'ফুটবলাররা তো কাঁদে না'

>
ম্যাচ শেষে এ এখন নিয়মিত দৃশ্য: ফাইল ছবি
ম্যাচ শেষে এ এখন নিয়মিত দৃশ্য: ফাইল ছবি

আমাদের প্রাণের খেলা ফুটবল আজ গভীর সংকটে। অন্তত তিন বছরের জন্য নির্বাসনে চলে যেতে হলো বাংলাদেশ জাতীয় দলকে। কেন এই দশা? কোনো আশা কি আছে বাকি? ২০ বছর ধরে একদম কাছ থেকে দেশের ফুটবলকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ আলমের পাঁচ পর্বের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন। আজ ফুটবলারদের দায় নিয়ে প্রথম পর্ব

মোস্তাক কোথায়, মোস্তাক?
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের এক নম্বর গোলরক্ষকের নাম মোস্তাক। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ডাগআউটে বসে তাঁর খোঁজ করছিলেন দলটির কর্মকর্তা সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু। মোহামেডানের কাছে অপ্রত্যাশিত হার একটু আগে চলতি প্রিমিয়ার লিগে প্রথম পরাজয়ের তেতো স্বাদ দিয়েছে চ্যাম্পিয়ন শেখ জামালকে। কর্মকর্তারা ওই হার মানতে পারছিলেন না। বারবার তাই খোঁজা হচ্ছিল দলের প্রধান গোলরক্ষককে।

ফিজিও ছুটে এসে দৃঢ়ভাবে চুন্নুকে বললেন, ‘মোস্তাক তো ফিট, ভাই। আমি ওর কোনো সমস্যা দেখিনি। ও কেন খেলেনি আজ বুঝলাম না।’ শুনে অন্যরা ধরে নিলেন, মোস্তাক চোটের অজুহাতে খেলেননি।

মোস্তাক চোটগ্রস্ত কি না, তিনিই ভালো জানেন। তবে সত্যি সত্যি চোটে পড়লেও যে তাঁকে নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, এর কারণ নামী ফুটবলারদের নানা অজুহাতে মাঠের বাইরে বসে থাকার মানসিকতা। মোস্তাক এখানে প্রতীকী চরিত্রমাত্র। ফুটবলারদের ফাঁকিবাজি মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।

ক্লাবের জার্সিতে এই মানসিকতার অপচ্ছায়া জাতীয় দলকেও গ্রাস করেছে। ভুটানের মতো দলের কাছে ১২তম সাক্ষাতে এসে তাই বাংলাদেশ দল প্রথম হারল! গত ১০ অক্টোবর এশিয়ান কাপের দ্বিতীয় প্লে অফে থিম্পুতে ৩-১ গোলের সেই লজ্জাজনক হার আপাতত আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে বাংলাদেশকে। যার চড়া মূল্য, আগামী তিন বছর ফিফা-এএফসির কোনো ম্যাচ মিলবে না লাল সবুজের। তি-ন বছর!

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সহজ দল ভুটানের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে আমাদের ফুটবল। এর চেয়ে নিচে নামা তো আর সম্ভবই না!

ফুটবলারদের অনেকে ঠিকমতো অনুশীলন করেন না, এটাই তাঁদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ। দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার জাহিদ হোসেন এর বড় উদাহরণ, যাঁর খেলা দেখে কাজী সালাউদ্দিন একসময় বলেছিলেন, ‘ইউরোপে খেলার যোগ্যতা আছে ছেলেটার।’ অথচ সেই জাহিদের বিরুদ্ধে দুই বছর আগে ঠিকমতো অনুশীলন না করার অভিযোগ এনেছিল মোহামেডান। বাফুফের তদন্তে তা প্রমাণিত হয়, ক্লাবের কাছে জাহিদকে চুক্তির অর্ধেক ১৭ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্যও করে ফেডারেশন।

জাতীয় দলে এসে রাতে অন্য হোটেলে গিয়ে মদ্যপানসহ অনৈতিক কাণ্ড করে ধরা পড়েছেন জাহিদ। খোদ অধিনায়ক মামুনুল ইসলামের বিরুদ্ধে মদ্যপানসহ শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে তদন্ত কমিটি। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তবে এটা সত্য, ফুটবলাররা নানা বদ অভ্যাসে আসক্ত, অন্তত ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে যেগুলো একবারেই মানান সই নয়। তাঁদের দেখে পথ হারিয়েছেন আজকের নবীন ফুটবলারদের বেশির ভাগই।

পাঁচ গোল খেয়েও এঁরা লজ্জার মাথা খেয়ে ফেসবুকে সেলফি দেন। পাঁচ গোল খাওয়ার শোকে দেশের ফুটবলপ্রেমীরা যখন শোকগ্রস্ত, এর ​ছিঁটেফোঁটাও নেই খোদ ফুটবলারদের অনেকের মধ্যে। এঁদের শৃঙ্খলাভঙ্গ, নিজেকে উজাড় করে না দেওয়ার মানসিকতা, লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করার কোনো গৌরব বোধ না করা...এভাবেই ভাঙতে ভাঙতে জাতীয় দল এখন নিঃস্ব, রিক্ত।

দলে শৃঙ্খলার অভাবের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল সংগঠকদের, কিন্তু তাঁরাও সেভাবে দেখেননি। ফুটবলাররা তাই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন ক্লাবে। ওই মানসিকতা সংক্রমিত হয় জাতীয় দলেও। ফুটবলাররা কী করছেন, বেশির ভাগ ক্লাবেই দেখার কেউ নেই!

অথচ আগের ফুটবলারদের আত্মনিবেদন নিয়ে কত কত গল্প আছে। শেখ আসলাম, কোচের অনুশীলনের বাইরেও একাকী কত যে শুটিং-হেডিং অনুশীলন করতেন! সেই আসলাম হালের ফুটবলারদের অনুশীলন ফাঁকি নিয়ে খুবই ব্যথিত, ‘এই সময়ের ফুটবলাররা জাতিকে হতাশ করছে, যা দুঃখজনক। একজন ফুটবলারের নিবিড় অনুশীলনই তার শক্তি। আজকের ফুটবলারদের অনেকে সেটা ঠিকঠাক করে না।’ তাঁর উপসংহার, ‘এভাবে চললে তো দেশের ফুটবল ডুববেই!’

তবে কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক শুধুই ফুটবলারদের কাঠগড়ায় তুলতে রাজি নন, ‘কর্মকর্তারা সুযোগ দিয়েছেন বলেই খেলোয়াড়েরা সুযোগ নিয়েছে। আগে তো কর্মকর্তাদের ঠিক হতে হবে।’ আরেক কোচ সাইফুল বারী দায়টা দিতে চাইলেই সবাইকেই।

হ্যাঁ, দায় সবারই আছে। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের, তাঁরাই ক্লাব কর্মকর্তা, আবার তাঁরাই ফেডারেশনের হর্তাকর্তা। নিজ দলের খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে তাঁরা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না, স্বজনপ্রীতি করেন। গত সাফ ও বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপে ভরাডুরি পর দেখা গেছে, কোনো কোনো ফুটবলার শৃঙ্খলা ভেঙে বেঁচে গেছেন কর্তাদের শিথিল মানসিকতায়!

ফুটবলারদের বুঝতে হবে তারা প্রতিনিধিত্ব করেন দেশকে। লাল–সবুজ পতাকাকে। ফাইল ছবি
ফুটবলারদের বুঝতে হবে তারা প্রতিনিধিত্ব করেন দেশকে। লাল–সবুজ পতাকাকে। ফাইল ছবি

কর্তাদের প্রশ্রয়ে শীর্ষ ফুটবলারদের একটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বছরে। ক্লাবের কোচ কে হবেন, সেটাও তাঁরা ঠিক করে দেন, ভাবা যায়! পছন্দের কোচ দলে নিয়ে নিজেদের খেলাটা নিশ্চিত করেন ওঁরা। ক্লাবের কিছু কর্মকর্তারা ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলায়, কারণ তাঁরা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কমিশন নেন বলে প্রচার আছে! খেলোয়াড়দের ওই জোট ক্লাবকে এমনও শর্ত দেয়, অমুক অমুক খেলোয়াড় নিতে হবে, নইলে তাঁরা যাবেন না!

এই অপসংস্কৃতির জাঁতাকলে খেলোয়াড়দের ভালো খেলার তৃষ্ণাটাই হারিয়ে গেছে। জাতীয় দলের বিদায়ী কোচ টম সেন্টফিট সরাসরি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এই ফুটবলাররা ওদের মানের তুলনায় বেশি টাকা পাচ্ছে ক্লাব থেকে। ফলে পরিশ্রম বিমুখতা এসে গেছে ওদের মধ্যে।’

খেলোয়াড়েরা ভালো আয় করুন, উন্নত জীবন যাপন করুন, সবাই চায়। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের কাছে সেই মানের পারফরম্যান্সও তো আশা করে। সর্বনাশের বীজটা তাই বড় হয়েছে অলক্ষ্যেই। গত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দলের ফিটনেস নিয়ে সে দেশের মিডিয়ায় হাসাহাসি হয়েছে। বাংলাদেশের এক ফুটবলারের বেঢপ ভুঁড়ি সে দেশের মূল মিডিয়া ও সামাজিকমাধ্যমে বেশ আলোচনা তৈরি করেছিল।

বাংলাদেশের ফুটবলারদের ফিটনেস, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাপন, নিজেকে প্রতিনিয়ত শানিয়ে নেওয়া মানসিকতা; এমনকি তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছুই ঠিক নেই। দায়বদ্ধতা নেই। অল্প কিছু টাকার লোভে খেপ খেলতে যাওয়ার মতো কাজও এঁরা নিয়মিত করেন, কখনো কখনো সেটা জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে চলে গিয়েও!

সবাই মাঠে মেসি-রোনালদোর ৯০ মিনিটের জাদু দেখে। কিন্তু এর পেছনে তাঁদের প্রতিদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে খুব কমজনই। রোনালদো কদিন আগে তাঁর জিমে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘এটাই আমাদের প্রতিদিনের জীবন।’ রোনালদো-মেসির মতো প্রতিভাদেরও নিজেকে প্রতিনিয়ত ঘষামাজা করতে হয়।

সব ফুটবলার হয়তো এমন নন। এক-দুজন ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছেন তাঁরাও। অনেকেই এখন স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন। এই দুঃখের বর্ণনা দিতে দিতে ভুটান ফেরত দলের কোচিং স্টাফের এক সদস্য আপ্লুত হয়ে পড়লেন, ‘জানেন, আমি যখন মাঠে কাঁদছিলাম, দুজন কর্মকর্তা এসে বললেন, আমরা কেঁদে লাভ কী? ফুটবলাররা তো কাঁদছে না।’

হ্যাঁ, বেশির ভাগ ফুটবলার দেশকে ডোবানোর হতাশার পরও কাঁদেন না। তাঁদের সেই অনুভূতিও মরে গেছে। জার্সির বুকে আঁকা লাল-সবুজ পতাকা ভেজে না—না শ্রমের ঘামে, না বেদনার অশ্রুতে। সাফল্য-অশ্রু? সে-ই আশাও কেউ এখন করে না!


আগামীকাল পড়ুন ​এ দেশের ক্লাব ফুটবলের সংস্কৃতি কীভাবে ধ্বংস করছে দেশের ফুটবল