খেলা ভালোবাসেন যারা, তাদের খেলা নিয়ে সিনেমাও ভালো লাগার কথা। সব বাধা ডিঙিয়ে জয়, উঠে আসা, আশ্চর্য পতন কিংবা তারকা-জীবন…খেলার সিনেমা কোনো না কোনোভাবে প্রেরণার আধারও। নটরডেমের হয়ে কলেজ ফুটবল খেলা ড্যানিয়েল রুয়েটগারের জীবন অবলম্বনে বানানো সিনেমা ‘রুডি’-র চিত্রনাট্যকার অ্যাঞ্জেলো পিজ্জো একবার বলেছিলেন, ‘আবেগতাড়িত হয়ে মূল চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে বলেই লোকে খেলার সিনেমা ভালোবাসে। লোকে রুডিকে ভালোবাসে কারণ ওর মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়।’
খেলা নিয়ে তেমনি কিছু সিনেমার গল্প এই ধারাবাহিকে। আজ শেষ পর্ব-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বন্দীদের সঙ্গে জার্মানদের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে সিনেমা কম নেই। ‘টু হাফ-টাইমস ইন হেল’ এমনই এক সিনেমা। এই খেলা গড়িয়েছিল অ্যাডলফ হিটলারের জন্মদিনে। তবে একজন ফুটবলারের তৃণমূল থেকে তারকা হয়ে ওঠা, মাঠ ও মাঠের বাইরের জীবন, টানাপোড়েন, ঘুরে দাঁড়ানো এবং জীবনের স্বপ্নপূরণ—বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা!
সান্তিয়াগো মুনেজ নামে এমন এক জীবনের ধাঁচ ও বিন্যাস দেখতে চাইলে ‘গোল!’ সিরিজের তিনটি সিনেমা লাগবে। নির্মাণে ফিফাও থাকায় পর্দায় তারকার হাট। জিনেদিন জিদান, রোনালদো, রাউল গঞ্জালেস, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, স্টিভেন জেরার্ড, ডেভিড বেকহাম…। বেকহামের কথা যখন উঠল ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’কেও মনে করিয়ে দেওয়া যায়। রক্ষণশীল শিখ পরিবারের সেই মেয়েটি যে, স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিল।
দুই ভাই হুলিও ও ড্যানিয়েলেরও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ভেনেজুয়েলান ক্লাব কারাসকাস থেকে ট্রায়ালের ডাক পেয়েছিল। তাঁরা কি স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছিল? শেষ দৃশ্যে জবাবটা ধোঁয়াশা। তবে মনে টোকা মারার মতো কিছু মুহূর্ত আছে। হুলিও যখন ভেজা চোখে বুকে ক্রস টেনে আকাশপানে তাকিয়ে ছিল, তখনো। ভেনেজুয়েলান এ সিনেমার নাম ‘এরমানো’।
ইংল্যান্ড হার মেনেছিল। তাও আলফ রামসি-বিলি রাইটদের পরাক্রমশালী ইংল্যান্ড হেরেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে! ১৯৫০ বিশ্বকাপে ইতিহাসের অন্যতম এই অঘটন মার্কিন ফুটবলারদের কাছে জীবনের সেরা ম্যাচ হয়ে থাকার কথা। সিনেমার নামও ঠিক তাই ‘দ্য গেম অব দেয়ার লাইভস’। যুক্তরাষ্ট্রের সেই দলের ফুটবলারদের জীবন নিয়ে বানানো এ সিনেমা।
বেলগ্রেডের আনাচ-কানাচে থেকে উঠে আসা ফুটবলারদের প্রথম বিশ্বকাপে খেলার চিত্রায়ণ ‘মন্টেভিডিও: টেস্ট অব ড্রিম’ দেবে রোমাঞ্চের স্বাদ। তেমনি ব্রাজিলের হেলেনো ডি ফ্রেইতাসের জীবন নিয়ে বানানো ‘হেলেনো’, গারিঞ্চার জীবনকে ধারণ করা ‘গারিঞ্চা: এসত্রেলা সলিতারিয়া’ও রোমাঞ্চকর। ‘ইউনাইটেড’ আবার মর্মান্তিক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ‘বাসবি বেবস’দের মিউনিখ দুর্ঘটনা নিয়ে বানানো সিনেমা।
হাসতে চাইলে দেখতে পারেন ‘শী ইজ দ্য ম্যান’, ‘হার বেস্ট মুভ’ ‘দ্য কাপ।’ তথ্যচিত্রে ‘পেলাডা’ ‘বিকামিং চ্যাম্পিয়নস’ এবং ‘বোকা কনফিডেনশিয়াল’ থাকলে মন্দ না। বোকা জুনিয়র্সের কথাই যখন উঠল তাহলে ‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা’ তথ্যচিত্র কেন নয়? আগে কখনো দেখা যায়নি এমন ৫০০ ঘণ্টার ফুটেজ থেকে বানানো কিংবদন্তি-কথা।
মার্কিন মুলুকে ফ্রান্সিস কুইমেট নামেও এক কিংবদন্তি ছিলেন। প্রথম অপেশাদার হিসেবে ইউএস ওপেন গলফ জয়ী। সমাজের নিচু স্তর থেকে উঠে আসা কুইমেটের আদর্শ ছিলেন হ্যারি ভারডন। কিংবদন্তি এ ব্রিটিশ গলফারের শেকড়ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এবং শ্রেণিসংগ্রামের লড়াই ছিল দুজনেরই। ১৯১৩ ইউএস ওপেনে মুখোমুখি হয়েছিলেন দুজন। জিতেছিল অপেশাদার গলফ। ‘অ্যামেচার গলফের জনক’খ্যাত কুইমেটের সেই ঐতিহাসিক জয় নিয়ে বানানো সিনেমা ‘দ্য গ্রেটেস্ট গেম এভার প্লেড’। গলফ সেভাবে না বুঝলেও কোর্সের কিছু জমাট মুহূর্ত, কিছু ফ্রেম মনে রাখার মতো। দেখতে দেখতে মনে হবে, খেলার লড়াইয়ে কখনো কখনো ‘তৃতীয়’ একটা প্রতিপক্ষ থাকে। কুইমেট চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন শি লাবেউফ।
জিমি ক্যাভিয়েজেলও দারুণ অভিনেতা। ‘ববি জোনস; স্ট্রোক অব জিনিয়াস’ সিনেমার নাম ভূমিকায় মানিয়েছেন দুর্দান্ত। মাত্র ২৮ বছর বয়সে অবসর নেওয়া গলফ কিংবদন্তি ববি জোনসকে নিয়ে চিত্রনাট্য। হেসে চুর হতে চাইলে দেখতে পারেন ‘ক্যাডিশ্যাক’। ইএসপিএনের মতে, ‘খেলা নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে মজার সিনেমা।’
‘উইম্বলডন’ও মজার, ক্যারিয়ারের দুই প্রান্তে দাঁড়ানো দুজন খেলোয়াড়ের প্রেমের সিনেমা। তাই ভুল বোঝাবুঝিও আছে এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণাদায়ক গল্প। উঠতি খেলোয়াড় লিজির চরিত্রে মানিয়ে গেছেন কারস্টেন ডার্নস্ট। বিলি জিন কিং চরিত্রে যেমন মানিয়েছেন এমা স্টোন। ‘ব্যাটল অব সেক্সেস’ ম্যাচগুলোর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? এর মধ্যে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ববি রিগস ও মেয়েদের তখনকার শীর্ষ তারকা বিলি জিন কিংয়ের ম্যাচ ছিল সবচেয়ে আলোচিত। লড়াইটা জিতে র্যাকেট দিয়ে সমানাধিকারের কথা বলেছিলেন বিলি। তিন বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘ব্যাটল অব সেক্সেস’ মনোনয়ন পেয়েছিল গোল্ডেন গ্লোবে। ২০১৭ সালেই মুক্তি পাওয়া ‘বোর্গ বনাম ম্যাকেনরো’-ও দেখতে পারেন। দুই কিংবদন্তির দ্বৈরথের গল্প।
‘রকি’ সত্তর-আশির দশকে পাল্টে যেতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর গল্প, সাধারণ এক মুষ্টিযোদ্ধার বিশ্বসেরা হওয়ার চিত্রনাট্য। কাল্ট খেতাব পাওয়া রকির বাঁ হাতের ‘জ্যাব’ চোখে লেগে থাকবে। রকি টু-র একটি দৃশ্যও। জয়ের পর রিংয়ে ভিড়ের দঙ্গল থেকে রক্তমাখা মুখে সিলভ্যালেস্টার স্ট্যালোনের (রকি) ‘ইয়ো আদ্রিয়ান, আই ডিড ইট—আমেরিকান ড্রিমস।’ এই সিরিজের মোট আটটি সিনেমাই সমাদৃত। ‘ক্রিড’-এ রকির ভূমিকা অবশ্য পাল্টেছে। বন্ধুর ছেলের ট্রেনার।
মুষ্টিযুদ্ধ নিয়ে আছে দারুণ সব সিনেমা। ‘রেগিং বুল’-এর কথাই ধরুন। নামটা মিডলওয়েট বক্সার জ্যাক লামোত্তার। ভীষণ লাগসই। লামোত্তার ভেতরে ছিল এক খ্যাপাটে দৈত্য। নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় রিংয়ের বাইরে ছারখার হয় জীবন। ভেতরে সে মানুষটাই খ্যাপা ষাঁড়। রবার্ট ডি নিরো মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ শিখতে এত মনোযোগী ছিলেন যে পেশাদার ম্যাচও জিতেছেন। খেলার বাইরেও এটি সেরা সিনেমাগুলোর একটি।
যেমনটি ‘সিন্ডরেলা ম্যান’। রিংয়ে নয়, আদতে জীবনের সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধ করে বেঁচে থাকার গল্প। ভালোবাসার গল্প। তিরিশের দশকের সেই মন্দায় হেভিওয়েট বক্সার জেমস.জে. ব্রাডকের মৃত ক্যারিয়ারের পুনর্জাগরণ চিত্রিত এ সিনেমায়। তুষারপাতের মধ্যে একটি রোমান্টিক দৃশ্য অতুলনীয়। মিলিয়ন ডলার বেবি, সাউথ’প এবং দ্য হারিকেন দেখতেও ভুলবেন না। আর হ্যাঁ ‘দ্য ফাইটার’। দুই ভাইয়ের এপার-ওপার গল্প।
গল্প তো অনেক হলো। এবার কল্পনায় যাওয়া যাক। মনে করুন জীবনের সেই রঙিন দিনগুলো। ঘুমের দেশে একটা মাঠ, পছন্দের দল খেলছে। মাঠটা আপনার। দর্শকও আপনি। কারণ আর কেউ ওদের দেখে না। ওরা বেসবলের কিংবদন্তি কিন্তু মৃত। আপনি চাষি ছবির মতো সুন্দর ভুট্টা খেত কেটে মাঠ বানানোর নির্দেশ (!) পেয়ে যান প্রাণের কিংবদন্তির কাছ থেকে। তারপর? পরিবার পাশে থাকলে কত অদ্ভুত কিন্তু বিস্ময়কর খুঁজে পাওয়া যায় ‘অ্যা ফিল্ড ড্রিমস’ তেমনই এক পরিবেশনা।
রবার্ট রেডফোর্ডের ‘দ্য ন্যাচারাল’ দেখলেও চোয়াল ঝুলে পড়ে। রয় হবস নামে এক অখ্যাত বেসবল খেলোয়াড়ের হাতে এত জোর! অসাধারণ এ সিনেমায় পারিবারিক পরম্পরাও বেশ দৃশ্যমান। আর বজ্রপাতে চিরে যাওয়া একটা গাছ। তার কাঠ দিয়ে বানানো বেসবলের একটা ব্যাট। বাকিটা পর্দায়। আচ্ছা, টম হ্যাংকসকে কোচ হিসেবে দেখলে কেমন হয়? তাও যেন তেন কেউ নয় রীতিমতো অমিত প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে হারিয়ে যাওয়া কেউ, সারাক্ষণ মদের নেশায় চুর। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! ‘অ্যা লিগ অব দেয়ার ওউন।’
বেসবল যে কান্নাকাটির জায়গা না, নেশার ঘোর কাটলে এ কথাটা পইপই করে মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করেন জিমি ডুগান। অল আমেরিকান গার্লস প্রফেশনাল বেসবল লিগের অভিযাত্রা নিয়ে তৈরি সিনেমার গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু অ্যাথলেটিজমে জিনা ডেভিস, লোরি পেত্তি এমনকি পপ তারকা ম্যাডোনাও কম যাননি। আর ডুগান চরিত্রে হ্যাংকস? সিনেমার নামটা একটু ঘুরিয়ে বলা হয়, অ্যা লিগ অব হিজ ওউন! পারলে ব্রাড পিটের ‘মানিবল’টাও দেখুন।
বাস্কেটবল নিয়ে ‘হোসিয়ার্স’ সিনেমাটা না দেখার বিকল্প নেই। রাগবি নিয়েও ভালো সিনেমার অভাব সামান্যই। একসঙ্গে কয়েকটা নাম বলে ফেলা যাক। বর্ণবাদের বিপক্ষে জাতিকে এক করতে ১৯৯৫ রাগবি বিশ্বকাপ বেছে নিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কেন? কীভাবে? দেখুন ‘ইনভিক্টাস’, ভার্জিনিয়ায় স্কুলেও সাদা-কালো বিরোধের দিনগুলিতে কোচ বুনের ভূমিকা দেখুন ‘রিমেম্বার দ্য টাইটানস’-এ। উই আর মার্শাল, রুডি, দ্য ব্লাইন্ড সাইডও দেখতে পারেন। আইস হকিতে মজলে ‘মিরাকল’ দেখতেই হবে। ১৯৮০ অলিম্পিকে দোর্দন্ডপ্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের অবিশ্বাস্য চিত্রায়ন। যেখানে একটি দৃশ্যে কোচ কার্ট রাসেল তাঁর শিষ্যদের অনুশীলনের ছলে ভীষণ খাটাচ্ছিলেন। সহকারী কোচ বারবার আপত্তি জানানোর পর ধৈর্যহারা কোচের জবাব অনেকটা এমন ছিল, এতটা খাটছে বলেই জয়টা মধুর লাগবে।
খেলার সিনেমাও তো তাই! এ এমন এক জগত যেখানে মধুর খোঁজে নামতে হয়। এখানে নয়, সেখানে নয় হয়তো অন্য কোথাও!