আজ রুমি হতে পারবেন কেউ?
ডিসেম্বরের সে দিনটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। ঢাকায় সেদিন শীতের অনুভূতি ছিল অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় তীব্র। আজ থেকে ২৮ বছর আগের কথা। বছর ১৯৯১।
ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১। ফুটবলের দুনিয়ার অতি প্রিয় বক্সিং ডে। কিন্তু কুয়াশাঘেরা সে দিনটিকে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের অনেকেই মনে রাখবেন বিশেষ এক কারণে। সেদিনই ভারতের বিপক্ষে এসেছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম জয় (২-১)।
কলম্বো সাফ গেমসে গ্রুপপর্বের সে ম্যাচ বাংলাদেশ জিতেছিল কিন্তু সবকিছু হারিয়ে। আগের ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে ১-০ গোলে হেরে আরও একবার গেমসে সোনাবঞ্চিত হওয়াটা নিশ্চিত করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। সে সময় টুর্নামেন্টের ফরম্যাট ছিল কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। দুই গ্রুপের দুই শীর্ষ দল নামত সোনার পদকের লড়াইয়ে। দ্বিতীয় দুই দল খেলত ব্রোঞ্জের জন্য। সাফ গেমসে সেবার ভুটান ফুটবল দল পাঠায়নি। ৬ দল নিয়েই হয়েছিল গেমসের ফুটবল-যুদ্ধ।
ভারতকে হারালেও সে ম্যাচের পর দেশে খুব বেশি আলোড়ন ওঠেনি। তখন ফুটবলে ‘সাফ স্বর্ণ’টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ভারতকে প্রথমবারের মতো হারানোটাও খুব বড় কিছু মনে হয়নি। তবে ২৮ বছর পরও আজ যখন বাংলাদেশ-ভারত ফুটবল যুদ্ধে নিজেদের পাশে মাত্র দুটির বেশি জয় যোগ করতে ব্যর্থ, তখন সে জয়কে স্মরণীয় মনে হয় বইকি!
স্মরণীয় সে জয়ের নায়ক ছিলেন রিজভী করিম রুমি। দেশের ফুটবলের সে সময়কার সবচেয়ে বড় গ্ল্যামার বয়। সেদিন রুমির দুই গোলেই এসেছিল ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়। এর মাঝে একটি ছিল দৃষ্টি নন্দন। প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে ভারতীয় গোলরক্ষককে বোকা বানিয়েছিলেন রুমি। সে ম্যাচের প্রত্যক্ষদর্শীদের মানতেই হবে, পুরো ম্যাচে বাংলাদেশের ১১ জনের বিপক্ষে ভারত সেদিন কতটা অসহায় ছিল। ভারতের সে দলটি খুব দুর্বল ছিল—এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি, সত্যজিৎ চ্যাটার্জি, ব্রুনো কুটিনহোদের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দলটি ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ।
বাংলাদেশ দলটিও কম অভিজ্ঞ ছিল না। স্ট্রাইকিংয়ে শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও রুমি। একের পর এক বল তৈরি করেছেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। রক্ষণে কায়সার হামিদ, জুয়েল রানা, আতাউর রহমান। মধ্যমাঠে পরিশ্রমী সত্যজিৎ দাস রুপু। কোচের দায়িত্বে ছিলেন শহীদউদ্দিন সেলিম। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সে ম্যাচটা পুরোপুরি হয়ে উঠেছিল রুমির ম্যাচ।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ফুটবল এক ধরনের উত্থান দেখেছিল। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভারত আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছিল। তারই চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৯১ সাফের সে হার। সে ম্যাচে বাংলাদেশ নেমেছিল ভারত দলের সব খুঁটিনাটি জেনে। বছরজুড়েই ক্লাব পর্যায়ে আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্সের মতো ক্লাব, ভারতের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান আর মোহামেডানের সঙ্গে খেলেছে।
১৯৯১ সালের জুনে দুই বাংলার প্রধান ছয় দলকে নিয়ে একটি আমন্ত্রণমূলক ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সে টুর্নামেন্ট জিতেছিল আবাহনী, রুমি দুর্দান্ত খেলেছিলেন তাতে। সে বছরই কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে রুমি, মোনেম মুন্না ও আসলামরা খেলার সুযোগ পান। কলকাতা মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন সাব্বির, জুয়েল রানা, মাহবুব হোসেন রক্সি, ইমতিয়াজ সুলতান জনিরা। কলকাতা লিগে মুন্না-রুমির ফুটবল শৈলী ইতিহাস হয়ে আছে। সে ধারাবাহিকরাই সাফে ভারতের বিপক্ষে ধরে রেখেছিলেন রুমি।
২৮ বছর পর ভারতের বিপক্ষে আরও একটি ম্যাচ। ভিন্ন এক প্রতিযোগিতায়, ভিন্ন পরিস্থিতিতে। দুই দলের মধ্যকার সম্পর্কও বদলে গেছে। যেকোনো বিচারেই ভারত এখন ফুটবলে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এর মাঝে পিছিয়েছে প্রতিনিয়ত। আমাদের ফুটবলে এখন একজন রুমি নেই যিনি একক নৈপুণ্যে আন্তর্জাতিক ম্যাচ জিতিয়ে আনবেন। গত কয়েক বছরে গোল করতে না পারার ব্যর্থতা ভুগিয়েছে দলকে। রক্ষণেও নেই একজন কায়সার। প্লেমেকার হিসেবে সাব্বিরের মতো তারকাও এখন অনেকটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। আজ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে কেউ কেউ তো রুমি হয়ে উঠতেই পারেন!
জামাল ভূঁইয়ারা রুমির কাছ থেকে প্রেরণা নিতেই পারেন আজ।