দুই দলের শেষ দেখায় পাকিস্তানের একটি উইকেটও নিতে পারেনি ভারত, পাকিস্তান জিতেছিল ১০ উইকেটের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবধানে।
দশ মাস পর একই মাঠে পাকিস্তানকে এবার পুরো ২০ ওভারও ব্যাটিং করতে দেয়নি ভারত, গুটিয়ে দিয়েছে ১৪৭ রানে; ম্যাচ জিতেছে ৫ উইকেটে!
যতটা সাধারণ আর সরল ভাষায় ম্যাচের ফল লিখে দেওয়া হলো, এতটা সহজে ভারত জেতেনি। দেড় শ ছুঁইছুঁই রানের লক্ষ্যে পৌঁছাতে খেলতে হয়েছে শেষ ওভার পর্যন্ত; জয়ের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয়েছে রবীন্দ্র জাদেজা আর হার্দিক পান্ডিয়াদের ব্যাটের দিকে, যারা ব্যাটিং জানলেও আদতে বোলারও। শেষ ওভারের প্রথম বলে জাদেজা আউট হওয়ার পর ম্যাচে ছিল দুই দলই। চতুর্থ বলে ছয় মেরে যে অনিশ্চয়তার ইতি টানেন হার্দিক পান্ডিয়া।
লোকেশ রাহুল, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি আর সূর্যকুমার যাদব-স্বীকৃত চার ব্যাটসম্যানই যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন, তখনো ৩৪ বলে ৫৯ রান দরকার ছিল ভারতের। অভিষেকেই দ্বিতীয় বলে উইকেট নিয়েছেন নাসিম শাহ। পরে ফিরিয়ে দিয়েছেন সূর্যকুমার যাদবকেও। ভারত তখন ৪ উইকেটে ৮৯। মাঝখানে বড় দুটি উইকেট নিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ নেওয়াজ। রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি তাঁরই শিকার।
স্নায়ুতে চাপ তৈরি করা সমীকরণকে বেশ ঠাণ্ডা মাথায়ই সামাল দিলেন জাদেজা ও পান্ডিয়া। কোহলির শততম টেস্ট আর শততম ওয়ানডেতে ম্যাচসেরা হওয়া জাদেজা খেললেন ২৯ বলে ৩৫ রানের ইনিংস। তবে এ যাত্রায় ম্যাচসেরা হননি তিনি। সেই স্বীকৃতি ১৭ বলে ৩৩ রান করে অপরাজিত থাকা হার্দিকের। ব্যাটিংয়ের আগে বল হাতেও যিনি সফল, ২৫ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ভারতকে জেতানোর পাশাপাশি আরেকটা ব্যক্তিগত প্রাপ্তিও আছে ২৮ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের। চার বছর আগে এশিয়া কাপে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে, সেদিন ফিল্ডিংয়ে চোট পেয়ে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছেড়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। পরে বলেছিলেন, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল ক্যারিয়ার শেষ।
ক্যারিয়ার সমাপ্তির ভয় পাওয়া সেই পান্ডিয়া ওই মঞ্চে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আর একই মাঠে ফিরলেন ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স দিয়ে। পঞ্চম উইকেটে জাদেজা-পান্ডিয়ার ২৯ বলে ৫২ রানের জুটির আগে ভারতকে বিপদে ফেলে যান রোহিত-কোহলিরা। রান তাড়ায় ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে ফেরেন লোকেশ রাহুল। দ্বিতীয় উইকেটে রোহিত-কোহলি গড়েন ৪৯ রানের জুটি। কিন্তু আট বলের ব্যবধানে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন দুজনই। মিড অফে ক্যাচ দেওয়ার আগে রোহিত করেন ১৮ বলে ১২ রান, শততম টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা কোহলি একই ফিল্ডারের হাতে একই জায়গায় ক্যাচ দেন ৩৪ বলে ৩৫ রান করে। দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ধীর গতির ব্যাটিং আর উইকেটের পতনে রয়েসয়ে খেলার চেষ্টা করেন সুর্যকুমার যাদব। কিন্তু ১৫তম ওভারে তিনি কাটা পড়েন নাসিমের বলে।
এর আগে ম্যাচের প্রথমার্ধের পুরোটাই ছিল ভারতীয় পেসারদের দাপট। ভুবনেশ্বরের করা প্রথম ওভারেই দুইবার রিভিউ থেকে বাঁচেন মোহাম্মদ রিজওয়ান; প্রথমবার আম্পায়ারের এলবিডব্লু আউট পাল্টালে, দ্বিতীয়বার ভারতের কট বিহাইন্ডের আবেদন বাতিল হলে। তবে উইকেট পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। পরের ওভারে এসেই শর্ট বলে তুলে নেন পাকিস্তান অধিনায়ক বাবরকে। টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যান সোজা ব্যাটে দুটি চার দিয়ে শুরু করলেও ফেরেন ৯ বলে ১০ রান করে। তিন নম্বরে নামা ফখর জামানও আটকে যান ১০ রানে। আবেশ খানের উঠতি বলে কাট খেলতে গেলে বল তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে যায়। ভারতের উইকেটরক্ষক দিনেশ কার্তিক বা বোলার অবশ্য আবেদন করেননি, তবে নিজেই ‘ওয়াক’করে চলে যান ফখর। ৪২ রানে পড়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় উইকেট।
পাওয়ার প্লের মধ্যে টপ অর্ডারের দুজন আউট হয়ে যাওয়ায় অন্যপাশে নিজেকে গুটিয়ে নেন রিজওয়ান। ইফতিখার আহমেদকে নিয়ে মনোযোগ দেন উইকেট ধরে রাখায়। ১২ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৮৭ রান নিয়ে ভালো একটি অবস্থানও দাঁড় করিয়ে ফেলেন। কিন্তু যখনই একটু মারতে যাওয়ার সময় হয়েছে, তখনই আঘাত হানেন পান্ডিয়া। ২২ বলে ২৮ রান করে ইফতিখার ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে, বলের ধরন আগের দুটি উইকেটের মতোই-শর্ট এন্ড বাউন্স!
পরের ওভারে বোলিংয়ে এসে পান্ডিয়া তুলে নেন রিজওয়ানকেও। এটিও ছিল শর্ট বল। সিমে পড়ে ওঠা বলটির গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানি ওপেনার, কিন্তু বল তাঁর ব্যাটে লেগে চলে যায় থার্ডম্যানে। আবেশের ক্যাচে শেষ হয় ৪২ বলে ৪৩ রানের ইনিংস; ৪ চার ও ১ ছয়ে গড়া ইনিংসটি খেলার পথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে চার হাজার রান পূর্ণ করেন রিজওয়ান।
দুই ওভারের ব্যবধানে দুই সেট ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পরপর রীতিমতো ঝড় বয়ে যায় পাকিস্তান ব্যাটিং লাইনআপে। ভুবনেশ্বর, আর্শদীপের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১২৮ রানের মধ্যে নবম উইকেটেরও পতন ঘটে। তারপরও যে পাকিস্তানের রান দেড় শর কাছাকাছি পৌঁছায়, সে কৃতিত্ব হারিস রউফ ও শাহনেওয়াজ দাহানির। ২০তম ওভারের পঞ্চম বলে দাহানির আউটের আগে ৮ বলে ১৯ যোগ করেন দুজন। ২ চারের সাহায্যে রউফ করেন ৭ বলে ১৩ আর ২ ছয়ে দাহানি খেলেন ৬ বলে ১৬ রানের ইনিংস।
তবে বোলারদের এই ব্যাটিং প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। পাকিস্তানকে মাঠ ছাড়তে হয়েছে পরাজয় নিয়ে। সঙ্গে এই আক্ষেপও-ব্যাটসম্যানরা যদি আর কিছু রান স্কোরবোর্ডে তুলতে পারতেন!
পাকিস্তানের যেখানে আফসোস, সেখানেই ভারতের আনন্দের উপলক্ষ। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের একটি উইকেটও ফেলতে পারেননি ভারতীয় বোলাররা। এবার পেসাররাই তুলে নিয়েছেন পুরো ১০ উইকেট। নেতৃত্ব দিয়েছেন ভুবনেশ্বরই। ৪ ওভারে ২৬ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট, পাকিস্তানের বিপক্ষে যা কোনো ভারতীয়র সেরা বোলিং। পান্ডিয়া নেন ৩ উইকেট। বাকি তিনটির দুটি নেন আর্শদীপ, একটি আবেশ। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ভারতের পেসারদের প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের সব কটিই নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
তবে দিন শেষে ভারতের আসল অর্জন জয় দিয়ে এশিয়া কাপ শুরুর, যে জয়ের মাহাত্ম্য আরও বেড়ে গেছে তা পাকিস্তানের বিপক্ষে এসেছে বলে।