সাক্ষাৎকারে তাবিথ আউয়াল

‘ভালো খেলুন, আরও বড় চুক্তি পান, সুপারস্টার হউন’

আলোচ্যসূচিতে রেকর্ড ২৮টি বিষয় নিয়ে বাফুফের নতুন নির্বাহী কমিটির প্রথম সভা বসবে আজ সকালে। কেমন হতে পারে দেশের ফুটবলের এই নবযাত্রা? গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়াল কথা বলেছেন দেশের ফুটবল নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং আরও অনেক প্রসঙ্গেই—

প্রথম আলো:

১৬ বছর বাফুফের সভাপতি ছিলেন কাজী সালাহউদ্দিনের মতো বড় তারকা। সভাপতির দায়িত্ব পালনের জন্য আপনি কতটা প্রস্তুত?

তাবিথ আউয়াল: আমি পুরোপুরিই প্রস্তুত। আমার মতো কারোরই বাফুফের নেতৃত্বে আসা দরকার ছিল। ফুটবল যে স্তরে চলে যাচ্ছে, একটু পরিবর্তন দরকার। আমার অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা বাফুফের সভাপতি পদের সঙ্গে যায়।

প্রথম আলো:

অনেকটা শৌখিন ফুটবলার ছিলেন আপনি। ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই মেয়াদে বাফুফের সহসভাপতি হয়ে এখন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে শীর্ষ পদে। ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব হয়ে গেল কি?

তাবিথ: বড় দায়িত্ব, দুরূহ চ্যালেঞ্জ—সন্দেহ নেই। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে আমার চেয়েও বয়সে তরুণেরা আরও বড় দায়িত্ব নিচ্ছেন। এটা সময়ের চাহিদাও।

প্রথম আলো:

দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে আপনি। নিজেও ব্যবসায়ী, রাজনীতিক। বিএনপির টিকিটে দুবার ঢাকার মেয়র পদে নির্বাচন করেছেন। ব্যবসা, রাজনীতি, ফুটবল—কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেবেন?

তাবিথ: কোনোটাকেই কম গুরুত্ব দিচ্ছি না। ফুটবলে আছি খেলোয়াড়দের আরেকটু সহযোগিতা করতে আর দেশের সুনাম বাড়াতে। ব্যবসাটা সোশ্যাল বিজনেস। রাজনীতি সাধারণ জনগণের জন্য, বিশেষভাবে নগরবাসীর সুযোগ–সুবিধা যেন আরেকটু বাড়াতে পারি।

আমাদের এখানে খেলোয়াড়েরা থাকেন আড়ালে, কর্মকর্তাদের নিয়েই প্রচার বেশি। কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন, বিভিন্ন সভায় যাচ্ছেন। আমি চাই, সংগঠকেরা পেছনে থাকি। খেলোয়াড়-কোচ, এমনকি রেফারিরাও সামনে চলে আসুক।
তাবিথ আউয়াল
প্রথম আলো:

আপনি একের ভেতর তিন। এত ব্যস্ততা...ফুটবলকে কতটা সময় দিতে পারবেন?

তাবিথ: আমি আসলে কৌশলগত কারণে একটু আড়ালে থাকি। আমি মনে করি, তারকাদের সামনে আনতে হবে। আমাদের খেলোয়াড়েরাই তারকা। নারী, পুরুষ সবাই। কিন্তু আমাদের এখানে খেলোয়াড়েরা থাকেন আড়ালে, কর্মকর্তাদের নিয়েই প্রচার বেশি। কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন, বিভিন্ন সভায় যাচ্ছেন। আমি চাই, সংগঠকেরা পেছনে থাকি। খেলোয়াড়-কোচ, এমনকি রেফারিরাও সামনে চলে আসুক।

খেলোয়াড়-কোচ, রেফারিদের সামনে চান নতুন সভাপতি
শামসুল হক
প্রথম আলো:

বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক বলেছেন, খেলাধুলাকে তাঁরা রাজনীতিকরণ করতে চান না। কিন্তু আপনি বাফুফের সভাপতি হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। রাজনীতির গণ্ডিতেই কি সীমাবদ্ধ রাখলেন নিজেকে?

তাবিথ: তারেক রহমান আমাদের নেতা। তাই তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানো। তবে ক্রীড়াকে ক্রীড়ার ভেতরে রাখতে হয় কীভাবে জানি। আমি বাফুফের সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছি ক্রীড়াবিদ হিসেবে, রাজনৈতিক পরিচয়ে নয়।

প্রথম আলো:

সভাপতি প্রার্থী হিসেবে আপনার কোনো ইশতেহার ছিল না, কেন?

তাবিথ: অতীতে দেখেছি সভাপতি প্রার্থীর দেওয়া ম্যানিফেস্টো পড়ে কেউ নিজের মনে করে না। আমার লিখিত ম্যানিফেস্টো ছিল না এটা ঠিক, দেখতে চেয়েছি কারা কমিটিতে আসে। তবে বাফুফেকে নতুনভাবে সাজাতে চাই, সবখানেই তা বলেছি।

ছেলেদের জাতীয় দলের র‌্যাঙ্কিং বাড়ানো বড় লক্ষ্য। পারফরম্যান্সে (ছেলে ও মেয়ে) ধারাবাহিকতা রাখতে চাই। মাঠে দর্শক টানতে পারাটাকে নিজেকে মাপার বড় জায়গা মনে করি।
তাবিথ আউয়াল
প্রথম আলো:

বাফুফে সভাপতি হিসেবে এমন কী করতে চান, যাতে মানুষ আপনাকে সফল বলবে?

তাবিথ: ছেলেদের জাতীয় দলের র‌্যাঙ্কিং বাড়ানো বড় লক্ষ্য। পারফরম্যান্সে (ছেলে ও মেয়ে) ধারাবাহিকতা রাখতে চাই। মাঠে দর্শক টানতে পারাটাকে নিজেকে মাপার বড় জায়গা মনে করি। আরেকভাবেও সফল হতে চাই, প্রতিটি ক্লাবের আর্থিক দরজাটা খুলে দিয়ে। এখন প্রযুক্তির যুগ। মিডিয়া রাইটসের মাধ্যমে আরও অর্থ পেতে পারে ক্লাবগুলো। চেষ্টা করব সব ডিভিশনের সব ম্যাচ লাইভ স্ট্রিমিং করতে। সেটা জেলা লিগেও হতে পারে। ক্লাবগুলোকে আমরা ডিজিটাল যুগে নিয়ে যাব। এতে খেলোয়াড়দের ভক্ত, অনুসারী বাড়বে, স্পনসর পাবে। আগামী চার বছরে দেশের ফুটবলকে একটা বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মে দেখতে চাই।

নারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাবিথ আউয়াল
বাফুফে
প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ক্লাব সংস্কৃতিতে তো বাণিজ্যিক শব্দটা নেই বললেই চলে। কীভাবে করবেন সেটা?

তাবিথ: নেই বলেই করতে হবে। ফুটবল বাণিজ্যিকীকরণের বিকল্প নেই। ক্লাবগুলোকে উৎসাহ দেব তারা যেন এলাকাভিত্তিক হয়ে যায়। তখন সমর্থকেরা যার যার এলাকার জন্য জেগে উঠবে। আমি ফেনী সকার ক্লাব করে প্রচুর সমর্থক পেয়েছি। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী নিয়ে নোফেল ক্লাব করেছি। ওই অঞ্চলের মানুষজন নোফেলকে ফলো করে। ক্লাবগুলোকে সে পথে যেতে হবে। ক্লাব এখন ট্রান্সফার ফি পায় না, খেলোয়াড় তৈরিতে তারা অনাগ্রহী। লম্বা সময়ের জন্য খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তিও করে না।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

কিন্তু বাংলাদেশে তো ক্লাব কমে যাচ্ছে। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ফুটবলকে বিদায় বলেছে। বেসরকারি ক্লাব সাইফ স্পোর্টিং চলে গেছে। ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর শেখ জামাল, শেখ রাসেল ক্লাবও খেলছে না...

তাবিথ: ক্লাবগুলোকে নাম পরিবর্তন করে এলাকাভিত্তিক হতে হবে। আর সুষ্ঠু ধারায় আসতে হবে। বিগত সরকারের সময় অনেক ক্লাব ‘ক্যাসিনো ক্লাব’ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে নোংরা রাজনীতি, দখলদারি হয়েছে। এসব থেকে ক্লাবগুলোকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।

প্রথম আলো:

এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠে জাতীয় দলের ফুটবলাররা বলার মতো কিছুই করতে পারছেন না। তাঁদের জন্য আপনার কী বার্তা?

তাবিথ: ভালো খেলুন, আরও বড় চুক্তি পান, সুপারস্টার হউন। আমি ফুটবলারদের বিদেশি লিগে খেলার ওপর বেশি জোর দেব। বাফুফে এ ব্যাপারে তাদের সব সহযোগিতা করবে।

প্রথম আলো:

সভাপতি হিসেবে আপনার সাফল্য–ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করবে জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের ওপর। তাঁদের পারফরম্যান্স ভালো করতে কী উদ্যোগ নেবেন?

তাবিথ: সম্ভাব্য সব উদ্যোগই নেব। নিয়মিত ম্যাচ খেলব। আগামী দুই বছরের ম্যাচগুলোতে জয়ী হওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। ২০২৫-এ সাফ আছে। একই বছর এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে কোয়ালিফাই করলে ২০২৭ সালে এশিয়ান কাপে খেলার সুযোগ আসবে।

প্রথম আলো:

আপনি কি বিশ্বাস করেন এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে বাংলাদেশ?

তাবিথ: লক্ষ্য তো রাখতেই হবে। নইলে এগোবেন কীভাবে?

মেয়েদের পাইপলাইন আরও শক্ত করতে হবে, আরও বেশি কিশোরীকে ফুটবলে আনতে চাই আমি।
তাবিথ আউয়াল
প্রথম আলো:

ছেলেদের ব্যর্থতায় বাফুফের মুখরক্ষা করে চলেছেন মেয়েরা। কিন্তু দুবার সাফজয়ী মেয়েদের ফুটবলীয় কর্মকাণ্ড মূলত বাফুফে ভবনকেন্দ্রিক। এটা ছড়ানোর উদ্যোগ নেবেন?

তাবিথ: অবশ্যই নেব। মেয়েদের পাইপলাইন আরও শক্ত করতে হবে, আরও বেশি কিশোরীকে ফুটবলে আনতে চাই আমি।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

বাফুফে থেকে পৃষ্ঠপোষক সরে গেছে। ২০২২ সালে সোহাগ–কাণ্ডের পর অনিয়ম-দুর্নীতি বাফুফের ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বাফুফেতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কী করবেন?

তাবিথ: ফেডারেশনে সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সবই নিশ্চিত করব। কোনো রকম অনিয়ম সহ্য করা হবে না। স্টাফদের যা বলার বলে দেয়েছি। এককভাবে আমি ফেডারেশন চালাব না। সম্মিলিত চেষ্টায় সব চলবে, স্পনসরও আসবে। স্পনসরের অর্থ অডিট করব, তাদের আস্থায় আনব।

প্রথম আলো:

জেলা লিগগুলো নিয়মিত করার কী উদ্যোগ নেবেন আপনি? শেরেবাংলা কাপ, সোহরাওয়ার্দী কাপ ফিরবে?

তাবিথ: আমাদের বিশাল একটা কর্মপরিকল্পনা আছে, যার বড় অংশ জেলা লিগ। অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব–১৭ টুর্নামেন্ট চায় ফিফা। ছেলেমেয়েদের দুই বিভাগেই এগুলো হবে। বিস্তারিত ফেডারেশনের প্রথম সভার পর বলব।

প্রথম আলো:

ফুটবলে মাঠ একটা বড় সমস্যা। এর সমাধান কী?

তাবিথ: নির্বাহী কমিটির প্রথম সভাতেই মাঠ নিয়ে একটা আহ্বায়ক কমিটি করার ভাবনা আছে। এই কমিটি মাঠ উদ্ধার, খোঁজা আর মাঠ উন্নয়নে কাজ করবে।

ফেডারেশনে সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সবই নিশ্চিত করতে চান তাবিথ আউয়াল
বাফুফে
প্রথম আলো:

দেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ ফুটবল একাডেমি নেই। এ নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা?

তাবিথ: একাডেমি চালানো বাফুফের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সারা দেশে যেন একাডেমি হয়, সে জন্য বাফুফে সহায়তা করতে পারে। ক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয়, বিকেএসপির মাধ্যমে একাডেমি হতে পারে। ফুটবল এখন বৈজ্ঞানিক ধারায় চলে গেছে। ফলে গোলকিপিং, স্ট্রাইকিং, ফ্রি–কিকে বিশেষায়িত একাডেমি দরকার।

আরও পড়ুন