৫৮ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন বেতন ছাড়া
পত্রিকার ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন। বিনা বেতনে কাজ করার মতো একজন স্কোরার লাগবে। ৭৩ বছর বয়সী একটা জীবনের গল্প কীভাবেই না জড়িয়ে গেল সে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে
১৯৬৩ সালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল শনিবার সকাল। পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে ১৪ বছর বয়সী মাইক ওয়ালশের মায়ের চোখ আটকে গেল বিজ্ঞাপনটিতে। ছেলে ক্রিকেটপাগল, কাজটা অবৈতনিক হলেও ছেলের ভালো লাগবে। তারওপর ক্লাবটাও বাড়ির পাশেই। এসব ভেবেই হয়তো ছেলেকে নিয়ে গেলেন বিজ্ঞাপনদাতা এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবে। মাইক ওয়ালশের জীবন বদলে দেওয়া সকাল সেটি।
সেই যে কাগজ-কলম হাতে ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর লেখা শুরু হলো, এই ৭৩ বছর বয়সেও এখনো অপরাজিত মাইক ওয়ালশ। স্কোরার বনে যাওয়া জীবনের খাতায় ‘নটআউট’। ৫৮ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবে। হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে থাকা কাজের যে মূল্য চুকানো যায় না!
শুধু ক্রিকেটপাগল বলে হয়তো তাঁকে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না; ক্রিকেটে শ্বাস, ক্রিকেটে বাস তাঁর। ক্রিকেট তাঁর সাধনা। ‘স্কুলে ক্রিকেট খেলতাম। আর রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম। ধারাভাষ্য শোনার সময়ে পুরোটা সময়ই আমার হাতে কলম থাকত, আমার লেখার প্যাডে প্রতিটি রান-বলের হিসাব লিখে রাখতাম’—অস্ট্রেলিয়ান দৈনিক হেরাল্ড সানে ওয়ালশের কথাগুলো কিছুটা ধারণা দেবে তাঁর ‘পাগলামি’র।
পাগলামি? নাহ, জীবনের অবলম্বন! অক্সিজেনের পাশাপাশি বেঁচে থাকার জন্য বৃত্তাকার সবুজ মাঠ, ব্যাট আর বলের টুক টুক আওয়াজ না হলেও চলত না ওয়ালশের। আরেক অস্ট্রেলিয়ান দৈনিক দ্য এইজে বলছিলেন, ‘সত্যি বলতে, গ্রীষ্মের সময়ে শনিবারগুলোতে ক্রিকেট মাঠে না যেতে পারলে আমি হয়তো ঠিক থাকতে পারতাম না।’
ব্যাট কিংবা বল হাতে তাঁর দক্ষতা কেমন ছিল জানা যায়নি। হয়তো ব্যাট-বলের পাশাপাশি সংখ্যাগুলোও টানত ওয়ালশকে। ‘ক্রিকেট-গিক’ বলতে ইংরেজিতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই। কল্পনায় ভেবে নিন, চশমা চোখে কোনো ১৪ বছরের কিশোর, ব্যাট-বলের লড়াই দেখার পাশাপাশি সংখ্যার কড়কড়ানিতেও যাঁর সমান আকর্ষণ। যে ছবিটা আসবে, ওয়ালশ হয়তো তা-ই ছিলেন।
কাজটা একেবারে সহজও কিন্তু নয়। ক্রিকেটে স্কোরারের কাজ করতে গেলে শুধু ব্যাট-বলের লড়াইয়েই মগ্ন হওয়া যায় না, মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখতে হয় আরও অনেক দিকে। হিসাব রাখতে হয় অনেক কিছুর। একেকটা বলে শুধু বল আর রানের হিসাবই তো নয়, ওভারের কততম বল গেল, ব্যাটসম্যান কততম বল খেললেন, তাঁর কত রান হলো, রানটা কীভাবে এল, চার-ছক্কা হলে সেটির হিসাব, দলের স্কোর কত হলো—সবদিকেই একসঙ্গে হালনাগাদ করতে হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারও চোখ এড়ানো চলবে না, প্রতিটি মুহূর্তে মনোযোগ থাকতে হবে শতভাগ।
এই কঠিন কাজটিই নিষ্ঠার সঙ্গে ৫৮ বছর ধরে করে চলেছেন ওয়ালশ। বিফলে যায়নি তাঁর সাধনা। এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবের স্কোরার হিসেবে দারুণ সাফল্য তাঁকে এনে দিয়েছে ভিক্টোরিয়ার রাজ্য দলের স্কোরার হিসেবে কাজ করার সুযোগ, সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল! ‘মাইক ভিক্টোরিয়ার সিনিয়র দলের স্কোরার হিসেবে ৪০ বছর কাজ করেছেন, পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের হয়ে প্রায় ১০০ টেস্ট ম্যাচেও কাজ করেছেন। এর মধ্যে গত বছর এমসিজিতে ভারতের বিপক্ষে বক্সিং ডে টেস্টও ছিল’—এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবের বিবৃতি বোঝায়, ওয়ালশের কীর্তিতে গর্ব তাঁদেরও কোনো অংশে কম নয়।
ওয়ালশ নিজেও তো কখনো এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবকে ‘পর’ হতে দেননি। অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে বিদেশ সফরে গেছেন ১৭ বার, স্কোরার হিসেবে পৌঁছেছেন সর্বোচ্চ শিখরে। কিন্তু এত সবের মধ্যেও এডেনসনকে ভোলেননি, ক্রিকেট ক্লাবটার হয়ে কাজ করেছেন প্রতি মৌসুমে। ‘সেই ১৯৬৩ সাল থেকে মাইক এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবকে ধারাবাহিক সেবা দিয়ে আসছেন। ক্লাব কমিটিম্যান, কোষাধ্যক্ষসহ আরও অনেক ভূমিকায় কাজ করেছেন তিনি’—বিবৃতিতে লিখেছে এসেনডন ক্রিকেট ক্লাব।
এই ৫৮টি বছর কাজ করার বিনিময়ে ওয়ালশ কী নিয়েছেন? হৃৎস্পন্দনের প্রতিদানে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন এতগুলো বছর ধরে, অর্থের মূল্যে সেটির হিসাব করা দায়। অর্থের মূল্যে হিসাব হয়ওনি। এত বছরে এসেনডন থেকে কোনো বেতন নেননি ওয়ালশ। সেই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব এখনো মেনে চলছেন।
তবে ভদ্রলোকের খেলাটায় অসাধারণ এক গল্প লিখে যাওয়ার স্বীকৃতি ঠিকই পেয়েছেন মাইক ওয়ালশ। ক্রিকেটে দারুণ অবদানের জন্য এবারের ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ পদকপ্রাপ্তদের একজন মাইক। উদ্যাপনে এসেনডন ক্রিকেট ক্লাবের কথাগুলোও মন ছুঁয়ে যাবে, ‘মাইক, এই খুশিটা আপনার দারুণ পরিবার আর আপনার গর্বিত সব ক্লাব সতীর্থের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিন। অসাধারণ একটা ইনিংস এটি, যেখানে এখনো অনেক রান তোলার বাকি।’