ফুটবলের ওয়াসিম যখন এফডিসিতে
প্রশ্নটা শুনেই যেন একটু লজ্জাই পেলেন ওয়াসিম ইকবাল— 'ওটা তো অনেক বছর আগের কথা! আমি “জনি ওস্তাদ” নামে একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম। তখন সময়টা অন্যরকম ছিল। মনটাও ছিল অন্যরকম। বয়স ছিল কম। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহিরুল হকের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তবে আমাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে জহিরুল হক সাহেবের কোনো লাভ হয়নি। ছবিটা বেশি চলেনি।'
ঢাকাই চলচ্চিত্রে দেশের এক ফুটবলারের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করার এই গল্প এই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের খুব বেশি সংখ্যক জানেন—এটা বলা যাবে না। তবে আশির দশকে বাংলাদেশের ফুটবলারদের জনপ্রিয়তা, তারকাখ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে নিখাদ ব্যবসায়ী সিনেমার প্রযোজক, পরিচালকেরাও মনে করতেন তাঁদের দিয়ে অভিনয় করালে ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম)খেলা দেখতে আসা দর্শকদের যদি সিনেমা হলেও ঢোকানো যায়!
আশির দশকে ওয়াসিম কত বড়, কত জনপ্রিয় তারকা ফুটবলার ছিলেন, এটা ওই সময়ের ফুটবলের খোঁজখবর রাখাদের অজানা নয়। ব্রাদার্স ইউনিয়নের ঘরের ছেলে, জাতীয় দলকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। খেলেছেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আকাশি–নীল জার্সিতেও। তবু গোপীবাগের ছেলে ওয়াসিম ব্রাদার্সের কমলা জার্সিকে দূরে ঠেলে রাখতে পারেননি। দুই মৌসুম পরই ফিরে আসেন প্রিয় ক্লাবে। মোহামেডানের সমর্থকেরা তো এখনো আক্ষেপে পোড়েন— ওয়াসিম যে কখনোই মোহামেডানের সাদা–কালো জার্সিতে নিয়মিত ফুটবলার হিসেবে খেলেননি!
ফুটবলের সেই দিন আর নেই। সে জায়গাটা এখন মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমদের দখলে। তবে খেলার মাঠের একজন হয়ে এফডিসির ফ্লোরে অভিনয় করছেন, তাঁর নামে চলচ্চিত্র প্রযোজকেরা অর্থ লগ্নি করছেন—এমন ঘটনা বাংলাদেশের দ্বিতীয়টি ঘটেনি।
জহিরুল হক ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও ডাকসাইটে অভিনেতা। শুভ্র–সাদা চুলের সেই মানুষটির কথা এ দেশের সিনেমা–নাটক–পাগল মানুষের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওয়াসিম তাঁর নির্মিত 'জনি ওস্তাদ' ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাকের ছোট ছেলের ভূমিকায়। চরিত্রটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের। সুদর্শন, ক্লাসের সেরা ছাত্র। দারুণ রোমান্টিক। ঢাকাই ছবির ফর্মূলা অনুযায়ী মারামারিতেও ওস্তাদ। ছবিটি ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন ওয়াসিমের বড় ভাই। অঞ্জু ঘোষ ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়িকা, ওয়াসিমের প্রেমিকা হিসেবে অভিনয় করেন নুসরাত জাহান নামে তখনকার উঠতি এক অভিনেত্রী।
ওয়াসিম প্রথম আলোকে সে স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে নিজেই হয়ে পড়েন স্মৃতি কাতর, 'তখন তো ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। সারা বছর লিগের খেলা থাকে। জাতীয় দলের জার্সিতে খেলি দেশে বিদেশে। কখনো ছবিতে অভিনয় করব ভাবিনি। ব্রাদার্স ক্লাবের কর্মকর্তা আজহারুল ইসলামই জহিরুল হকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।'
ফুটবলের ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত শুটিং করতে পারতেন না ওয়াসিম। 'জনি ওস্তাদ' এর শুটিং চলেছিল ৬/৭ বছর ধরে। যে সময় মুক্তি পায়, তখন দেশে রঙিন ছবির যুগ শুরু হয়ে গেছে। 'জনি ওস্তাদ' ছিল সাদাকালো। সিনেমাটি তাই ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। ওয়াসিম তবু বলেন, 'সেটি আমার জীবনের দুর্দান্ত এক স্মৃতি। ফুটবলার হিসেবে যে কত সম্মান পেতাম তখন, এফডিসিতে গিয়েই বুঝতে পারতাম।'
অভিনয়টা একেবারেই জানতেন না। কিন্তু প্রয়াত জহিরুল হক এতই অভিজ্ঞ পরিচালক ছিলেন, যে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো অভিনয় বের করে নিতেন, 'আমি সত্তর দশকের শেষ দিকে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাই। খেলোয়াড় হিসেবে খুব দ্রুত পরিচিতি পেয়ে যাই। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেলিং করার প্রস্তাব আসত। সে সময় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন 'বিচিত্রা'র ঈদ সংখ্যায় মডেল হিসেবে কাজ করেছি অনেকবার—ওই পাঞ্জাবি–টাঞ্জাবি পরে। ছবির প্রস্তাবটা আসে সে সূত্রেই। ফুটবলার জীবনে ওটা আমার একটা মস্ত বড় অ্যাডভেঞ্চারই বলতে পারেন।'
এফডিসিতে শুটিংয়ের সময় এক কাণ্ড হয়েছিল। ওয়াসিম সেটি মনে করে এখনও বেশ বিব্রত হন, 'আমি মোটরবাইক খুব ভালো চালাতে পারতাম না। অথচ, ছবির চরিত্রটা এমন ছিল, আমাকে অনেকবারই আমার প্রেমিকাকে নিয়ে বাইক চালাতে হবে। একদিন শুটিংয়ে ক্যামেরা রোল করা শুরু করেছে। নুসরাত জাহানকে নিয়ে আমি মোটরবাইক চালিয়ে বেরিয়ে যাব, এমন একটা দৃশ্য। অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট দিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আবিষ্কার করলাম আমার সহ অভিনেত্রী বাইক থেকে পড়ে গেছেন। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। নূসরাত তো রেগেই টং। আমাকে বললেন, “ওয়াসিম ভাই বাইকটা একটু ভালোভাবে চালাতে শিখলেন না!” নূসরাত সেদিন খুব ব্যথা পেয়েছিলেন।'
ছবির স্মৃতি আনন্দময়, তবে ওয়াসিমের জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন, 'সবার দোয়ায় সাফল্যের সঙ্গে খেলেছি। এটাই পরম তৃপ্তি। ছবিতে অভিনয়টা ফুটবলার জীবনের কারণেই। নয়তো, আমি কে যে আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হবে! দেশের জার্সিতে খেলেছি, সবার ভালোবাসা নিয়ে। এত বছর পর এখনো মানুষ আমাকে মনে রেখেছে, এরচেয়ে আনন্দ আর তৃপ্তির বিষয় কী হতে পারে!'
তবু সবুজ মাঠ থেকে ওয়াসিমের সেলুলয়েডের ফিতায় ঢুকে পড়াটা এ দেশের ফুটবলে আজও রোমাঞ্চকর এক গল্প হয়েই আছে।