৫০০০–এর মুশফিকের কাছে প্রশ্ন
একেকটি ঘামের বিন্দুতে কত রানের পাণ্ডুলিপি লেখা থাকে? একেকটি পরিশ্রান্ত সিরিজের পরও ছুটির সকালগুলোতে আড়ষ্টতার চাদর সরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কতটা মানসিক শক্তি লাগে? কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে একজন মানুষ পারেন নিয়ত সমালোচনার তিরবিদ্ধ শরীরেও নিজেকে উদ্যাপনের মধ্যমণি করতে?
টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম কাউকে আজ ৫০০০ রান করতে দেখে এ রকম আরও কত যে প্রশ্ন যে ভিড় করছে মনে! সব প্রশ্নের উত্তর চাই একজনের কাছে—মুশফিকুর রহিম। প্রথম ৫০০০-এর নায়ক মুশফিক বলেই তো প্রশ্নগুলো মনে আসা!
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তামিম ইকবালকে ড্রেসিংরুমে দর্শক করে রেখে আজ টেস্টে পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছে মুশফিকের ব্যাট। টেস্টে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিও এখনো তাঁরই দখলে। আজ না পারলেও এই দৌড়ে তামিম হয়তো কোনো এক ম্যাচে টপকে যাবেন মুশফিককে। এরপর মুশফিক আবার টপকাবেন তামিমকে। তারপর...।
তারপর যত দিন তাঁরা খেলবেন, আশা করা যায় এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত কেউ থাকবেন ওপরে, কেউ নিচে। কিন্তু ওই জায়গাটা থেকে মুশফিকের নাম মুছতে পারবে না কেউ। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ৫০০০ রান করেছেন কে—এর উত্তর চিরকালই হয়ে থাকবে মুশফিকুর রহিম।
১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মুশফিক নিজেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পরিশ্রমের প্রতিমূর্তি হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। তারকাখ্যাতিতে মুশফিকের চেয়ে বড় নাম বাংলাদেশে তাঁর সমসাময়িক ক্রিকেটারদের মধ্যেই আছে। কিন্তু খেলার প্রতি নিবেদন আর সততায় মুশফিকের চেয়ে এগিয়ে থাকার দাবি মনে হয় না তাঁরাও করবেন।
নামটা তামিমেরও হতে পারত। দুর্ভাগ্য তাঁর, হাতের মাংসপেশির সমস্যার কারণে গতকাল ১৩৩ রান নিয়ে তামিমকে গিয়ে আসন নিতে হয়েছে ড্রেসিংরুমে। মুশফিককে টপকে কিছু সময়ের জন্য টেস্টে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান (৪৯৮১) হয়ে গিয়েছিল তামিমের। কিন্তু পাঁচ হাজারি ক্লাব দৃষ্টিসীমায় থাকলেও সেখানে পৌঁছাতে তাঁর লাগত আরও ১৯ রান। কে জানে, চোটে পড়ে তখন মাঠ ছাড়তে না হলে প্রথম ৫০০০ রানের কীর্তিটা হয়তো তামিমই গড়তেন। তবে আজ ব্যাটিংয়ে ফিরেও তামিম শেষ পর্যন্ত পারেননি মুশফিকের পিছু পিছু সেখানে পৌঁছাতে। বরং মুশফিকই পরে পাঁচ হাজারি ক্লাবে নাম লেখানোর উপলক্ষ্যটা উদযাপন করেছেন সেঞ্চুরি দিয়ে।
এমনিতে টেস্টে ৫০০০ রান কালের পরিক্রমায় খুব বড় কোনো অর্জন হয়ে থাকে না। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেই মুশফিকের আগে ৫০০০ রানের মাইলফলক পেরিয়ে গেছেন ৯৮ জন ব্যাটসম্যান। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মুশফিকের অর্জনটা বড় হয়ে যাচ্ছে, কারণ এখানে এই উচ্চতায় তিনিই প্রথম। আসলে ক্রিকেট–বিধাতাই যেন চেয়েছেন টেস্টে প্রথম ৫০০০ রানের বরমাল্য উঠুক মুশফিকের গলায়। তিনিই পান খেলাটার প্রতি তাঁর নিবেদনের পুরস্কার। সে কারণেই হয়তো ৫০০০ নিয়ে এত নাটকীয়তা, মুশফিককে পথ করে দিয়ে ৫০০০ রানের জন্য তামিমের সুবাসিত অপেক্ষা বেড়ে যাওয়া।
গতকাল মুশফিককে টপকে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েও মাত্র ১৯ রান দূরে থাকার সময়ে তামিম ‘আহত অবসর’ হয়ে মাঠ ছেড়ে যান। সেই সুযোগে আজ সবার আগে মুশফিকই উঠে গেলেন পাঁচ হাজারের চূড়ায়। টেস্টের প্রতিপক্ষ যদিওবা শ্রীলঙ্কা, চট্টগ্রামে তামিমের সঙ্গে এই শ্বাসরুদ্ধকর দ্বৈরথ জিতেও মুশফিক হাততালি পেয়েছেন এবং তা পেয়েছেন স্বয়ং বন্ধুসম তামিম ইকবালের কাছ থেকেও। মুশফিকের ৫০০০-এ পৌঁছানোর পর ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এসে তামিম হাততালিতে অভিনন্দিত করেছেন বাংলাদেশে পাঁচ হাজারের দৌড়ে তাঁর একমাত্র অগ্রজ মুশফিককে।
একদিক দিয়ে অবশ্য তামিম মুশফিকের চেয়ে এগিয়েই থাকবেন। তিনি পাঁচ হাজারের সুবাস পাচ্ছিলেন নিজের ৬৬তম টেস্টে এসে, পাঁচ হাজারেও নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবেন মুশফিকের চেয়ে অনেক কম টেস্ট খেলেই। কারণ, মুশফিকের এটি ৮১তম টেস্ট। টেস্ট ক্যারিয়ারও তামিমের চেয়ে মুশফিকেরই লম্বা। তামিমের টেস্ট অভিষেক যেখানে ২০০৮ সালে, মুশফিক সেখানে প্রথম টেস্ট খেলেছেন ২০০৫ সালের এই মে মাসেই। মুশফিকের সমসাময়িক অভিষিক্ত ক্রিকেটারদের মধ্যে এখনো নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেন, এমন খেলোয়াড় বিশ্ব ক্রিকেটেই বিরল।
১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মুশফিক নিজেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পরিশ্রমের প্রতিমূর্তি হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। তারকাখ্যাতিতে মুশফিকের চেয়ে বড় নাম বাংলাদেশে তাঁর সমসাময়িক ক্রিকেটারদের মধ্যেই আছে। কিন্তু খেলার প্রতি নিবেদন আর সততায় মুশফিকের চেয়ে এগিয়ে থাকার দাবি মনে হয় না তাঁরাও করবেন।
মুশফিকের কাছে বিশ্রামের অপর নামও অনুশীলন, খেলা। খেলাটাকে কখনো কখনো তাঁর জীবনের চেয়েও বেশি ভাবা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। এত অনুশীলন, এত পরিশ্রমে হিতে বিপরীতও দেখেন অনেকে। কিন্তু নিজের জীবন আর নিজের খেলার দর্শন ঠিক করার অধিকার তো সবার আগে মুশফিকেরই। তিনি নিজে যদি এভাবেই স্বচ্ছন্দ থাকেন, এভাবেই নিজের সেরাটা বের করে আনতে পারেন, তবে সেটাই চলুক না!
আর ক্রিকেট–বিধাতাও যে সে রকমই চান, সেই দৃষ্টান্ত তো মুশফিক আগেও রেখেছেন। দেশের হয়ে প্রথম ৫০০০ রানের মতো টেস্টে আরেকটি বড় ‘প্রথম’–এর অর্জনও আছে তাঁর। ২০১৩ সালে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই গলে নিজের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরিটিকে পরিণত করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরিতে, যেটি ছিল বাংলাদেশের হয়েই কারও প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
সেদিনও ক্রিকেট ঈশ্বরের অদৃশ্য হাত ছিল মুশফিকের মাথার ওপর। তিন নম্বরে নেমে মোহাম্মদ আশরাফুল ১৯০ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন বলেই না ছয়ে নেমে মুশফিকের করা ২০০–ই হয়ে গেল বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি! এরপর আজ আরেকটি বড় মাইলফলক ৫০০০ রানেও সবার আগে নিজের নামটি খোদাই করে নিলেন ‘মুশফিক দ্য এম আর ৫০০০।’
মুশফিকের ‘প্রথম’ হওয়ার অদৃশ্য পাণ্ডুলিপিতে আরো কী কী লেখা আছে, সেটা আর কেউ না জানলেও জানেন ক্রিকেট–বিধাতা।