আর একটি মাত্র বল, জেমস অ্যান্ডারসন ঠেকিয়ে দিতে পারলেই ড্র হয়ে যাবে ম্যাচ। ডাগআউটে বসে থাকা বেন স্টোকস টি-শার্ট দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললেন! এমন উত্তেজনাকর মুহূর্তটি হয়তো তিনি দেখতে পারবেন না বলেই মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। একটু পর আবার টি-শার্ট সরিয়ে নিয়ে চেয়ে রইলেন মাঠের দিকে—এমন একটি মুহূর্ত কি না দেখে পারা যায়!
সিডনিতে আজ অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্টে এমন পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকেই, যাকে বলে নখ কামড়ানো উত্তেজনা! ইংল্যান্ডের ইনিংসে ৯১.২ ওভারে জনি বেয়ারস্টো আউট হয়ে ফেরার পর থেকেই এমন পরিস্থিতি। তখনো যে পঞ্চম ও শেষ দিনের খেলা শেষ হতে ১০ ওভার ৪ বল বাকি। ইংল্যান্ডের হাতে ছিল ২ উইকেট। জ্যাক লিচ ও স্টুয়ার্ট ব্রড প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছিলেন ম্যাচ বাঁচানোর জন্য। স্কট বোল্যান্ড, প্যাট কামিন্স ও নাথান লায়নের একেকটি বল যেন ছোবল মারছিল সাপের মতো!
টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে চোখ ফেরানোই কঠিন হয়ে পড়ছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। দেখতে দেখতে আর কোনো উইকেট পড়তে না দিয়ে ম্যাচটি ১০০তম ওভারে নিয়ে যান লিচ ও ব্রড। এর আগেই অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং বন্ধ করতে হয়েছে আলো কম থাকার কারণে। অনেক ভেবে ১০০তম ওভারে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক বল তুলে দেন স্টিভ স্মিথের হাতে। নিজের শেষ ওভারের শেষ বলে তিনি তুলে নেন লিচকে।
ম্যাচ আরও জমে যায়। সবাই তখন এটাই দেখার অপেক্ষায়—ইংল্যান্ডের পেস বোলিং জুটি ব্রড আর জেমস অ্যান্ডারসন দুটি ওভার পার করে দিয়ে হারের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন কি না দলকে। শেষ ওভারের আগের ওভারটিতে বল করেন লায়ন। সে ওভারটা পার করে দেন এর আগে ২৯ বলে ৮ রান করা ব্রড। শঙ্কা জাগে—উইকেটে নতুন আসা অ্যান্ডারসন কি পারবেন স্মিথের পরের ওভারটি ঠেকিয়ে দিতে! অ্যান্ডারসন পেরেছেন, ছয়টি বল সাহসের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ডকে অসাধারণ এক জয় এনে দিয়েছেন তিনি। সিরিজ হার তো আগেই নিশ্চিত হয়েছে। এই ড্রয়ে ইংলিশরা অন্তত এটুকু শান্তি পেল যে ধবলধোলাই আর হতে হচ্ছে না তাদের!
ম্যাচ শেষে মাঠে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জো রুটও এমন কথাই বলেছেন, ‘এটা বলা হয়েছিল যে আমরা কিছুটা হলেও সম্মান ফিরিয়ে আনতে চাই। ইংল্যান্ডে বসে যাঁরা আমাদের সমর্থন করে যাচ্ছেন, তাঁদের অন্তত কিছু দিতে চাই। আমরা অনেক সাহস আর দৃঢ়তা দেখিয়েছি।’
ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করতে চাওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া দল। সেটা আর হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক কামিন্স বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ৪-০ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ক্রিকেটের জন্য খুব ভালো একটি ম্যাচই হয়েছে।’ দিনের শুরুতে অবশ্য কেউ ভাবতে পারেনি সিডনি টেস্টের পঞ্চম ও শেষ দিন শেষ বেলায় এসে এমন রোমাঞ্চ উপহার দেবে। ইংল্যান্ডের লক্ষ্য ছিল ৩৮৮ রান। শেষ দিনে যে এই লক্ষ্যের পেছনে ছুটে জয়ের জন্য খেলবে না তারা, এটা মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছে।
ইংল্যান্ড সেটা করেওনি। আগের দিনের বিনা উইকেটে ৩০ রান নিয়ে খেলতে নেমে দেখেশুনে শুরু করলেও খুব বেশিক্ষণ উইকেট অক্ষত রাখতে পারেনি ইংলিশরা। হাসিব হামিদকে ৪৬ রানে হারায় তারা। ৭৪ রানে ফিরে যান ডেভিড ম্যালান। কিন্তু অন্য প্রান্তে জ্যাক ক্রলি ছিলেন অবিচল। কিন্তু তাঁর মনোযোগ ভাঙে দল ৯৬ রানে পাৌঁছালে। ক্যামেরন গ্রিনের একটি ইয়র্কার খেলতে গিয়ে মিস করেন তিনি। বল লাগে তাঁর বুটের আগায়। আউট হয়ে ফেরেন ক্রলি। ইংলিশদের আশা হয়ে অধিনায়ক রুটের সঙ্গে জুটি বাঁধেন বেন স্টোকস। মধ্যহ্ন বিরতিটা দুজনে মিলে পার করে দেন আর কোনো উইকেট পড়তে না দিয়ে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি রুট।
স্টোকসের সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৬০ রানের জুটি উপহার দিয়ে আউট হয়ে ফেরেন তিনি। ইংল্যান্ড চা–বিরতিতে যায় ৪ উইকেটে ১৭৪ রান নিয়ে। বিরতি থেকে ফিরে ভালোই খেলছিলেন স্টোকস ও বেয়ারস্টো। কিন্তু লায়নের গুড লেংথের একটি বলে ভুল করে বসেন স্টোকস। খেলবেন কি খেলবেন না, মনস্থির করতে পারছিলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত হালকা বাড়ানো ব্যাটে চুমো এঁকে বল চলে যায় স্লিপে দাঁড়ানো স্মিথের বিশ্বস্ত হাতে। ভুলটি করার পরই বুঝতে পারেন স্টোকস। আকাশের দিকে চেয়ে ব্যাটটি পিঠের ওপরে তুলে ধরে আফসোস করেন। কিন্তু যা হওয়ার তো হয়েই গেছে! স্টোকসের এই আউটের পরই রোমাঞ্চের পসরা নিয়ে হাজির হয় সিডনি টেস্ট। এরপর একে একে ফিরে যান জস বাটলার, মার্ক উড ও বেয়ারস্টো। রোমাঞ্চের তরঙ্গও ওঠানামা করতে শুরু করে, যেটা ছিল একদম শেষ বল পর্যন্ত। এমন টেস্ট ম্যাচ শেষ কবে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব!