আক্রমণের তোপে যারা একপর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।
তবে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে একজন খেলোয়াড়ের আগমন টেন হাগের অনেক মাথাব্যথা কমিয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, কাসেমিরোর কথা। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ইউনাইটেডে এসে দুর্দান্ত ছন্দে আছেন এই ব্রাজিলিয়ান। অক্টোবরের সেই ম্যাচে বিরতির পর মাঠে নামলেও ম্যাচের ফলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি কাসেমিরো।
তবে আজ ইউনাইটেডের প্রতিশোধ নিতে হলে নিজের সেরা ছন্দটা ধরে রেখেই জ্বলে উঠতে হবে এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক ব্যর্থতা ভুলে ঘুরে দাঁড়াতে সিটি তাকিয়ে থাকবে রদ্রির দিকে। এই ম্যাচে ফল পেতে ইউনাইটেডকে প্রেসিংয়ের চাপে ফেলার চেষ্টা করতে পারে সিটি। যার সঙ্গে ইউনাইটেডের মানিয়ে নেওয়াটাই ইউনাইটেডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এটি অনেকাংশে নির্ভর করছে, বল পজেশন না থাকার সময় নিজেদের খেলাটা কীভাবে খেলছে তার ওপর।
কাসেমিরোর সঙ্গে মাঝমাঠে জুটি গড়বেন এরিকসেন। নিজেদের সেরা ছন্দে খেললে এই জুটি বিশ্বের যেকোনো শক্তিশালী দলকে বিপদে ফেলার জন্য যথেষ্ট। শুধু আক্রমণভাগ ও রক্ষণের সঙ্গে সমন্বয় করার ক্ষেত্রেই নয়। গোল করাতেও অবদান রাখছেন কাসেমিরো। বিশেষ করে সেট পিসে দারুণ কার্যকর হয়ে ওঠতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। গত অক্টোবরে চেলসির বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে হেডে গোল করে দলকে হার থেকেও বাঁচিয়েছিলেন কাসেমিরো। সিটির বিপক্ষে অবশ্য তাঁকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষেত্রে।
বিশেষ করে গুন্দোয়ান, সিলভা, রদ্রি ও কেভিন ডি ব্রুইনের মতো তারকাদের বিপক্ষেই মূল পরীক্ষাটা দিতে হবে কাসেমিরোকে। সিটির আক্রমণের ঝড় সামাল দিতে গিয়ে আজ হয়তো আক্রমণে সেভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ নাও পেতে পারেন কাসেমিরো। আর ঠিক এ জায়গাতে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে এরিকসেনকে।
কাসেমিরোকে ইনসাইড চ্যানেলগুলো কাভার দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পাশাপাশি রক্ষা করতে হবে ফুল ব্যাকের পেছনে তৈরি হওয়া জায়গাকেও। আগের ডার্বিতে ভরাডুবির পথে এ জায়গাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল ইউনাইটেডকে।
এ ছাড়া প্রতিপক্ষের মোমেন্টাম নষ্ট করার কাজও করতে হবে তাঁকে। সিটির ক্ষেত্রে এই কাজগুলো করার দায়িত্ব থাকবে রদ্রির ওপর। একাদশে তাঁর উপস্থিতি মানেই রক্ষণভাগের নির্ভার থাকা। বিশেষ করে বল যখন নিজেদের দখলে থাকে না, সে সময় তাঁর গতিবিধি ম্যাচের গতিপথ নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
মাঝমাঠের খেলোয়াড়েরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করলে ইউনাইটেড আক্রমণভাগের জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। তখন ইউনাইটেডের তিন ফরোয়ার্ড চেষ্টা করবেন সিটির ব্যাকলাইনকে চাপে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে।
টেন হাগের কৌশল থাকবে মূলত মাঝমাঠকে সংকুচিত করে সিটির আক্রমণের গতিকে থামিয়ে দিয়ে বল পুনরুদ্ধার করতে। সেটি করতে পারলে দ্রুত পাল্টা আক্রমণে গিয়ে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে তারা। একটি ধাপ থেকে অন্য ধাপে যাওয়ার পথে খেলাটা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে ইউনাইটেডের সাফল্যের অনেকটাই।
বিপরীতে গার্দিওলা হয়তো চেষ্টা করবেন ডি ব্রুইনেকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে এবং গুন্দোয়ানকে নিচে নামিয়ে মাঝমাঠে জায়গা বের করতে। এই কাজটি করতে পারলে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে পারবে তারা। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো ভুল করা যাবে না। সিটিকে মনে রাখতে হবে, এই ইউনাইটেড আগেরবার তারা যে দলটির বিপক্ষে খেলেছে, তাদের চেয়ে ভিন্ন। ভুল করলেই পড়তে হতে পারে মহাবিপদে।