অভূতপূর্ব তো বটেই, অবিশ্বাস্যও।
টেস্টের শেষ দিনের খেলা। প্রতিপক্ষ লক্ষ্য দাঁড় করিয়েছে ২৯৯। শেষ সেশনে যা কমে ১৬০। ইতিহাস ছড়াচ্ছিল 'ওহে যুবক, সংযত হও' সাবধানবাণী। কিন্তু ইংল্যান্ডের তাতে থোড়াই কেয়ার। ম্যাচ শেষ দিনের খেলা শেষের নির্ধারিত সময়েরও ঘণ্টাখানেক আগে। ওই রানগুলো তুলতে ইংল্যান্ডের ১৬ ওভারই লেগেছে!
ভাবতে অবাকই লাগে, এই ইংল্যান্ডই কী হতশ্রী দিন যাপন করছিল গত দু'বছর ধরে। ব্যাটিংয়ে এক জো রুট ছাড়া দেখার মতো কী-ইবা ছিল তাদের? খেলছিলও ভীষণ কুৎসিত ক্রিকেট। গেল বছরই এই নিউজল্যান্ডের বিপক্ষেই লর্ডসে ইংল্যান্ডকে তাড়া করতে হতো ২৭৩ রান। হাতে ছিল ৭৫ ওভার। ইংল্যান্ড ইতিহাস গড়তে ছোটেনি। ইংল্যান্ড ৩ উইকেট হারিয়ে ১৭০ তুলতেই ম্যাড়মেড়ে ড্র হয়েছিল ম্যাচটা।
ম্যাড়মেড়ে ক্রিকেট তারা খেলছিল এর আগে-পরেও। ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনার নেশায়, অমন 'অপবাদ' দেওয়ারও অবকাশ নেই। প্রাক্তন কোচ ক্রিস সিলভারউডের শেষ ১৪ টেস্টের ১০-টিতেই হারতে হয়েছিল দলকে। আর ওই দলটাই আমূল বদলে গেল একজন নতুন কোচ আর অধিনায়কের আগমনে।এই দলের দর্শনই তো পাল্টে গেছে।
পরিবর্তনটা দৃশ্যমান সর্বক্ষেত্রেই। সবচেয়ে কম যেখানে, সেই বোলিং দিয়েই শুরু করা যাক। অ্যাশেজে ভরাডুবির পরে নতুন শুরুর প্রত্যাশায় দুই বুড়ো ঘোড়া জেমস অ্যান্ডারসন-স্টুয়ার্ট ব্রডকে বাদ দেওয়ার আস্পর্ধা দেখিয়েছিল ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। তবে সমস্যাটা যে সেখানে নয়, তার প্রমাণ পেতে সময় লাগেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ হেরে আসতে হয়েছিল ১-০ ব্যবধানে।
ইংলিশ গ্রীষ্ম শুরু হতেই তাই দল ঘোষণা করা হয়েছিল দুজনকে রেখেই। মাঝের সময়টায় দুজনে ক্রুদ্ধ হয়েছেন ভেতরে ভেতরে, হয়েছিলেন শাণিতও। সঙ্গে ঝেড়ে ফেলেছেন প্রাক্তন কোচ ক্রিস সিলভারউডের গুঁজে দেওয়া 'ব্যাট লং, বল ড্রাই' মন্ত্রও।
'ওভারপ্রতি দুই রান করে দাও, ব্যাটসম্যান নিজে থেকেই ভুল করে বসবে', এভাবেই নাকি উইকেট আদায়ের পরিকল্পনা ছিল সিলভারউডের জমানায়। সেই পরিকল্পনাটা যে কাজ করেনি পুরোপুরি, সেটা তো জয়-পরাজয়ের অনুপাতেই প্রমাণিত। আরও বেশি আক্রমণ কেন করছেন না বল হাতে, অ্যান্ডারসন-ব্রডের চারপাশে তাই নিয়মিতই গুনগুন করেছে এই প্রশ্ন।
তবে সেসব দিন এখন অতীত। স্টোকস-ম্যাককালামের ইংল্যান্ড কিভাবে খেলবে, তার একটা ইঙ্গিত মিলেছিল একদম শুরুর দিনেই। গ্রীষ্মের প্রথম দিককার সকাল বলে লর্ডস টেস্টে ভালোই সুইং মিলেছিল, সাফল্য পেতে চাইলে অ্যান্ডারসন-ব্রডকে ফুল লেংথেই বল করতে হতো। সেটা তাঁরা আগেও করতেন যদিও, তবে এবার সংখ্যাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিনের প্রথম সেশনে ব্রড বল পিচ করিয়েছিলেন স্টাম্প থেকে গড়ে ৫.৯ মিটার দূরত্বে, গত অ্যাশেজে যেটা ছিল ৬.৮ মিটার। একইভাবে ব্যাটসম্যানের স্টাম্পের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়েছিলেন অ্যান্ডারসনও।
ফুল লেংথে বল করার মানে যেমন উইকেটপ্রাপ্তির সম্ভাবনা, তেমনি এখানে দেদারসে রান বিলানোর ঝুঁকিও আছে। ট্রেন্ট ব্রিজে দ্বিতীয় টেস্টে যেমনটা ঘটেছে। সুইং-সিম মুভমেন্ট মিলছিল না তেমন উইকেট থেকে, তবুও প্রথম দিনে লর্ডসের চেয়ে ২০ সে.মি. সামনে বল করে গেছে ইংল্যান্ড। ফলাফল, টেস্টের প্রথম দিন লাঞ্চের আগেই ১০০ রান তুলে ফেলেছে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০১৭ সালের পর যে ঘটনা প্রথমবার।
তবে প্রতিপক্ষের রানের চাকায় লাগাম পরানোর ইচ্ছাটা যে এই ইংল্যান্ডের জীবন-মরণ নয়, সেটা ব্রড জানিয়ে গেছেন একদম স্পষ্ট করে। লর্ডসে যে ৩ উইকেট নিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে, পরে এসে সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বলেছেন, ওভারপ্রতি ২.৫ করে ১২০ রান দেওয়ার বদলে ৩.৩ রেটে ৮৫ রান দেওয়াটাকেই এই ইংল্যান্ড বেছে নেবে। কারণ, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কোচ হয়ে এসেই পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দিয়েছেন, 'ইকোনমি রেট নয়, উইকেট' মানদণ্ডেই এবার তাদের বিচার করা হবে।
কিসের ভরসায় ইংল্যান্ডের এমন হুংকার, সেটা বুঝতে তাদের ব্যাটিংয়ে তাকাতে হবে। জো রুট গত দু'বছর ধরেই রয়েছেন ফর্মের চূড়ায়, তবে বাদবাকিরা সেই শিখরের উদ্দেশে রওনাই দিতে পারেননি বলে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলটার অবস্থা লেজেগোবরে। লর্ডসে প্রথম টেস্টে আরও একবার বালির ঘরের মতো গুড়িয়ে গিয়েছিল ইংলিশ ব্যাটিং লাইন-আপ; এরপরে মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক যে, কিচ্ছু বদলায়নি। তবে এরপর থেকে তিন ইনিংসে ইংল্যান্ড রান করেছে ১১১৭, সেটাও ওভারপ্রতি ৪.৫৭ করে রান তুলে।
ম্যাককালামের ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ছাঁচটা অবশ্য ধরে ফেলা গিয়েছিল লর্ডসে প্রথম ইনিংসেই। একটু মনে করিয়ে দিই, ওই ইনিংসে ইংল্যান্ডের সব ব্যাটারই তাদের স্বভাবসুলভ খেলাটা খেলতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন। ইনিংসের এক পর্যায়ে রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বল করতে আসা কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম আর টিম সাউদিকে খেলতে ইংলিশ ওপেনার অ্যালেক্স লিস গার্ড নিয়েছিলেন প্রায় ষষ্ঠ স্টাম্পে। ম্যানেজমেন্টের একটা বার্তা অন্তত স্পষ্ট এ থেকে। একাদশের সদস্যদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার বদলে তাদের নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ করে দিতে চাইছে।
সেটা আরও স্পষ্ট হলো বাকি তিন ইনিংসে। জো রুটের ২১১ বলে ১৭৬ কিংবা এজাজ প্যাটেলকে বেন স্টোকসের বারংবার স্লগ সুইপ; খুঁজতে বসলে দুই টেস্টজুড়ে প্রচুর উদাহরণই পাওয়া যাবে। জনি বেয়ারেস্টোর স্মৃতিটা যেহেতু টাটকা, তাঁকে না টানলেই বা কেমন দেখায়? নিজের সহজাত স্ট্রোক প্লে'র দ্যুতি ছড়াতে গিয়ে উইকেট দিয়েছিলেন লর্ডসে রান তাড়ায়। তবে 'মারো, নয় মরো' দর্শন থেকে বেরিয়ে আসেননি নটিংহ্যামেও। এক সেশনে কমপক্ষে ৯০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট, সেঞ্চুরির পথে সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক শট খেলেও সবচেয়ে কম ভুল শটের হার, এবং চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে দ্রুততায় রান তোলার ইতিহাস; ফলাফলটা তো চোখের সামনেই।
'বইয়ের মলাট দেখে বিচার কোরো না' আর 'প্রভাতই দিনের পূর্বাভাস দেয়', প্রবাদ দু'রকমটাই আছে। দুই টেস্টেই যে ভরপুর বিনোদন দিলো এই ইংল্যান্ড দলটা, তাতে ক্রিকেট-অনুরক্ত আপনি আশা করতেই পারেন, বছরান্তে দ্বিতীয় প্রবাদটাই সত্যি হবে।