ক্যাসিনো-কাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এই সময়ে কেমন কাটল ক্লাবগুলোর? উত্তর খোঁজা হয়েছে নতুন এই ধারাবাহিকে। আজ চতুর্থ দিনে পড়ুন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের বর্তমান অবস্থার কথা।
ঢাকার ফুটবলে বড় এক আক্ষেপের নাম ওয়ান্ডারার্স। এই ক্লাবে খেলেছেন অনেক নামীদামি ফুটবলার। নবী চৌধুরী, আমির জং গজনবী, ফজলুর রহমান আরজু, কবির আহমদ, আশরাফ চৌধুরী, চিহ্লা মং চৌধুরী মারী, মনজুর হাসান মিন্টু, জাকারিয়া পিন্টু, মেজর হাফিজ, ওয়াজেদ গাজী, সুলতান আহমেদ-এমন কত চেনামুখ! ১৯৫০-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার ঢাকার ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। ১৯৫৫ সালের পরিত্যক্ত লিগ শেষে ১৯৫৬ সালে আবারও চ্যাম্পিয়ন। ঢাকার ফুটবলে টানা ৬টি লিগ জেতার রেকর্ডের মালিক একমাত্র আজকের পতিত ওয়ান্ডারার্সই।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আবাহনী-মোহামেডান লড়াই ছিল না। তখন ফুটবল মাঠে শত্রুতা মানে ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান। ১৯৬০ সালে সর্বশেষ ঢাকা লিগ ঘরে তোলে ওয়ান্ডারার্স। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামতে থাকে দলটি। নব্বই দশকে চলে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। সেই ওয়ান্ডারার্সকে ঢাকার ফুটবলে খুঁজে পেতে আজ অনেকেরই গলদঘর্ম অবস্থা হয়। অনেকে জানেনও না ক্লাবটি কোন স্তরে আছে। অথচ জুয়া-ক্যাসিনোর আগ্রাসনে পথহারা ক্লাবগুলোর সারিতে ওয়ান্ডারার্সকে খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই।
১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ান্ডারার্সের অতীত বেশ সমৃদ্ধ হলেও বর্তমান ধূসর আর লজ্জার। নব্বই দশক থেকে দখল এবং নানা ধরনের বাণিজ্য শুরু হয় ওয়ান্ডারার্সে। ১১ বছর আগে একটি পক্ষ ক্লাব অডিটোরিয়াম ভাড়া নেয়। জুয়া বাবদ প্রতিদিন তারা ক্লাবকে ৩০ হাজার টাকা করে দিত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেই ভাড়া ২ বছরের মধ্যেই দৈনিক ৫০ হাজারে ওঠে। যথাযথ অনুমতি নিয়েই নাকি ক্লাবে এই ‘ইনডোর খেলা’ চলত বলে জানান এক কর্মকর্তা।
ক্যাসিনোর থাবায় ওয়ান্ডারার্সের সব অর্জন ধুলোয় মিশে গেছে। বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও মমিনুল হক সাঈদরা এলাকায় ক্যাসিনো সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। অভিযোগ আছে, আরামবাগ-দিলকুশার মতো ওয়ান্ডারার্সের ক্যাসিনোও মমিনুলই দেখতেন। তবে প্রথম আলোর কাছে মমিনুলের দাবি, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব পরিচালনা করেন ক্লাবটির সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার। এই ক্লাবের সঙ্গে তাঁর (মমিনুলের) কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আরামবাগে ইয়ংমেনস ফকিরেরপুল ক্লাবের নিশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে চলে। র্যাব তালা লাগিয়ে দেয় মতিঝিল থানার পাশে অবস্থিত ওয়ান্ডারার্সের ফটকে। পুলিশের এই তালা ব্যথিত করেছে পুরোনো তারকাদের।
সাধারণ সম্পাদক জেলে ওয়ান্ডারার্সের সাধারণ সম্পাদক তাঁতীবাজারের বাসিন্দা জয় গোপাল ক্লাবটির সাবেক ফুটবলার ছিলেন। ক্যাসিনোসংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস ধরে কেরানীগঞ্জ জেলে আছেন তিনি। মাসখানেক আগে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়া যুগ্ম সম্পাদক এবাদুল ইসলাম বলেন, মামলার চার্জশিট হওয়ার কয়েক দিন আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্লাবে ওয়ানটেন খেলা থেকে একটা টাকা আসত। টাকাটা তাঁর কাছেই দিত ভাড়াটেরা। ওয়ানটেন চলানোর আইনগত অনুমতি ছিল। তারপর যোগ করেন, ‘ঘটনায় কী হইল না হইল জানলাম না ভাই। জয় গোপালকে অ্যারেস্ট করল। ওকে খালি খালি ফাঁসাইয়া দিল। ওর মতো ভদ্র ছেলে আরও দুই-একজন আছে কি না, সন্দেহ।’ জয় গোপাল অন্যায়ভাবে কারও কাছ থেকে ৫০০ টাকাও নেননি বলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দাবি। তাঁকে কে ফাঁসাল? জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের কথা, ‘কে ফাঁসাইল আপনিই হিসাবনিকাশ করে দেখেন। আসলে ও এই ধরনের ছেলে না। অন্যায়ভাবে ফাঁসাইছে তারে।’
সাবেক ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘ওয়ান্ডারার্স পতনের দিকে গেল ভালো খেলোয়াড়েরা দল ছাড়তে থাকায়। সমর্থকেরা যখন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্লাবের ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করল, তখন থেকেই এর পতন শুরু।’ তাঁর চাওয়া ক্লাবে যোগ্য নেতৃত্ব। গত এপ্রিলে ক্লাবটির দুই বছর মেয়াদি নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। করোনা, ক্লাব বন্ধ থাকা প্রভৃতি কারণে নতুন কমিটি হয়নি। সামনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাধারণ সভা ডেকে ক্লাবের নতুন কমিটি করা হবে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা।
সেটি না হওয়া পর্যন্ত নতুন কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিতে চান ক্লাবটির সভাপতি। প্রায় দুই মাস আগে ক্লাবের একজন সহসভাপতিকে চিঠি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নিতে বলেন সভাপতি মোল্লা কাউছার। কেন তিনি দায়িত্ব ছাড়ছেন, তা জানতে যোগাযোগ করলে মোল্লা কাউছারের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু ওয়ান্ডারার্সের এই দুর্নামের মধ্যে ক্লাবটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হতেও রাজি নন ওই কর্মকর্তা। সেই সহসভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঠিক নিয়মকানুন মেনে বিধিসম্মতভাবে দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপার আছে। বললেই সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া যায় না।’
তবে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব নিলে ক্লাবটির ঐতিহ্য ফেরাতে চেষ্টা করবেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সহসভাপতি। ক্লাবটির একটি ভালো দিক, ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে তারাই সর্বোচ্চ ৭-৮টি খেলা খেলে। যদিও আড়াই বছর আগে সর্বশেষ প্রিমিয়ার হকি লিগে মাত্র ১ পয়েন্ট পেয়ে ওয়ান্ডারার্স নেমে গেছে প্রথম বিভাগে। কিন্তু এখনো ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, কাবাডি, সাঁতার, বক্সিং, ব্যাডমিন্টনে অংশগ্রহণ ধরে রেখেছে ওয়ান্ডারার্স। সম্প্রতি রাগবিও যোগ হয়েছে।
ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর এই এক বছরে ফুটবল, ক্রিকেট ও কাবাডি খেলেছে ক্লাবটি। উঠেছে কাবাডি প্রিমিয়ারের সুপার লিগে। গত নভেম্বরে প্রথম বিভাগ ফুটবলে রানার্সআপ হয়ে দলটি প্রথমবারের মতো পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে পা রেখেছে। যদিও গত মে মাসে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ হয়নি করোনার কারণে। ক্রিকেটে ক্লাবটির অবস্থান দ্বিতীয় বিভাগে। প্রায় তিন বছর আগে আন্তক্লাব সাঁতারে চট্টগ্রামে ১৮টি সোনা জিতে ওয়ান্ডারার্স চ্যাম্পিয়ন হয়।
ক্যাসিনোর ঘটনায় ক্লাব বন্ধ থাকায় ফুটবলারদের রাখা হয় কমলাপুর স্টেডিয়ামে। ক্রিকেট দল খেলাঘর ক্লাবে ও কাবাডি খেলোয়াড়দের বক্সিং স্টেডিয়ামে। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের দোতলায় খেলোয়াড়দের থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে শিগগির ক্লাব না খুললে সংকট বাড়বে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।