ম্যানচেস্টার সিটির পক্ষেও আর সম্ভব হলো না ধারাটা পালটানো।
সর্বশেষ সাতবার নতুন কোনো দল যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে, সবাই হেরেছে। এই শতাব্দীতে এসে নতুন দলকে প্রথমবারে ফাইনালে উঠেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে দেখা যায়নি। পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটিও পারল না।
পোর্তোর দ্রাগাও স্টেডিয়ামে আজ ’অল ইংলিশ ফাইনালে’ সিটিকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা উৎসব করল টমাস টুখেলের চেলসি। ২০১২ সালে নিজেদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা চেলসির দ্বিতীয় শিরোপা এটি।
আর চেলসির কোচ টমাস টুখেলের প্রথম! গত মৌসুমে নেইমার-এমবাপ্পের পিএসজিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেও বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। এরপর ঘটনাচক্রে ডিসেম্বরে পিএসজি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। এসেছিলেন চেলসিতে। এখানে এসে ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগও জেতা হয়ে গেল তাঁর!
সেটি এসেছেও কী দারুণ ঢংয়ে! বলের দখল ম্যানচেস্টার সিটিরই বেশি ছিল, সেটি হয়তো অনুমিতই ছিল। কিন্তু ম্যাচজুড়ে সিটির আক্রমণভাগকে দমিয়ে রাখা চেলসিই বরং সুযোগ পেয়েছে বেশি। শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিল ৪২ মিনিটে কাই হাভার্টজের গোল!
গত মাসে যখন নিশ্চিত হয়েছিল চেলসি আর ম্যানচেস্টার সিটি ফাইনালে খেলছে, তারপর ঘরোয়া লিগে-কাপে দুবার মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। দুবারই চেলসি জিতেছে। ব্যতিক্রম হলো না আজও।
সেই দুই ম্যাচে যেভাবে খেলেছে চেলসি, আজও প্রায় একই ঢংয়েই খেলেছে। রক্ষণ সামলে রেখে পাল্টা আক্রমণে উঠেছে। ৪২ মিনিটে গোলটিও সেভাবেই এসেছে। মাঝমাঠে প্রায় বাঁ দিকের টাচলাইন থেকে সিটি বক্সের দিকে থ্রু বাড়িয়েছিলেন চেলসির ম্যাসন মাউন্ট। সিটির দুই সেন্টারব্যাকের ফাঁক গলে বক্সের দিকে দৌড়াতে থাকা হাভার্টজের পায়ে পড়ে বল। এগিয়ে আসা সিটি গোলকিপার এদেরসনকে ফাঁকি দিতে গিয়ে প্রথম চেষ্টায় পারেননি হাভার্টজ। কিন্তু বল এদেরসনের গায়ে লেগে একটু সামনে হাভার্টজের গতিপথেই গিয়ে পড়ে। ফাঁকা পোস্টে বল জড়াতে আর ঝামেলা হয়নি জার্মান ফরোয়ার্ডের।
পেপ গার্দিওলা কি আরেকবার চ্যাম্পিয়নস লিগে বড় ম্যাচে কৌশলের ভুল করলেন? কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম তিন বছরের মধ্যে দুবার বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা গার্দিওলা এরপর আর কখনোই যে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফিটা জিততে পারেননি, সেটার মূলে চ্যাম্পিয়নস লিগে তাঁর কৌশল নিয়ে ভুলকেই দেখেন অনেকে। আজ ফাইনালেও তেমন কৌশলের ভুলই যেন করে বসেছেন স্প্যানিশ কোচ।
মূল একাদশে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি বা ফার্নান্দিনিওর কাউকে রাখেননি। বিরতির আগেই চেলসি এগিয়ে গেলেও দ্বিতীয়ার্ধে সের্হিও আগুয়েরোকে নামিয়েছেন অনেক পরে, ৭৭ মিনিটে এসে। ভাগ্যও সিটির পক্ষে ছিল না। ৬০ মিনিটে চোট পেয়ে কেভিন ডি ব্রুইনা মাঠ ছাড়েন। সে সময় ডি ব্রুইনার বদলে গাব্রিয়েল জেসুসকে নামান গার্দিওলা। কিন্তু শুরু থেকে গুন্দোয়ান-বের্নার্দো সিলভা-ফোডেন-মাহরেজ-স্টার্লিং-ডি ব্রুইনাকে নিয়ে গড়া তাঁর অতি-আক্রমণাত্মক মাঝমাঠে রক্ষণের ভরসা হওয়ার মতো কেউ ছিলেন না।
যে জায়গায় চেলসির হয়ে দারুণ দেখিয়েছেন চোট কাটিয়ে ফেরা এনগোলো কান্তে আর জর্জিনিও। আক্রমণে ৩-৪-২-১ ছকে নামা চেলসি এ দুজনের ভরসাতেই রক্ষণের ক্ষেত্রে বারবার নেমে যাচ্ছিল ৫-৩-২ ছকে।
চেলসির জন্য তবু বড় ধাক্কা হয়ে এসেছিল ৩৯ মিনিটে রক্ষণের নেতা থিয়াগো সিলভার চোট। এর মিনিট তিনেক আগে কুঁচকিতে চোট পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই সিলভা জানিয়ে দেন, তাঁর পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছিল, এই ধাক্কা বুঝি আর সামলাতে পারবে না চেলসি। কিন্তু হলো উল্টো, থিয়াগো উঠে যাওয়ার মিনিট তিনেক বাদেই গোল চেলসির!
শুরু থেকে আক্রমণে দারুণ শুরু করা চেলসির হয়ে ১০ মিনিটেই গোলের খুব কাছে গিয়েছিলেন টিমো ভের্নার। কিন্তু মাউন্টের বাড়ানো বলে ঠিকমতো পা ছোঁয়াতে পারেননি জার্মান স্ট্রাইকার। পাঁচ মিনিট পর আরেকটি সুযোগ নষ্ট করেন তিনি।
বিরতির আগে আক্রমণে সিটির তেমন বলার মতো মুহূর্ত বলতে ২৭ মিনিটে গোলের দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন ফিল ফোডেন। কিন্তু মৌসুমজুড়ে দারুণ চমক উপহার দেওয়া ইংলিশ ফরোয়ার্ডের শট আটকে দেন চেলসি ডিফেন্ডার আন্টোনিও রুডিগার। সিটির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে ৫৬ মিনিটে ডি ব্রুইনার চোট। রুডিগারের সঙ্গে ধাক্কায় মাথায় আঘাত পান ডি ব্রুইনা, চার মিনিট পর মাঠ ছাড়েন।
এরপর ৬৮ মিনিটে সমতা ফেরানোর একটা সুযোগ পেয়েছিল সিটি। কিন্তু মাহরেজের ক্রসে জেসুস পা ছোঁয়ানোর আগেই চেলসিকে বিপদমুক্ত করেন আসপিলিকেতা। মাঝে ৭৩ মিনিটে ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক চেলসির হয়ে গোলের খুব কাছে গিয়েছিলেন।
ম্যাচের শেষ দু-তিন মিনিটে অবশ্য চেলসির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল সিটি। ৯০ মিনিটে দিয়াজের ক্রস চেলসি বক্সে সবাইকেই এড়িয়ে যায়, এরপর মাহরেজ আবার ক্রস করেন বক্সে, কিন্তু ক্রসটা ফোডেনের কাছে যাওয়ার আগেই চেলসি ডিফেন্ডাররা সেটি ফিরিয়ে দেন। এরপর যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে মাহরেজ আবার সিটিকে সমতায় ফেরানোর দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শট চলে যায় বার উঁচিয়ে।