সাইকেলে চেপে মেয়েরা যাচ্ছে গ্রামের রাস্তা ধরে। কেউ কেউ যাচ্ছে ছাতা মাথায় হেঁটে। সবার পরনে ট্র্যাক-স্যুট, কাঁধে ব্যাগ। গন্তব্য কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, দুটি দলে ভাগ হয়ে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়েছে তারা। এবার পরনে সবুজ ও হলুদ জার্সি। এরা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ দল ও ময়মনসিংহ জেলা মহিলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়। অনুশীলন করাচ্ছেন মফিজ উদ্দিন।
ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর। নানা দিক থেকে পিছিয়ে থাকা এই গ্রামের মেয়েশিশুরা তাক লাগিয়ে দিয়েছে ফুটবল খেলে। দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে প্রিয় লাল-সবুজ পতাকার গৌরব বাড়িয়েছে তারা।
গত বছর এপ্রিলে নেপালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দলে একসঙ্গে খেলার সুযোগ পায় কলসিন্দুরের ১০ কন্যা— মার্জিয়া আক্তার, সানজিদা আক্তার, নাজমা আক্তার, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার, লুপা আক্তার, শামছুন্নাহার, তাসলিমা ও তহুরা আক্তার। এর মধ্যে আটজন খেলেছে একাদশে। গ্রুপ পর্বে তারা ভারতের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র এবং ভুটানকে হারায় ১৬-০ গোলের ব্যবধানে। সেমিফাইনালে ইরানকে ২-০ গোলে হারিয়ে স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে ফাইনাল খেলার সুযোগ হয়। কিন্তু নেপালে কয়েক দফা ভূমিকম্পের জন্য ফাইনাল খেলা স্থগিত হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় তাদের।
কলসিন্দুরের মেয়েদের আরও একটি বড় সাফল্য ২০১৪ সালে জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। কলসিন্দুরের মেয়েদের নিয়ে গড়া ময়মনসিংহ জেলা দল ফাইনালে বাংলাদেশ আনসার দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে তারা হারায় বিজেএমসি দলকে।
মাত্র পাঁচ বছর আগে ফুটবল খেলা শুরু করেছিল এই শিশুরা। বঙ্গমাতা স্কুল টুর্নামেন্ট দিয়ে এদের শুরু। তারপর গত চার বছরে শুধুই সাফল্যে ভেসেছে কলসিন্দুরের মেয়েরা। এর মধ্যে বঙ্গমাতা স্কুল টুর্নামেন্টে হয়েছে দুবার চ্যাম্পিয়ন। একবার জাতীয় মেয়েদের ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন, প্ল্যান বাংলাদেশ মেয়েদের টুর্নামেন্টে হয়েছে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন। আন্তস্কুল গ্রীষ্মকালীন প্রতিযোগিতায়ও সেরা। সর্বশেষ ২ আগস্ট জেএফএ অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলের প্রথম আসরে বাংলাদেশ আনসারকে হারিয়ে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।
এই মেয়েদের অনুপ্রেরণা কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ওরা ভর্তি হয়েছে কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ে।
শিক্ষক মফিজ উদ্দিন শৈশবে অল্পস্বল্প ফুটবল খেলেছেন। কিন্তু খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। নিজের স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয়ের ছেলেদের দিয়ে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রাথমিক স্কুলভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য ছেলেদের দল তৈরি করেন। কিন্তু খেলায় অংশ নিয়ে ছেলেরা ভালো করতে পারেনি। কারণ, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের দলে প্রতারণা করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করা ছেলেদেরও নেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু মফিজ উদ্দিন বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করেননি।
মফিজ উদ্দিন চিন্তা করলেন, ছেলেরা অনেকেই ফুটবল খেলে। কিন্তু দেশে মেয়েরা এখনো ফুটবল খেলায় সেভাবে আসেনি। মেয়েদের দলে ওই ধরনের প্রতারণা করে খেলোয়াড় পাওয়া সহজ হবে না। সেই চিন্তা থেকে ২০১১ সালে নতুন করে কাজ শুরু করলেন। প্রাথমিক স্কুলের মেয়েশিশুদের জন্য বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দল গঠন করলেন তিনি। কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। ‘মেয়েরা প্রথমে মাঠে নামতে চায়নি। অনেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে মাঠে অনুশীলন করাতে হয়েছে। শুরুতে ফুটবল নিয়ে হাতেহাতে খেলত ওরা। ওদের বোঝাতে হয়েছে—এটা পা দিয়ে খেলতে হয়’, বলেন মফিজ উদ্দিন।
২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ ফুটবলের ইউনিয়ন পর্বের খেলায় নিজেদের স্কুল মাঠে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ম্যাচ। মাঠের চারদিকে দর্শক। ম্যাচ শুরুর আগে মেয়েরা বেঁকে বসে। ভয়-সংকোচে মাঠে নামতেই চাচ্ছিল না তারা! তবে এই মেয়েরা তাদের প্রিয় শিক্ষক মফিজ উদ্দিনকে অনেক শ্রদ্ধা করে। শেষ পর্যন্ত মাঠে নামে তারা। জয় আসে প্রথম খেলাতেই। কেটে যায় তাদের ভয়-সংকোচ। চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়ে একের পর এক জয় পেতে থাকে তারা। ওই টুর্নামেন্টে তারা ময়মনসিংহ জেলার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরের রাউন্ডে আঞ্চলিক পর্বে হেরে যায় রংপুরের কাছে।
পরের বছর ২০১২ সালে একই টুর্নামেন্টে আবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলটি। সেবারও আঞ্চলিক পর্বে আটকে যায়। হেরে যায় রাজশাহীর কাছে।
দুবার আঞ্চলিক পর্বে হেরেও দমে যায়নি কলসিন্দুরের কন্যারা, দমেননি তাদের অনুপ্রেরণা মফিজ উদ্দিনও। ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে নতুন উদ্যমে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছিল আগের দুই বছর জেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুপ্রেরণা। এবার ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্বের বাধা পেরিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে পৌঁছায় তারা। ফাইনালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাঙামাটি। রাঙামাটিকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে বাজিমাত করে কলসিন্দুরের দলটি। প্রথমবারের মতো দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে তারা।
পরের বছর ২০১৪ সালেও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ড কাপ কাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় এই কলসিন্দুর। সেবার ফাইনালে তারা হারিয়ে দেয় রংপুরকে। এই টুর্নামেন্টের ২০১৫ সালের খেলা এখনো চলছে। কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এখন জেলা পর্যায়ে খেলার অপেক্ষায়।
তত দিনে ফুটবল অঙ্গনের মানুষেরা জেনে গেছেন কলসিন্দুরের কথা। বয়সভিত্তিক বাংলাদেশ ফুটবল দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পড়তে শুরু করে কলসিন্দুরের ফুটবল কন্যাদের। সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা ও মার্জিয়া আক্তারেরা তত দিনে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একই ক্যাম্পাসের কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ (সেন্ট্রাল অ্যান্ড সাউথে) বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য ডাক পায় মার্জিয়া আর তাসলিমা। টুর্নামেন্টে ভারত, ইরান, তাজিকিস্তান, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলে তৃতীয় হয় বাংলাদেশ। এর ধারাবাহিতায় ২০১৪ সালে ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের বাংলাদেশ দলে জায়গা পায় কলসিন্দুরের সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম ও কল্পনা আক্তার।
সর্বশেষ মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়শিপের দলেও ডাক পেয়েছিল কলসিন্দুর স্কুলের পাঁচজন।
শিক্ষক ও কোচ মফিজ উদ্দিন জানালেন, কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের অন্তত ৬০ জন মেয়ে এখন নিয়মিত ফুটবল খেলে। এরাই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬, ময়মনসিংহ জেলা ও বয়সভিত্তিক দলে খেলছে। কলসিন্দুর গ্রাম ছাড়াও পাশের গামারিতলা ও দক্ষিণ রানীপুর গ্রামের মেয়েরাও ফুটবল খেলছে। কিন্তু কলসিন্দুর মাঠে নিয়ম করে অনুশীলন করে বলে সবাই তাদের কলসিন্দুরের মেয়ে বলেই চেনে।
অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় অনেকের সঙ্গেই। ‘আমাদের স্কুলকে এখন সবাই ফুটবলের জন্যই চেনে। বড় হয়ে আমরাও বড় ফুটবলার হতে চাই’, দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে কথাগুলো বলে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় দলের ২০১৫ সালের বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের অধিনায়ক তানিয়া।
একই ধরনের প্রত্যয় ময়মনসিংহ জেলা অনূর্ধ্ব-১৪ ও অনূর্ধ্ব-১৬ দলের অধিনায়ক মার্জিয়ার কণ্ঠেও, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল নিয়েই আমাদের স্বপ্ন। আমরা বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল দলকে বিশ্বে শক্তিশালী দল হিসেবে তুলে ধরতে চাই।’
কথা হলো অনুশীলনে আসা রোজিনা আক্তার, ময়না মানকিন, হালিমা আক্তার, কল্পনা আক্তারসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের সবার চোখে আগামীর স্বপ্ন। ফুটবল ও তাদের স্বপ্ন নিয়ে জানতে চাইলে সবার যেন একটাই উত্তর, ‘আমরা হেরে যেতে শিখিনি।’
‘প্রতিবছর আমাদের বিদ্যালয়ে ফুটবল অনুশীলনে মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে’, বললেন মফিজ উদ্দিন। জানালেন নিজের স্বপ্নের কথাও, ‘কলসিন্দুরের মেয়েরা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের হয়ে যেদিন ন্যূনতম এশিয়ার ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে, সেদিন নিজেকে কিছুটা সফল মনে করব।’ এ পর্যন্ত পাওয়া সাফল্যগুলোর জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতী রানী শীল, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ও কোচদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুললেন না তিনি।
কলসিন্দুরের এই ফুটবলারদের সাফল্যে উদ্বেলিত স্থানীয় লোকজন। অনেকে স্বীকার করলেন, শুরুতে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে ভালো চোখে দেখেনি অনেকে। কিন্তু এখন আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ এই মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসেন। ভালোবাসার একটি উদাহরণ তুলে ধরলেন কলসিন্দুর বাজারের প্রবীণ ব্যক্তি আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, এই মেয়েরা রাস্তায় বের হয়ে টেম্পো বা ইজিবাইকে চড়ে কোথাও গেলে চালকেরা ভাড়া নিতে চায় না। এলাকার সবাই তাদের নিয়ে গর্ববোধ করে। আশপাশে কোথাও মেয়েদের খেলা থাকলে, গ্রামের মানুষ দল বেঁধে দেখতে যায়।
ময়মনসিংহ জেলা মহিলা ফুটবল দলের বর্তমানের সব সদস্যই এখন কলসিন্দুর গ্রামের। অনুশীলনের জন্য জেলা মহিলা দলের কোচ মকবুল হোসেন ও বোরহান উদ্দিন নিজেরাই চলে যান কলসিন্দুর। স্কুলের একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয় কোচদের জন্য। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওমর হায়াৎ খান বলেন, নানা বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলা এই মেয়েরাই একদিন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।