বিয়েলসার মাস্টারক্লাসে যেভাবে অচল স্কালোনির জাদু
‘আমি চাই না শিরোপা জেতার জন্য লোকে আমাকে স্মরণ করুক’—২০০৪ সালে কথাটা বলেছিলেন মার্সেলো বিয়েলসা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সফলতা ছাড়া সচরাচর কেউ কাউকে মনে রাখে না। যদিও দু–একজন ব্যতিক্রম থেকেই যান। বিয়েলসা নিশ্চয় জানতেন তিনি তেমনই ব্যতিক্রমী একজন, যাঁকে মনে রাখার জন্য ট্রফির দরকার নেই। ক্যারিয়ারে বড় কোনো শিরোপা ছাড়াই তিনি পেয়েছেন ‘কোচদের কোচ’ হওয়ার স্বীকৃতি। সবাই ভালোবেসে তাঁকে ডাকে ‘এল লোকো’ বা পাগল।
ডাগআউটে, ড্রেসিংরুমে তিনি যা করেন, তা পাগলামিই বটে। তিনি যে আকাশ–কুসুম স্বপ্ন দেখেন, তা–ও তো পাগলামিই। অবশ্য দিন শেষে পাগলামিগুলোই আনন্দময় করে তোলে মুহূর্তগুলোকে। শিরোপা না জিতেও বছরের পর বছর পাগলামিতে ভরপুর আনন্দ উপহার দিয়েছেন বিয়েলসা। দেখিয়েছেন অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন। বিশ্বকাপ জয়ের পর যে আর্জেন্টিনাকে থামানো মনে হচ্ছিল অসম্ভব, সেই দলটিকেও প্রথম মাটিতে নামালেন বিয়েলসা। মনে করিয়ে দিলেন, আর্জেন্টিনা অপ্রতিরোধ্য বটে কিন্তু অজেয় নয়।
গত নভেম্বরে বিশ্বকাপে সৌদি আরবের কাছে প্রথম হেরে অঘটনের শিকার হয়েছিল আর্জেন্টিনা। এরপর টানা ১৪ ম্যাচ আর্জেন্টিনার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি কোনো দল। হার বা ড্র দূরে থাক বিশ্বকাপের পর উরুগুয়ে ম্যাচের আগপর্যন্ত খেলা ৮ ম্যাচের কোনো গোলই হজম করেনি লিওনেল মেসির দল। এমন পরাশক্তির সামনে উরুগুয়ের জয়ের যেটুকু সম্ভাবনা দেখা হচ্ছিল, তা মূলত এই পাগলা লোকটার কারণে। তিনি এমন কিছু করে বসতে পারেন, যা বাকিরা কল্পনাও করতে পারেন না। অবশ্য এই আর্জেন্টিনা দলের অনেকটাই তাঁর জানা। ১৯৯৮–২০০৪ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন বিয়েলসা। তাঁর অধীনে খেলেছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লিওনেল স্কালোনিও।
বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর উরুগুয়ের কোচের পদ থেকে ডিয়েগো আলোনসো সরে দাঁড়ালে বিয়েলসার দিকে হাত বাড়ায় দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। শুরুতে অবশ্য বিয়েলসা আগ্রহী ছিলেন না।
মূলত উরুগুয়ের খেলা দেখে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে ওঠায় দায়িত্ব না নেওয়ার কথা বলেন বিয়েলসা। পরে অবশ্য নিজের বিরক্তিটা দূর করার দায়িত্বটা নিজেই নিয়ে নেন বর্ষীয়ান এই কোচ। আর এখন সেই উরুগুয়ে পরপর দুই ম্যাচে হারাল লাতিন আমেরিকার দুই পরাশক্তি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে। শুধু ফুটবলের দর্শনগত জায়গা থেকেই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও দারুণ রোমাঞ্চ উপহার দিচ্ছেন বিয়েলসা।
সর্বশেষ আজ আর্জেন্টিনার বিপক্ষে উরুগুয়ের জয় ২–০ গোলে। এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনিকে যেন একটি ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাসও দিয়ে দিলেন বিয়েলসা। যদিও ম্যাচ শেষে ট্যাকটিসের জাদুতে ম্যাচ জেতার কথা অস্বীকার করেছেন বিয়েলসা। তিনি বলেছেন, ‘এটা এমন ম্যাচ নয়, যাকে ট্যাকটিক্যাল বিষয়–আশয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা দারুণভাবে রক্ষণ সামলেছি। বল উদ্ধার করার পর আমরা দারুণ কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি করেছি এবং গোল করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছি।’
বিয়েলসা যতই সহজ কথায় বলুন না কেন, ম্যাচটা মোটেই তেমন ছিল না। ট্যাকটিক্যাল দিকগুলোকে বিয়েলসা অস্বীকার করলেও, এই ম্যাচে কৌশলগত পরিবর্তনগুলোই মূলত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। উরুগুয়ে সাধারণত ৪–৩–৩ ফরমেশনে খেলার জন্য পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিয়েলসা দলটিকে খেলিয়েছেন ৪–২–৩–১ ফরমেশনে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও এই ফরমেশনে দলকে খেলানো শুরু করেন বিয়েলসা। এমনকি ওয়ার্মআপের সময়ও দুই কোচের ভাবনার পার্থক্য ছিল স্পষ্ট।
আর্জেন্টিনা যেখানে ২০ মিনিট গা গরম করে সময় কাটিয়েছে, সেখানে উরুগুয়েনরা ওয়ার্মআপে সময় ব্যয় করে ১১ মিনিট। পাশাপাশি এদিন বুয়েনস এইরেসে খেলা হওয়ার পরও উরুগুয়ের সমর্থনও একেবারে কম ছিল না। এটিও মূলত বিয়েলসার জন্য। স্টেডিয়ামে বিয়েলসার নাম ঘোষণার পর দর্শকদের হর্ষধ্বনিও ছিল চোখে পড়ার মতোই।
মাঠের খেলাতেও দুই দল আদর্শগত জায়গা থেকে নিঁখুত ফুটবল খেলার চেষ্টা করেছে। তবে বিয়েলসার উরুগুয়ের সামনে স্কালোনির আর্জেন্টিনা ছিল ম্লান। হ্যাঁ, উরুগুয়েনরা কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে বটে, যা নিয়ে ম্যাচ শেষে মেসি নিজের অসন্তুষ্টির কথাও জানান। কিন্তু তা কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়নি, আবার কখনো মনে হয়েছে এটা তাদের কৌশলেরই অংশ ছিল!
তবে বিয়েলসা এদিন কৌশলগত মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন মূলত রক্ষণে। তিনি জানতেন মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার বিধ্বংসী আক্রমণভাগে রুখতে হলে অসাধারণ কিছুই করে দেখাতে হবে তাঁর ডিফেন্ডারদের। তাই রক্ষণে জোর দিয়ে তিনি প্রতি–আক্রমণের পথ বের করার কৌশল এঁটে দলকে মাঠে নামান। পাশাপাশি প্রতি–আক্রমণে যাওয়ার সময় গতি, পাসিং এবং জায়গা বের করে নেওয়ার মতো ব্যাপারগুলো ছিল দারুণ। এদিন উরুগুয়ের ফুলব্যাকরাও দারুণ কার্যকর। যা ম্যাচকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
তবে বিয়েলসা তাঁর মাস্টারক্লাসের চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখিয়েছেন মেসিকে আটকানোতে। এই ম্যাচে আর্জেন্টাইন মহাতারকাকে নিশ্বাস নেওয়ার মতো জায়গাও দেয়নি উরুগুয়ের ডিফেন্ডাররা। এমনকি ব্যক্তিগত দ্বৈরথগুলোতেও মেসি বোতলবন্দী করে রাখতে পেরেছিল তারা। আর মেসি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় আর্জেন্টিনার প্লে–মেকিং দুর্বলতাও সামনে চলে আসে। ফলে হুলিয়ান আলভারেজ এবং লাওতারো মার্তিনেজরাও খুব একটা বলের কাছাকাছি যেতে পারেননি। ম্যাচে নিজেদের ছায়া হয়ে থাকা এ দুজনই নিয়েছেন মাত্র একটি করে শট।
এমন কিছু ঘটার আশঙ্কা অবশ্য ম্যাচের আগে থেকেই মেসির মনে ছিল। ম্যাচ শেষে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক বলেছেন, ‘আমরা জানতাম ম্যাচটা খুব কঠিন হতে যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে শারীরিকভাবে আগ্রাসী এবং গতিময় ফুটবলই প্রত্যাশা করেছিলাম। আমরা হেরেছি, কারণা আমরা মোটেই স্বস্তিতে ছিলাম না।’ অবশ্য স্বস্তিতে ছিলেন না বলার চেয়ে স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া হয়নি বলাটাই মনে হয় যথার্থ। উরুগুয়ের কৌশলই ছিল আঁটসাঁট রক্ষণে মেসিদের জন্য জায়গা যতটা সম্ভব সংকুচিত করে আনা।
ট্যাকটিক্যালি বিয়েলসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ওয়ান–অন–ওয়ান খেলানো। মাঠে প্রায় প্রতিটি পজিশনে এই কৌশলটি প্রয়োগ করেছেন বিয়েলসা।
প্রতিপক্ষের চেয়ে চেয়ে একটু জোরে দৌড়ানো এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে আক্রমণে যেতে দেখা গেছে ম্যাক্সিমিলিয়ানো আরাউহো–দারউইন নুনিয়েজদের। রক্ষণ দুয়ার বন্ধ করার সঙ্গে মিডফিল্ডেও প্রতিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে তারা। নিকোলাস দে লা ক্রুজকে বিয়েলসা লাগিয়ে রেখেছিলেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে। আর এনজো ফার্নান্দেজকে দেখে রেখেছেন ফেদে ভালভের্দে।
লেফট ব্যাক ম্যাথিয়াস ভিনা ছিলেন রদ্রিগো দি পলের সঙ্গে। আর শুরু থেকে মিডফিল্ডার উগার্থে চেষ্টা করেছে লাইন ভেঙে দিয়ে সামনের দিকে বল জোগান দেওয়ার। ডিফেন্ডারদের মধ্যে সেবাস্তিয়ান কাকেরেস ও অলিভিয়েরা ছিলেন মেসি ও আলভারেজের সঙ্গে। এমনকি ম্যাচ চলাকালেও ফরমেশন বদলে দেওয়ার কাজ করেছেন বিয়েলসা। দ্বিতীয়ার্ধে আরাউহোর বদলে রদ্রিগো বেতঙ্কাকুরকে মাঠে নামিয়ে বিয়েলসা গঠন করেন ৪–১–৪–১ ফরমেশন। যা ম্যাচের শেষ ভাগে গিয়ে দারুণভাবে কাজে লেগেছে।
তবে মাঠে যখন তাঁর দল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে স্মরণীয় জয়ের চিত্রনাট্যের বাস্তবায়ন করছিল, তখন ডাগআউটে স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন বিয়েলসা। আর ম্যাচ শেষে এগিয়ে গিয়ে করমর্দন করেন স্কালোনি এবং বাকি কোচিং স্টাফদের সঙ্গে। একটু পর যথারীতি ভাবলেসহীনভাবেই তিনি চলে যান টানেল ধরে। তাঁর অভিব্যক্তি দেখে মনেই হচ্ছিল না একটু আগে তিনি ইতিহাসের সেরা একটি দলের জয়রথ থামিয়ে দিয়েছেন।
বিয়েলসার জন্য এসব অবশ্য একেবারেই বিস্ময়কর কিছু নয়। আর তিনি জানেন তাঁর দল কী করছে। মূলত গত মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দলটিকে ধীরে খোলস থেকে বের করে আনেন বিয়েলসা। তাঁর আদর্শ ও কৌশল বুঝে নিতেও অবশ্য খুব বেশি দেরি করেননি উরুগুয়েনরা। ফলে যে দলটি কদিন আগেও মাঠে ভুগছিল, তারা এখন নান্দনিক ফুটবল খেলতে শুরু করেছে। যদিও এটা কেবলই শুরু। এখন ঝলমলে সূর্যদোয়ের পর রঙিন একটি দিনের অপেক্ষা।